কীভাবে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে তৈরি হলো গোটা রামায়ণ, কথাবার্তায় স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথের গান যদি ভারতের মানচিত্র হয়, তাহলে মায়া সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাসরা আমার কাছে টুকরো টুকরো রবীন্দ্রনাথ।

বাইশে শ্রাবণ বলতে রবীন্দ্রনাথের কোনও বিশেষ গান মনে পড়ে?

স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত: জীবন তো বদলায়, ফলে ভাবনাও বদলায়। তেমনই বদলে বদলে গেছে এই ধারণাটাও। বিশেষ করে বদলেছে, যখন 'গীতবিতান'-এর সব গান গাইলাম। তখন ওঁর গান নিয়ে 'বিশেষ' ব্যাপারটাই চলে গেল। 'গীতবিতান' সামগ্রিক হয়ে ধরা দিল। তবু যদি পুরনো অন্তরাত্মার কাছে জানতে চাই, তবে বলব, 'তবু মনে রেখো, যদি দূরে যাই চলে'। কারণ, এই গানটা মায়াদি, মায়া সেন গেয়েছেন, সুচিত্রাদি (মিত্র) গেয়েছেন, গীতা ঘটকের আছে, শান্তিদেব ঘোষের আছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠে এই গানটা আমার কাছে অন্য মাত্রায় ধরা দেয়, মনে হয়, আমার কাছের কেউ, আমার আত্মজন গাইছেন।

আপনি 'একলা গীতবিতান'-এর কথা বললেন, 'গীতবিতান'-এর সব গান গেয়েছেন। এর গুরুত্ব কি সকলে বুঝলেন? শ্রোতাদের বড় অংশ এখনও কিছু গানই শোনেন ঘুরিয়েফিরিয়ে।

স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত: গুরুত্ব হয়তো অনেকেই বোঝেননি, যে-জন্য একটি বড় হাউজের অ্যাওয়ার্ড সেরেমনিতে আমাকে দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, ওই যে একলা গীতবিতান আসছেন। এতে খুব খুশি হতে পারিনি, বলাই বাহুল্য। আর শোনার কথা যদি বলি, ২১০০ গানের মধ্যে কেউ দুশো গানের রবীন্দ্রনাথকে চেনেন, কেউ চেনেন চারশো গানের রবীন্দ্রনাথকে। আমি চেষ্টা করি যতটা সম্ভব অশ্রুত গান গাওয়ার, কিন্তু তা করতে গিয়ে আমি শ্রোতাদের কাছে কিছুটা অপ্রিয়ও হই। নির্ভর করে, কেমন শ্রোতাকে শোনাচ্ছি। শিক্ষিত শ্রোতার ওপরেও সবটা নির্ভর করে না। ততটা পুঁথিগত শিক্ষা নেই, কিন্তু পাগলের মতো রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন, এমনও তো অনেককে দেখেছি। যেমন বালুরঘাটের একটি ছেলের কথা বলি, বিশ্বজিৎ মালি। সে আমার গানের একটা মিউজিয়াম করে ফেলেছে প্রায়, অথচ সে তথাকথিত 'শিক্ষিত' নয়। পাগলামি বা মুগ্ধতাটাই আসল। শ্রোতারা আগের চেয়ে কিছুটা পালটেও গেছেন।

মায়া সেনের কাছে গান শিখেছেন আপনি। এছাড়াও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্ররা কি আপনার ওপর কোনও সচেতন প্রভাব রেখেছেন?

স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত: একশোবার। রবীন্দ্রনাথের গান যদি ভারতের মানচিত্র হয়, তাহলে এঁরা সকলেই টুকরো টুকরো রবীন্দ্রনাথ। এঁদের প্রত্যেকের ছায়া রয়েছে আমার মধ্যে। আমি শিখেছি মায়াদির কাছে। আবার জীবনের একটা সময় কেউ কেউ বলতেন, সুচিত্রা মিত্রর সঙ্গে আমার অনেক মিল। কেউ জিজ্ঞেস করতেন, টপ্পাটা কি মোহরদিকে (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) নকল করো? রবীন্দ্রনাথের গানের প্রেমেই পড়লাম দেবব্রত বিশ্বাস শুনে, আমি ছোটবেলায় ভাবতাম ওঁরই লেখা গান, 'পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল', নিজে না লিখলে ওইভাবে গাওয়া যায়? বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম শৈশবের খেয়ালে, এই গানগুলো কি ওঁর নিজের লেখা, বাবা ভুল ভাঙিয়ে দিতেন। শান্তিদেব ঘোষ, পূরবী মুখোপাধ্যায়, সুবিনয় রায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সাগর সেন- এঁদের কাউকে তো বাদ দিতে পারিনি। এঁরা মানচিত্রের মতো, কন্যাকুমারীর জায়গায় মোহরদি, কাশ্মীরে হয়তো সুবিনয় রায়। যাঁদের নাম করছি না, তাঁরাও কিন্তু আছেন।

Rabindrasangeet singers

গ্রাফিক্স: দীপ হাওলাদার। ছবিতে (বাঁদিক থেকে) মায়া সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র ও দেবব্রত বিশ্বাস

একটা ঘটনা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন, তখন এমএ ফার্স্ট ইয়ার সম্ভবত, গিয়েছি শান্তিনিকেতনে। নীলিমা সেন তখন বিভাগীয় প্রধান বিশ্বভারতী-তে। নীলিমা সেন মায়াদিকে ফোন করলেন, বললেন, "স্বাগতালক্ষ্মী নামে একটি মেয়ে এসেছে। ছোট ছোট চুল, রোগাপাতলা, সে খুবই দুষ্টু।" মায়াদি বললেন, "কেন?" নীলামাদি উত্তর দিলেন, "আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছি, ওঁদের ঘরে জলসা হচ্ছে। হিল চটি দিয়ে খোল বাজানো হচ্ছে। সেখানে সুচিত্রাদি থেকে শুরু করে সকলকে নকল করে দেখাচ্ছে মেয়েটি।" মায়াদি বললেন, "আমাকেও?" নীলিমাদি বললেন, "হ্যাঁ। তবে আমাকে কেন জানি না ক্ষমা করে দিয়েছে। আমাকে নকল করেনি।" ওই দুষ্টুমিটাই প্রমাণপত্র, আমার গানে এরা সকলে আছেন, এখন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো। বাচ্চা যেমন সবাইকে ধারণ করে বড় হতে হতে বুড়ো হয়ে নিজের মতো চেহারা নেয়, তেমনটাই...

এখন যাঁরা গাইছেন, তাঁদের মধ্যে সেই নিবেদন খুঁজে পান? মনে হয়, এখন কেউ রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন?

স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত: আমি ইউটিউবে গান শুনি অনেকেরই। যেমন সাহানা বাজপেয়ীর গান শুনে খুব ভাল লেগেছে। বলেওছি সেকথা। ও আপ্লুত। অখ্যাত, অনামী শিল্পীর গান শুনে ভাল লাগলে তাও বলি। আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও অনেকে ভাল গায়, যাঁদের চিনি না, তাঁদের অনেকের গান শুনে অবাক হয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথের গানকে তাঁরা পেশা করবেন কি না, তা নির্ভর করছে সময়ের ওপর। শ্রোতাদের চাহিদা তৈরি করতে হবে। আমার সময়টায় ভাল গাইলেই মানুষের কাছে পৌঁছনো সহজ ছিল। এখন অনেক জটিলতা বেড়েছে। রবীন্দ্রসংগীতের চাহিদা তৈরির জন্য এমন অনেককিছু করতে হয় এই প্রজন্মকে, যা পুরোপুরি মেনে নিতে পারি না।

শেষ যে প্রশ্নটা করতে চাই, রবীন্দ্রনাথের গান জীবনের প্রতিটি ক্ষণে আজও কতটা সঙ্গ দেয় আপনাকে? অনুভবে কতটা ধরা দেয় তা?

স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত: রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে সবসময়ই সমাধান। এই যে পুরো রবীন্দ্রনাথ গাইতে পারা, এটা তো ওঁর আশীর্বাদ না থাকলে হতো না। 'পুরো রবীন্দ্রনাথ' যদি মহাভারত হয়, তাহলে তার আগে রয়েছে রামায়ণ। হঠাৎ এক ছাত্রী বলল, যে কোনও গান বের করে দিলে শেখাতে পারবে? বুঝলাম, আমার পরীক্ষা নিচ্ছে। একটা গান বেরল খুঁজে, 'ফুরোল ফুরোল পরীক্ষার এই পালা/ পার হয়েছি অগ্নিদহন জ্বালা/ মা গো মা, তোমার কোলে উজাড় করে দেব অপমানের ডালা'। আমার মনে হলো, এটা তো কোনও উদ্বোধনী স‌ংগীত নয়, এটা একটা চরিত্রের গান। ভাবতে ভাবতে বুঝলাম, এটা তো সীতা। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে তৈরি করলাম রামায়ণ। একে কী বলব, অলৌকিক? মহাকাল? ওই যে ছাত্রীটি 'অচেনা গান শেখাও' বলল, আমার নিজেরও শেখা হলো ওদের শেখাতে গিয়ে। ওরা শিখে বাড়ি চলে গেল। একটা নতুন সৃষ্টি হলো। শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, পুরো গীতবিতানটা তুমি কুলিগিরি করেছ, কণ্ঠে নিয়েছ। ওটা তো তোমার আবিষ্কার নয়, ধৈর্য এবং শ্রম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের একচল্লিশটা গান নিয়ে সম্পূর্ণ রামায়ণ তো তোমার আবিষ্কার। তারপর মা চলে যাওয়ার পর একশোটার ওপর রবীন্দ্রনাথের গান ট্রান্সক্রিয়েট করলাম ইংরেজিতে, 'গ্যালাক্সি' নামে সেই বই বেরোল, আদর করে তা নিয়ে গেছেন অমর্ত্য সেন, মরিশাসের ভাইস প্রেসিডেন্ট খোঁজ করে কিনে নিয়ে গেলেন। মা চলে গেল বলেই সেটা হলো। এছাড়া ভগবদগীতার সঙ্গে মিশিয়েছি রবীন্দ্রনাথের গান। 'অশোকরেণু', আমাদের প্রতিষ্ঠানের তেইশ বছর বয়স হলো। প্রতি বছর নানা ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ এসেছেন সেখানে। কাজেই আমার জীবনটা জুড়েই রবীন্দ্রনাথ। জীবনের প্রতি ক্ষণে, সমস্যায় সমাধানে রবীন্দ্রনাথ।

book cover

'গ্যালাক্সি' বইটির প্রচ্ছদ

বাবা ছিলেন পিওর ক্লাসিক্যালের, মা আবার ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্রী, দাদা আবার ছিলেন পাশ্চাত্য সংগীতের এক্সপার্ট। আমি নানা রকম সংগীত জেনেছি বলেই রবীন্দ্রনাথের গান দেহ, আত্মা নিয়ে ধরা দিয়েছে আমার কাছে‌। যদুভট্ট থেকে রবার্ট বার্নস, রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাশ ঘাট ঘুরেছেন বলে আমারও সুবিধে হয়েছে ওঁকে কণ্ঠে নিতে, ধারণ করতে।

আর একটা কথা বলি, লকডাউনে দূরত্ব বাড়ছিল ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, সেসময় আমি ইউটিউব আবিষ্কার করি। 'ওহে দয়াময় নিখিল আশ্রয়' দিয়ে শুরু, তারপর থেকে ৮৫৬ দিনে ৮৫৬টি গান তৈরি করেছি। তার মধ্যে বেশিরভাগ রবীন্দ্রনাথের গান। সরোজ খান মারা যাওয়ার পর যেমন মাধুরী দীক্ষিত আর সরোজ খানের নাচের নানা ক্লিপ জুড়ে নেপথ্যে গাইলাম, 'মম চিত্তে নিতি নৃত্যে'। এই কাজগুলো থেকে গেল ইউটিউবে।

ফলে, বাইশে শ্রাবণ আসে, কিন্তু আসলে তো প্রতিটি দিনই ওঁর জন্মদিন। আমরাও জন্মাচ্ছি ওঁর সঙ্গে।

More Articles