‘দিশাহীন বাজেট!’ সংসদ অধিবেশনে মোদি সরকারকে তুলোধনা অভিষেকের

Abhishek Banerjee in Budget 2024: এমনকী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি। পরিসংখ্যান-সহ এদিন কেন্দ্রীয় সরকারের গত ১০ বছরের মার্কশিট তুলে ধরেছিলেন অভিষেক।

তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর মঙ্গলবার ঘোষণা হল মোদি সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ভোটের বছর বলে ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট বের করেছিল মোদি সরকার। আর সেই বাজেটে প্রায় কোনও বড় ঘোষণাই ছিল না অর্থমন্ত্রীর তরফে। সরকার গড়ে পূর্ণাঙ্গ বাজেটেই সমস্ত বড় ঘোষণা সামনে আনা হবে বলে জানানো হয়েছিল। এই বার লোকসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। কোনও মতে জোটের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়েছে তারা। লোকসভা ভোটের মুখে সরকারের বাজেট ঘোষণা কার্যত হতাশই করেছিল দেশের মানুষকে। তার ফল ভোটের ফলাফলে হাতেনাতেই পেয়েছে বিজেপি। সে কারণেই এই বারের বাজেট নিয়ে অতি সতর্ক ছিল মোদি ৩.O সরকার। কিন্তু আদৌ কি জনমোহিনী বাজেট তৈরি করতে পারলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন? সংসদ অধিবেশনে বাজেট-বিতর্ক শুরু হতেই অবশ্য ২০২৪ সালের বাজেটকে 'দিশাহীন' বলেই তোপ দাগলেন বিরোধীরা।

এবারের বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কোনও ঘোষণাই নেই। কার্যত বিহার আর অন্ধ্রপ্রদেশ ছাড়া আর কোনও রাজ্যের প্রতিই প্রসন্ন দৃষ্টি দেখায়নি মোদি সরকার। তার কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুই ছিলেন কিংমেকারের ভূমিকায়। কার্যত তাঁদের সমর্থন নিয়েই সরকার গড়তে সফল হয়েছে বিজেপি। ফলে এ বার পালা তাঁদের ঋণ মেটানোর। সেই ব্যাপারটাকে কটাক্ষ করে এদিন সংসদে তৃণমূল সাংসদ তথা দলের সেকেন্ড ইন-কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এবারের বাজেট শরিক দলগুলিকে সন্তুষ্ট করার জন্যই তৈরি হয়েছে। সরাসরি মোদী সরকারকে নিশানা করে অভিষেক জানান, এই বাজেট সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা প্রত্যাখ্যান করেছে।

এমনকী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি। পরিসংখ্যান-সহ এদিন কেন্দ্রীয় সরকারের গত ১০ বছরের মার্কশিট তুলে ধরেছিলেন অভিষেক। তাঁর দাবি, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় পরাজয়ের পর থেকে কেন্দ্র যদি বাংলাকে এক টাকাও দেয়নি। আর তা যদি না হয়, তাহলে তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক বলে এদিন সংসদে মোদি সরকারকে কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। অভিষেকের ভাষণের সময় আগাগোড়া বিজেপি-র তরফ থেকে টিকা-টিপ্পনি উড়ে আসে। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র খাঁ-র বাদানুবাদে অধিবেশন আরও তেতেও ওঠে। এমনকি স্পিকার ওম বিড়লার সঙ্গেও কথা কাটাকাটি হয় তৃণমূল সাংসদদের।

আরও পড়ুন: দেশের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল মোদি ৩.০ সরকারের বাজেট?

১৪০ কোটি দেশবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য বাজেটে কিছুই রাখা হয়নি বলেই এদিন দাবি করেছেন ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ অভিষেকের। তাঁর কথায়, "এই বাজেট দু'জন ব্যক্তি তৈরি করেছেন, অন্য দু'জনকে সন্তুষ্ট করার স্বার্থে। জনবিরোধী এই বাজেট শরিক দুই দলকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছে।" প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে অভিষেক বলেন, "২০১৪ সালে যখন প্রথমবার নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলেন, বলা হত মোদী সরকার। দ্বিতীয়বার ২০১৯ সালে তাঁরা জেতার পর বলা হল মোদী ২.০ সরকার। কিন্তু, গত ৪ জুন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখাল দেশের জনতা BJP-কে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে এখন ক্ষমতায় রয়েছে নড়বড়ে একটি জোট সরকার। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীও এই সরকারকে আর মোদী ৩.০ বলছেন না। কোনও মন্ত্রী এবং BJP নেতাদের মুখেও তা শোনা যাচ্ছে না। সকলেই জানেন, এ সরকার বেশিদিন টিকবে না।"

এখানেই থামেননি অভিষেক। এনডিএ জোট সরকারকে নিশানা করে এদিন অভিষেক তোপ দাগেন নির্মলার বাজেটে বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য ঢালাও বরাদ্দ নিয়েও। তাঁর কথায়, "এতদিন আমরা জানতাম জোটের অর্থ সহযোগিতা। বাজেটে বুঝলাম জোটের অর্থ তোষণ, ক্ষতিপূরণ। সময় বদলে গিয়েছে। ৫০ দিন হয়ে গিয়েছে, দেশ তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ সেটা মেনে নিতে পারছেন না মোদী।" অভিষেক এদিন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন কার্যত। তাঁর কথায়, "মোদীজির তৃতীয়বারে এখনও যুবরা বেকার। ওরা বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও-এর কথা বলে অথচ সেই বেটি-কে চাকরি দেওয়ার কথা বলে না। এদিকে, বাংলায় রয়েছে কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প। এগুলোকে জাতীয় মডেল করা উচিত। বিজেপির সঙ্গে মহিলা ক্ষমতায়নের কোনও সম্পর্কই নেই। সেন্ট্রাল ভিস্তার নামে দু'হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অথচ গৃহহীনরা বঞ্চিত। বাংলার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে। বাংলার সংস্কৃতি নষ্ট করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে লড়তে না পেরে আমাদের রাজ্যের গরিবদের বঞ্চিত করে চলেছে ওরা।' এরপরই তাঁর সংযোজন, 'আমি চ্যালেঞ্জ করছি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জানান বাংলার জন্য ঠিক কত আর্থিক বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০২১-এ বাংলার হারের পর বাংলার ১০০ দিনের প্রকল্প এবং আবাস যোজনায় পর পর তিন অর্থবর্ষে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, জানানো হোক।"

Galvanizing Organic Bio-Agro Resources Dhan (গো-ব-র-ধ-ন), Heritage City Development and Augmentation Yojana (হৃদয়)-র মতো একাধিক কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের নাম নিয়ে এদিন কটাক্ষ করেন অভিষেক। একই ভাবে BUDGET-এর সংক্ষিপ্ত রূপকে বিশদে ব্যাখ্যা করতেও ভোলেননি অভিষেক। তাঁর কথায়, B অর্থাৎ Betrayal (বিশ্বাসঘাতকতা), U অর্থাৎ Unemployment (বেকারত্ব), D অর্থাৎ Deprive (বঞ্চনা), G অর্থাৎ Guarantee & Ghotala (প্রতিশ্রুতি ও দুর্নীতি), E অর্থাৎ Eccentric (উদ্ভট) এবং T অর্থাৎ Tragedy (দুর্ঘটনা)। এই প্রতিটি বর্ণ ধরে ধরে এদিন কার্যত মোদি সরকারের দুর্বলতার জায়গাগুলো তুলে ধরেন। তাঁর মতে 'অচ্ছে দিন'-এর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রাখতে পারেনি মোদি সরকার। এমনই অজস্র বিশ্বাসঘাতকতায় মোড়া মোদির তিনটি দফা। এবারের বাজেটে কর্মসংস্থানের উপর বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। দেরিতে হলেও সরকার মানতে বাধ্য হয়েছে, আজকের ভারতে সবচেয়ে বড় সমস্যা কার্যত বেকারত্ব। সেই বেকারত্ব নিয়েও এদিন মোদি সরকারকে বিঁধেছেন অভিষেক। একই সঙ্গে কেন্দ্রের বাংলার প্রতি বঞ্চনার কথাও এদিন তুলে ধরেন অভিষেক। নেট-দুর্নীতি, ইলেক্টোরাল দুর্নীতির মতো একাধিক দুর্নীতি ভোটের বাজারে তো বটেই, সরকার গড়ার পরেও বিপাকে ফেলেছে গেরুয়া শিবিরকে। অভিষেক জানান, “নরেন্দ্র মোদির উদ্ভট কাজকর্ম সরকার তথা শাসন ব্যবস্থাকে সার্কাসে পরিণত করেছে।" সেই প্রসঙ্গে নোটবন্দি থেকে শুরু করে লকডাউনের মতো মোদি সরকারের একাধিক উদ্ভট ও ভুল সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরেন তিনি। বক্তৃতার শেষ পর্বে এসে এই বাজেটকে ফাইনান্সের চেয়ে ফিকশন বেশি বলেই কটাক্ষ করেন অভিষেক। তৃণমূল নেতার দাবি, কলকাতায় কয়েক বছর আগে যখন ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ে গিয়েছিল, তখন মোদী বলেছিলেন, এটা অ্যাক্ট অব গড নয়, অ্যাক্ট অব ফ্রড। মোরবি ব্রিজ ভেঙে পড়া, দিল্লির এয়ারপোর্টের ছাদ ভেঙে পড়া, রাম মন্দিরের ছাদ থেকে জল পড়া, অটল সেতুতে ফাটল ধরা, উত্তরাখণ্ডের সূড়ঙ্গে শ্রমিকদের আটকে পড়া, বালাসোরে ট্রেন দুর্ঘটনা – এগুলো কি ছিল? অ্যাক্ট অব গড না, অ্যাক্ট অব ফ্রড? আর সেখানেই ট্র্যাজেডির প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে ভোলেননি অভিষেক।

আরও পড়ুন: Budget 2024: বন্দে ভারতেই মন! সাধারণ ভারতীয়রা ব্রাত্যই নির্মলার রেল বাজেটে

তাঁর কথায়,“অবকি বার ৪০০ পার বলে বাংলায় হেরেছে, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে ধাক্কা খেয়েছে। বলেছিল জো রাম কো লায়ে, হম উনকো লায়েঙ্গে, ব্যাকফায়ার করেছে। আমি বলব, প্রভু রাম আয়ে, তো কুছ ন্য়ায় আয়া। কুছ ওয়ক্র জরুর লাগা, পর ইনসাফ আয়া। অযোধ্যায় লজ্জাজনক ভাবে হেরেছেন, উপনির্বাচনে বদ্রীনাথে হেরেছেন। ওয়ক্ত বদল গয়া হ্যায়। প্রধানমন্ত্রী একটি দুর্বল, ভঙ্গুর, নড়বড়ে সরকার জোট সরকার চালাচ্ছেন। দেশের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগের পরিবর্তে এখন মোদির রাজনৈতিক সার্ভাইভ্যালের জন্য বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আসল কথা হল, ধার করা সময়ের মধ্যে রয়েছেন আপনারা। থোড়া সবর রাখিয়ে, কুর্সি কা পেটি বাঁধ লিজিয়ে, মওসব বিগড়নে ওয়ালা হ্যায়।” অভিষেকের ভাষণ নিয়ে এদিন আপত্তি জানিয়েছেন, বিজেপি সাংসদ বাঁশুরি স্বরাজ। অভিষেক ‘বিট্রেয়াল’, ‘মিনিয়ন’, ‘এক্সেনট্রিকে’র মতো অসংসদীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি। এমনকী অভিষেকের ভাষণের অংশ রেকর্ড থেকে বাদ দিতে স্পিকারকে অনুরোধও করেন তিনি। এদিন কৃষকদের প্রসঙ্গ নিয়ে স্পিকার ওমপ্রকাশ বিড়লার সঙ্গেও বাকবিতন্ডায় জড়ান অভিষেক। বাজেটের পরের দিনই যে এ ভাবে বিরোধীদের তোপের মুখে পড়তে হবে বিজেপি সরকারকে, এমনটা বোধহয় প্রত্যাশা করেনি শাসক দলও। যেখানে এবারে অনেক ভেবেচিন্তে জনমোহিনী বাজেটের মাধ্যমে ভুলসংশোধনের চেষ্টায় মরিয়া ছিল গেরুয়া শিবির।

More Articles