কেবল রামদেবই নন, মেয়েদের নিয়ে বারবার অশালীন মন্তব্য করেছেন এই ধর্মগুরুরা

Ramdev Comments on Women: যোগগুরু রামদেব এর আগেও মেয়েদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। সেই 'ট্র্যাডিশন'-এর সঙ্গী আরও অনেকে...

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর থানের যোগ সায়েন্স ক্যাম্প ও ওমেন’স মিটিংয়ের মঞ্চে তখন সাজো সাজো পরিসর। সেখানে তখন উপস্থিত হয়েছেন মহারাষ্ট্রের নতুন মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের পুত্র শ্রীকান্ত শিন্ডে। সঙ্গে রয়েছেন উপ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশের স্ত্রী অম্রুতা ফড়নবিশ। তাঁদের সঙ্গেই মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন যোগগুরু বাবা রামদেব। বক্তব্য পেশ করাকালীন হঠাৎই এক অদ্ভুত কথা বলে বসলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, “মেয়েদের শাড়ি পরলেও ভালো লাগে, অম্রুতাজি’র মতো সালোয়ার পরলেও ভালো লাগে। এমনকী আমার মতো কিছু না পরে থাকলেও মেয়েদের ভালোই লাগে। আসলে লজ্জা নিবারণের জন্যই মানুষ পোশাক পরে।”

আরও পড়ুন : কেন আক্রমণ সলমন রুশদির ওপর? আসল কারণ লুকিয়ে সেই ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে’ 

শেষ কথাগুলো উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে কার্যত সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। এভাবে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলা, একপ্রকার পণ্যের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, এটা কি তাঁর মতো পরিচিত এক মুখ, যোগগুরুর কাছ থেকে আশা করে মানুষ? এই প্রশ্নই বারবার তোলা হয়। দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়াল টুইট করে বাবা রামদেবকে ক্ষমা চাওয়ার কথাও বলেন। মহারাষ্ট্র মহিলা কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে এর কারণ দর্শানোর কথাও বলা হয়। দেশজুড়ে চলা বিস্তর ঝড়-ঝঞ্ঝার পর শেষমেশ অবশ্য ক্ষমা চেয়েছেন বাবা রামদেব। তাঁর বক্তব্য, তিনি মেয়েদের খুবই সম্মান করে। নারী স্বাধীনতা ও নারীদের প্রগতির দিকে সবসময় তাঁর নজর থাকে। ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর মতো উদ্যোগকেও তিনি আগে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তাঁর মন্তব্যের জন্য কেউ যদি দুঃখ পান, তার জন্য তিনি ক্ষমা চাইছেন।

ক্ষমা তো চাইলেন’ কিন্তু প্রশ্ন এখনও জারি রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের হিসেব দেখলে, এমন ঘটনা খুব নতুন কিছু নয়। কেবল বাবা রামদেব নন, ভারতজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আরও অনেক তথাকথিত ‘সাধু’, ‘বাবা’দের মুখ থেকে এমনটাই শোনা যায়। বাবা রামদেব অবশ্য এখানেই থেমে থাকেননি। এই মঞ্চেই তিনি বলেছেন, মানুষ সামাজিকতা বজায় রাখার জন্য পোশাক পরে। আগে তো শিশু বয়সে জামাকাপড় পরানো হতো না। এখন সেটাই আধুনিক ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে। ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ বজায় রাখার কথা তিনি বারবার বলেছেন। ভারতের মতো গ্রীষ্ম প্রধান দেশে সবাই জিন্সের টাইট প্যান্ট পরে কেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। মেয়েদের নিয়ে তাঁর ‘টোটকা’র বাহার অবশ্য থামেনি।

আরও পড়ুন : Honor killing: অন্য ধর্মে প্রেম মানেই খুন! হায়দ্রাবাদের ঘটনা যে যে প্রশ্ন তুলছে…

রামদেব বাবা একাই নন, তাঁর দোসররাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন ভারতজুড়ে। কিন্তু কেন বারবার এমন মন্তব্য করেন তথাকথিত সাধু, বাবারা? এর উত্তর পাওয়ার আগে একবার ভারতের দিকে চোখ রাখা দরকার। যে ভারত দুর্গার পাশাপাশি অর্ধনগ্ন কালীর পূজা করে, যে ভারতে অন্যান্য ইতিহাসের পাশে জায়গা করে নেয় খাজুরাহোর ভাস্কর্য। ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে ছিল গার্গী, মৈত্রেয়ীদের কথা। তাঁদের অধ্যায়ন, পাণ্ডিত্য এবং মুক্তচিন্তার জয়গান আজও গাওয়া হয়। তখনকার ভারত কি এমন পোশাকের গণ্ডিতে আটকেছিল?

একবিংশ শতক, ২০২২-এর এই অত্যাধুনিক বিশ্বে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন বিপ্লবের মুখোমুখি হই আমরা। সেখানে প্রযুক্তির বিপ্লব যেমন আছে, তেমনই আছে চিন্তাভাবনার প্রসার, মুক্তচিন্তার বিপ্লব। তারপর নিজেদের পাড়ায়, চায়ের দোকানে, রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায় অন্যরকম দৃশ্য। কাপড়ের দৈর্ঘ্য ছোটো হলেই বক্রোক্তি ধেয়ে আসে। সামনে আসে বাড়ির ‘সংস্কার’-এর কথা। বিয়ের পর সিঁথিতে সিঁদুরের দৈর্ঘ্যও অনেক জায়গায় চোখ দিয়ে মেপে দেখা হয়। বড়দের সামনে স্বামীকে তুই তোকারি করতে নেই, মধ্যবিত্ত পরিবারের আধুনিক ছেলেটিও বলে ওঠে এমন কথাই।

আরও পড়ুন : সমকামিতা থেকে শবরীমালা, বিতর্কিত রায়ে সবসময়ই নির্ভীক জাস্টিস চন্দ্রচূড়

তথাকথিত ‘সাধু’, ‘বাবা’রাও তো এই সমাজ থেকেই উঠে আসেন। এই পিতৃতন্ত্রের বিপুল উৎসবের মধ্যেই তাঁদের লাইমলাইটে আসা। তারপর একের পর এক ঘটনার সম্মুখীন হওয়া। রাম রহিম থেকে আসারাম বাপু, ট্র্যাডিশন চলিতেছে সমানে। ২০১৮ সালে সামনে আসে দাতী মহারাজ নামের এক স্বঘোষিত ধর্মগুরুর কথা। দক্ষিণ দিল্লির ফতেপুরে নিজের আশ্রমে মহিলা শিষ্যাদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছিল এঁর বিরুদ্ধে। উত্তর প্রদেশের বস্তি জেলার সন্ত কুটির আশ্রমের স্বঘোষিত ধর্মগুরু স্বামী সচ্চিদানন্দই হোক বা দিল্লির রোহিণী এলাকার বাবা বীরেন্দ্র দেব রক্ষিত- প্রতিবার এই ‘গুরু’দের বিরুদ্ধে মহিলাদের ধর্ষণ, শোষণের অভিযোগ উঠেছে।

পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে সাচ্চা সৌদার প্রধান গুরুমিত রাম রহিম সিং ইনসানের কথা। ২০১৭ সালে তিনি কারাবন্দী হয়েছেন। কারণ? আশ্রমের দুই সাধ্বীকে তিনি ধর্ষণ করেছেন। ২০ বছরের জেল হেফাজত হলেও, এরইমধ্যে তিন তিনবার তিনি প্যারোলে ছাড়া পেয়েছেন। এমনকী, এবার প্যারোলে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি দিওয়ালির জন্য বিশেষ গানের ভিডিও বানিয়েছেন! ভক্তদের উদ্দেশ্যে রাম রহিমের বক্তব্য, গারদের ওপারের জীবনটাও আধ্যাত্মিক যাত্রার একটা অংশ! অদ্ভুত ঘটনা হল, প্রত্যেকবারই কোনও না কোনো নির্বাচনের আগে তাঁকে ছাড়া হয়। অক্টোবরের ২০ তারিখে একটি ভার্চুয়াল ধর্মীয় সভাও করেন তিনি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শাসকদল বিজেপির কয়েকজন নেতাও।

আরও পড়ুন : নতুনভাবে ইতিহাস লেখার নিদান অমিত শাহের, ‘হিন্দুরাষ্ট্রের’ পথে আরও এক ধাপ?

একই অভিযোগ উঠেছে আসারাম বাপু, স্বামী নিত্যানন্দের ওপরও। প্রথম জন গারদের ওপারে থাকলেও, দ্বিতীয় জন দেশ ছেড়ে নিজের আলাদা ‘রাষ্ট্র’ তৈরি করেছেন। দু’জনের ওপর অভিযোগ একই- ধর্ষণের। নিত্যানন্দের গ্রেফতারি বা তল্লাশি নিয়ে সেরকম উদ্যোগও দেখায়নি কেন্দ্রের শাসকরা। বরং প্রতিবার এই ধর্মগুরুদের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর প্রতিবার সেই শোষণের স্বীকার হন মহিলা এবং শিশুরা। এই প্রসঙ্গে আরেক ধর্মগুরু শঙ্করাচার্য স্বরূপানন্দ সরস্বতীর বক্তব্যও শোনা যাক। মহারাষ্ট্রের শনি শিঙ্গনাপুর মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশেও সমানাধিকারের খবর শুনে অনেকেই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তখনই স্বরূপানন্দ বলেন, “মেয়েদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দিলে ধর্ষণ বাড়বে।” আজও অনেক মন্দিরে মেয়েদের ঢোকা নিষেধ, এটা দিনের আলোর মতোই সত্য। কেবলই কি শিক্ষার অভাব? নাকি সামাজিক সচেতনতা, সামাজিক শিক্ষার প্রসার যথাযথ হয়নি? প্রশাসনও কি দায়িত্ব নিয়েছে? নাকি ‘মাত্রুভূমি’ সত্যই বারবার নিজেদের মন্তব্য, কাজের মাধ্যমে তুলে ধরছেন এই ধর্মীয় গুরুরা?

পিতৃতন্ত্রের রাজনীতির অবসানের স্বপ্ন দেখলেও, মুক্তির রামধনু ওড়ানোর চেষ্টা করলেও, সেটা যে আদতে মুশকিল, তা ভালোই জানে ‘সভ্য’ সমাজ। পিতৃতন্ত্রের রাজনীতি, এই শব্দবন্ধের আড়ালে অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারে ক্ষমতা ও শাসকের রাজনীতি। বিশেষ করে, এই বিশেষ ধর্মগুরুরা প্রায় প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট গোত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। গেরুয়া রঙের অর্থ ত্যাগ। অথচ ভোগসর্বস্ব দুনিয়ায় তার প্রয়োজন বোধহয় স্রেফ ‘ইমেজ মেনটেন’-এর জন্য। ‘পুরুষ নারী সমান সমান’ মন্ত্র হয়তো নিছক ট্যাগলাইনের মতোই ব্যবহার করবে সমাজ। তারপর বাড়ি থেকে বেরনোর পরই লালসায় ঠিকরে উঠবে চোখ। অবশ্য শাসকের ভূমিকাই বা কীরকম থাকতে পারে! থানের অনুষ্ঠানে বাবা রামদেব যখন তাঁর কথা বলছিলেন, গোটা মঞ্চ সেভাবে সাড়া দেয়নি। ব্যতিক্রম অম্রুতা ফড়নবিশ। মহিলাদের নিয়ে বলা অমন কথায়, রামদেবের পাশে বসেই হেসে উঠেছিলেন খোদ উপ মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী। পুরুষতন্ত্র ও তার ক্ষমতা এইভাবেই জিতে চায়, শাসকের প্রশ্রয়ে।

More Articles