বাংলার একপেশে রাজনীতি বিজেপিকে জায়গা করে দিল । মুখোমুখি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
Dipankar Bhattacharya Interview: সারা দেশে সাতটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে লড়ছে সিপিআইএমএল। বলছে, বিজেপি বিরোধী যে কোনও শক্তিকেই ভোট দিতে। তার জন্য জুটছে পাল্টা ট্রোলিংও! বিজেপি বিরোধিতায় কতটা শক্তিশালী সিপিআই(এমএল) লিবারেশন,...
ইস্তেহার প্রকাশ উপলক্ষ্যে সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। সারা দেশে সাতটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে লড়ছে তাঁর দল। পাশাপাশি ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেও লড়বে লিবারেশন। ফলে দম ফেলার জো নেই তাঁর। প্রবল ব্যস্ততার মাঝেই দগ্ধ দিনে দলীয় কার্যালয়ে কথা বললেন ইনস্ক্রিপ্ট সম্পাদক অর্ক দেবের সঙ্গে। বাংলা-বিহার-অন্ধ্র মায় গোটা ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্র উঠে এল কথায় কথায়।
অর্ক: দলীয় ইস্তেহারে নরেন্দ্র মোদির জমানাকে আপনারা একনায়কতন্ত্র বলছেন। এই সময়তট ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থার দিনগুলির চেয়েও খারাপ?
দীপঙ্কর: হ্যাঁ অবশ্যই খারাপ। লোকে এই তুলনা করে কারণ ভারতবর্ষে স্বৈরতন্ত্রের অভিজ্ঞতা বলতে ওই একটাই ছিল। সেখান থেকে একটা কথা বলা হতো, ওটা ঘোষিত জরুরি অবস্থা, এটা অঘোষিত জরুরি অবস্থা। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে এটা স্থায়ী, অন্তহীন জরুরি অবস্থা। এটাই যেন শাসনের স্বাভাবিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সময়ে লড়াইটা রাষ্ট্র বনাম নাগরিক ছিল। এখানে শুধু রাষ্ট্রই নয়, গণতন্ত্রে যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা উচিত, তা যেমন নেই, তেমনই সমাজে আরএসএস-এর চিন্তাভাবনা ঢুকে পড়ে পরিবেশটাকে তিক্ত করে তুলছে, সমাজটাকে কলুষিত করছে। সমাজে এভাবে রাষ্ট্রের সমান্তরাল ও পরিপূরক বাহিনীর বাড়বাড়ন্ত জরুরি অবস্থার সময়েও ছিল না।
অর্ক: আপনারা ইস্তেহারে জিডিপি-র দশ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ করার কথা বলেছেন। কিন্তু ইস্তেহারে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিশদে উল্লেখ করা নেই কেন?
দীপঙ্কর: দেখুন, আমরা খুব সংক্ষেপে বলেছি। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা - এই দুয়ের ক্ষেত্রেই দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। নাহলে মানুষ আর পারবে না। প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্র সরকার আর রাজ্য সরকারগুলি বিমা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। আমরা এটা চাই না। এটা মার্কিন পদ্ধতি। আমরা চাই পরিকাঠামোগত পরিবর্তন। একদম বুনিয়াদি স্তরে পরিবর্তন। গ্রামের হেলথ সেন্টারগুলিকে কার্যকরী করে তোলা হোক।
আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধির সঙ্গে দু’ দশ মিনিট
অর্ক: ইলেক্টরাল বন্ডের তথ্য সামনে আসার পর দেখছি সিপলা, জাইডাস ক্যাডিলার মতো সংস্থা বন্ডে টাকা দিয়ে নানা সুবিধে পেয়েছে। বারবার গুণমানের পরীক্ষায় ফেল করা সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জনস্বাস্থ্য নিয়ে ছেলেখেলার এমন উদাহরণ সারা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। বিরোধীদের ইস্তেহারে এই বিষয়টা বিশদে থাকা উচিত ছিল না?
দীপঙ্কর: বন্ডের তথ্য একেবারে নির্বাচনের মুখে সামনে এল। টেলিকম, ইঞ্জিনিয়রিং, ফার্মা- অনেক সংস্থাই জড়িয়ে। সত্যিই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। চাঁদার বিনিময়ে দুর্নীতির ছাড়পত্র।
অর্ক: বাংলা-বিহার-উত্তরপ্রদেশ এই তিন রাজ্যে ডেলিভারি শ্রমিক সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ অভাব-অভিযোগ, দুর্ঘটনাও অন্যান্য রাজ্যের থেকে বেশি। আপনারা ডেলিভারি শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে কী ভাবছেন? ইস্তেহারে এদের কথা উল্লেখ আছে?
দীপঙ্কর: রাজস্থানে প্রাথমিক আইন তৈরির চেষ্টা করেছিল কংগ্রেস। যেখানে নিরাপত্তা নেই, সামাজিক অপমান অনেক, সাম্প্রদায়িকতাও জড়িয়ে আছে-এমন সমস্ত ধরনের নতুন শ্রমের জন্য ব্যাপক আইনি রদবদল জরুরি। ডেলিভারি শ্রমিকরা এ যুগের রানার। কম বয়সে এরা সর্বশক্তি দিয়ে ছুটছে। কয়েক বছর পরে শরীর ভাঙবে। এদের জন্যে আর কোনও কাজ থাকবে না। চরম শোষণ এটা। ম্যানিফেস্টোতে অতিকথন বাদ দিতে চেয়েছি। আমরা মূল কথাগুলিকে ধরতে চেয়েছি। যেমন ধরুন, আমরা ওপিএস-এর কথা (পুরনো পেনশন স্কিম) রেখেছি। এটা কংগ্রেসের ইস্তেহারে নেই। আমরা ব্যালটের প্রশ্ন এনেছি।
অর্ক: ব্যালট এলে তো আবার ছাপ্পা ভোট ফিরে আসবে?
দীপঙ্কর: ইভিএম-এও ছাপ্পা আছে। ইভিএম-এর দুর্নীতিটা শুধুই মেশিন সংক্রান্ত নয়। ঠিক আগের মতোই বুথ কব্জা হয়। সেই বুথগুলো টার্গেট করা হয় যেখানে অন্যদলের প্রতিনিধিত্ব দুর্বল বা কম। কেন্দ্রীয় সুরক্ষাবলের সহযোগিতায় ছাপ্পা ভোট চলে। আমরা রিপোর্ট পাই। ফলে কাগজ হলেই ছাপ্পা ভোট হবে এই ধারণা ভুল।
অর্ক: ইভিএম-এর সঙ্গে মিলিয়ে ভিভিপ্যাটে পুরোটা গোনা হলে কারচুপি এড়ানো সম্ভব?
দীপঙ্কর: ভিভিপ্যাট কেন আনা হলো? ইভিএমে ট্রান্সপারেন্সি আনার জন্যই তো? এর নামই ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার। এখন ভোটারই যদি ভেরিফাই করার সুযোগ না পান, তাহলে মানে কী দাঁড়াল? কেন পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হলো? আমরা বলেছি, এই স্লিপ গোনাই আপাতত ব্যালটের বিকল্প। এতে ইভিএম সংশয় অনেকটাই নিরসন হবে।
অর্ক: স্বাধীন সংবাদমাধ্যম কি ভোটের ইস্যু নয়? আমাদের প্রতিনিয়ত আইনি লড়াই লড়তে হয়। ছোট সংস্থার কালঘাম ছুটে যায়। স্বাধীনতার প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির সঙ্গে আমাদের তো একটা সমানুভূতির সম্পর্ক থাকার কথা। আমরা তো প্রত্যাশা করি আইনি ঝক্কি হলে রাজনৈতিক দলগুলি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। এতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাবে।
দীপঙ্কর: মিডিয়ার বিষয়টা সত্যিই ভাবার। আজ তো ছোট মিডিয়াই কর্পোরেট পরিচালিত মিডিয়ার একমাত্র বিকল্প। আমরা কিন্তু একযোগে ব্রডকাস্ট বিলের বিরোধিতা করেছি। এই যে বিভিন্ন মিডিয়া হাউজে তল্লাশি, সোর্স বলার জন্য চাপ দেওয়া, তাকে পঙ্গু করে দেওয়া- এই সক্রিয়তার বিরোধিতা করেছি। মোদি সরকার ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুখিয়ে আছে। আমরা হয়তো ইস্তেহারে এ নিয়ে বলিনি কিন্তু আমাদের চিন্তার মধ্যে আছে। রাইট টু ইনফরমেশন বলছি, অথচ সহজলভ্য তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না, এটা আটকাতে স্থানীয় মিডিয়ার শক্তি বাড়াতে হবে।
অর্ক: প্রশান্ত কিশোর নির্বাচনের মুখে ফের গণৎকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই মুহূর্তে পিকে বিহারে কীভাবে কতটা সক্রিয়?
দীপঙ্কর: প্রশান্ত কিশোরের আকস্মিক আবির্ভাবে আমি একটু বিস্মিত। কারণ ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের পরে তিনি সবাইকে বলেছিলে, এই কাজটা অনেকদিন করলাম। আমি আর এই কাজটা করতে চাই না। আমি এবার সরাসরি রাজনীতিতে আসব। অবশ্য তিনি এর আগেও সক্রিয় রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছেন। বছরখানেক ধরে প্রশান্ত কিশোর বিহারে যাত্রা করছেন। পার্টি গড়ার আগে তিনি সৎ কর্মী চিহ্নিত করতে চান। সৎ কর্মী চিহ্নিত করার এই যাত্রা তো অতীব ব্যয়বহুল। এক সাক্ষাৎকারপ্রার্থী ওঁকে জিজ্ঞেস করছেন, খরচ কে দিচ্ছে? প্রশান্ত কিশোর বলছেন, যাদের হয়ে আগে কাজ করেছি তারাই দিচ্ছে। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করেন, তাহলে কি কোনও সরকার দিচ্ছে? প্রশান্ত কিশোর বলেন, না সরকার নয়। বিভিন্ন মানুষ যারা উপকৃত হয়েছেন তারাই দিচ্ছেন। ইশারাটা অনেকটা ইলেক্টোরাল বন্ডে টাকা এবং সুবিধে দেওয়া-নেওয়ার মতো। ফলে এ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। দ্বিতীয়ত, তিনি সাধারণ মানুষের সামনে কিছু কিছু প্রশ্ন তুলছেন কিন্তু শুরুতে তাঁর টার্গেট ছিল আরজেডি। বিজেপিকে তিনি আড়াল করছিলেন। পরবর্তীতে নীতীশের ভাবমূর্তি যখন ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তখন নীতীশ তাঁর প্রথম টার্গেট। আরজেডি দ্বিতীয়। আমাদের সম্পর্কেও তিনি নানা মন্তব্য করেন। কেন্দ্রীয় সরকারি নীতিগুলি নিয়ে, কেন্দ্রের বড় সমস্যাগুলি নিয়ে তিনি কিছু বলেন না। প্রশান্ত কিশোর একটা গান্ধির ছবি নিয়ে চলেন। কথা শুনলে মনে হবে তিনি কংগ্রেসের পুনরুত্থানের চেষ্টা করছেন কিন্তু কংগ্রেস এ কাজটায় তো নিজেই হাত লাগিয়েছে। বিহারে তিনি হয়তো ২০৩০ মাথায় রেখে এগোচ্ছেন। সেখানে, হঠাৎ নিজের ব্র্যান্ডভ্যালুকে এভাবে কাজে লাগালেন, দেখে খটকাই লাগছে।
অর্ক: প্রশান্ত কিশোরের কথা মানলে বাংলায় বিজেপি কুড়িটার বেশি আসন পাবে। নিজের ইমেজ বাজি লাগাচ্ছেন। কীভাবে এই দাবি করছেন?
দীপঙ্কর: যেভাবে বিজেপি 'চারশো পার' বলছে সেভাবেই। প্রণয় রায় বলতেন, দশ বছর ধরে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তার ফেরা খুব কঠিন। সেখানে এই ৪০০ পারের দাবি, এমনকী ৩০০ পারও খুব অলীক।
অর্ক: ২০১৯ বিহারের ফল হয়েছিল ৩৯-১। তারপর নানা পালাবদল দেখেছি বিহারে। নীতীশের দু'বারের দলপাল্টি দেখেছি। এই মুহূর্তে বিহারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন? হাওয়া কার অনুকূলে?
দীপঙ্কর: ২০১৯ নির্বাচনে, ২০২০ নির্বাচনে নীতীশ ওদিকেই ছিলেন। এনডিএ-র সমীকরণে বিরাট পার্থক্য হয়নি। লোক জনশক্তি পার্টি জেডিইউ-এর বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছিল। এখন দুটো ব্যাপার হয়েছে। এই নির্বাচনে বিজেপি জেডিইউ-কে বাদ দিয়ে অসহায়। এই কাঁধটা তাদের দরকার। দ্বিতীয় এবং বড় কারণ, গত সতেরো মাস জেডিউউ-আরজেডি-কংগ্রেস সরকার চলছিল। আমরা বাইরে থেকে সমর্থন করছিলাম। এই সময়ে বিহার থেকে অল্টারনেটিভ এজেন্ডা উঠে এসেছে। কাস্ট সেনসাসে সমাজে ছবিটা উঠে এসেছে। আবার সমাজ অর্থনীতির সমীক্ষায় দেখা গেল বিহারের বহু জায়গায় মহাদারিদ্র। চাকরি নিয়ে কথা শুরু হলো। পাঁচ লক্ষ পাকা চাকরির বন্দোবস্ত হলো। এই যে এজেন্ডা বদল, এতে একটা রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হচ্ছিল। সোশ্যালিস্ট- কমিউনিস্ট-কংগ্রেস ঐক্য দেখা যাচ্ছিল। ভারতবর্ষে এই ব্যবস্থা প্রয়োজনীয়। এই কারণেই বিজেপি উঠেপড়ে লাগল। নতুন করে নীতীশ কুমারকে সঙ্গে নিল। কিন্তু এতে বিহারের রাজনীতিতে খুব বড় প্রভাব পড়েনি। ১৮ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন নীতীশ। ২০১৪ থেকে তথাকথিত ডবল ইঞ্জিন সরকার আছে। তাতে মানুষের তিক্ততার ছবি ২০২০-তে দেখা গিয়েছে। এখন আমার ধারণা, আমরা আর ২০১৯-এ ফিরে যাব না। ২০২০-র পরিসংখ্যান থেকেই এগোব।
অর্ক: বিহারে জোটে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আপনার দল খুশি?
দীপঙ্কর: এবারে আমাদের জোটে আসন ভাগাভাগি খুব ন্যায়সঙ্গতভাবে হয়নি। কংগ্রেসের ১৯ জন বিধায়ক, দু'জন দলত্যাগ করেছে ওরা ন'টা আসনে লড়বে। আমাদের ১২ জন বিধায়ক, আমরা পেলাম মাত্র তিনটে আসন। সিপিআই এবং সিপিআইএম-এর দু'জন করে বিধায়ক। তারা একটা করে আসনে লড়ছে। তবে আমরা আপাতত এ নিয়ে কিছু বলতে চাই না। ভোটের পর দেখা যাবে।
অর্ক: তিনটি আসন মানে আরা, কারাকাট, নালন্দায় আপনাদের সাংগঠনিক শক্তি কেমন?
দীপঙ্কর: আরা চিরকালই আমাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। কারাকাটে আমাদের বিধায়ক আছেন। নালন্দায় বিধায়ক নেই কিন্তু আমাদের প্রথম বিধায়ক এসেছিলেন নালন্দা থেকেই। জেলা জুড়ে সংগঠন আছে। আমাদের শক্তি এবং জোটের প্রভাব, আজকের পরিস্থিতি- এই তিনটের যোগফল কাজ করবে। নালন্দায় সিট ১৯৯১-কমিউনিস্টরা জিতেছিল। ১৯৯৬ থেকে ওই সিটটা জেডিইউ-এর হাতে ছিল। ২০০৪-এ নীতীশ এই আসন জেতেন। ২০০৯ থেকে জিতে আসছে বর্তমান সাংসদ। নালন্দায় মানুষ একদলীয় ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। বিহারের আরা আর ঝাড়খণ্ডের কোডার্মায় আমরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়ছি। কারাকাট কৃষক অধ্যুষিত এলাকা, সংকটের মুখে আছে।
অর্ক: দক্ষিণ ভারতেও ঢুকতে চাইছেন আপনারা। নরেন্দ্র মোদির দলও দক্ষিণ ভারত নিয়ে আশায় বুক বাঁধছে। কী মনে হয়, দক্ষিণ ভারতে বিজেপি কেমন ফল করবে?
দীপঙ্কর: আমার মনে হয় দক্ষিণ ভারতে বিজেপির ভোট শতাংশ বাড়তে পারে। কারণ এডিএমকে ভেঙে গিয়েছে। তার একটা বড় অংশ বিজেপিতে গিয়েছে। আর বিজেপির লাগাতার চেষ্টা আছে। সামাজিক ন্যায়ের যে কথাগুলি আমরা বলি তার শিকড় তামিলনাড়ুতে, কেরলে অনেক গভীরে। উত্তর ভারতের মতো ন্যায়ের সঙ্গে সমাজের দূরত্ব নেই। ফলে বিজেপি বিরাট চেষ্টা সত্ত্বেও, আরএসএস-এর নেটওয়ার্ক থাকা সত্ত্বেও কেরলে নির্বাচনী সাফল্য পায় না। আবার এই সামাজিক ন্যায়ের কারণে উচ্চবর্ণের একটা মার আছে তো। বিজেপি এই উচ্চবর্ণের হাতিয়ার। সেই কারণেই সংসদ ভবনের উদ্বোধনে সেঙ্গলটা নিয়ে এল। কর্ণাটকে হনুমানের জন্মভূমির কথা বলছে। তবে আসনের ক্ষেত্রে বিজেপি খুব বড় কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। একমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশে টিডিপি-বিজেপি জোটটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কারণ ওয়াইএসআর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের রাগ আছে। কর্ণাটকে বিজেপির যে ক্ষতি হবে সেটা ওরা অন্ধ্র থেকে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
অর্ক: রাফালের মতো ইস্যু সামনে এনে কোনও কাজের কাজ হয়নি। মানুষ কি ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো বিষয়গুলিকে নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে নেবে? কীভাবে বোঝাচ্ছেন মানুষকে?
দীপঙ্কর: এক্ষেত্রে বোঝাপড়ার উপাদান বেশি। ইলেক্টোরাল বন্ডের সত্য প্রকাশ হয়েছে আদালতে। দেরিতে হলেও সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে বন্ডকে অসাংবিধানিক বলেছে। এটা মনে হয় মানুষকে ভাবতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, যে তথ্যগুলি সামনে এসেছে সেগুলিও মানুষ মনে রাখবে। বিজেপির ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাটাও তো খুব বড়, সেটা আড়াল করা যাচ্ছে না। স্টেটব্যাঙ্কে সরকারি উকিল বলছেন, বন্ড বিষয়ক তথ্য জনগণের জানার অধিকার নেই। আর মোদি এখন তার ক্রেডিট নেওয়ার চেষ্টা করছেন! এসবিআই বলল ৩০ জুন পর্যন্ত সময় লাগবে তথ্য দিতে। সুপ্রিম কোর্টের ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে তালিকা দিয়ে দিল। যেটুকু তথ্য এসছে তা-ই অনেক। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, মানুষের জানার আকাঙ্খা বিরাট। এই কারণে রবীশ কুমার, ধ্রুব রাঠির ভিডিও এত মানুষ প্রবলভাবে দেখে। বিজনেস লাইন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাদ দিলে এই খবর তো প্রিন্ট মিডিয়াগুলিতেও সেভাবে সামনে আসে না। বিজেপি এখন বোঝাতে চাইছে, সাংসদদের মাথাপিছু পাওনা টাকা হিসেব করতে। এবং তারপরেই বলছে, বিআরএস, তৃণমূলের এমপির তুলনায় ওরা কম টাকা পেয়েছে। তবে এভাবে কিছু আড়াল করা যাবে না। বন্ড একটা দুর্নীতি নয়, বলা যায় দুর্নীতি তন্ত্র।
আমরা কর্মীদের বলেছি ঘরে ঘরে কুড়ি টাকার কুপন কাটো। মানুষকে বোঝাও রাজনীতি যদি কর্পোরেটের পয়সায় চলে তবে যে নীতি তৈরি হবে তা কর্পোরেটমুখীই হবে। আর যদি চাই জনগণের অংশগ্রহণ থাক, স্ৰেফ ভোটের নয় নোটের মাধ্যমেও, তাকে যদি প্রত্যক্ষ শরিক করা যায়, তবে হবে ব্যবস্থার পরিবর্তন। ভোটের সময় জনতাকে স্রেফ গ্রহীতা দেখিয়ে তার রাজনৈতিক চেতনাকে অপমান করা হয়। এর বিরুদ্ধে আমরা এই পরিকল্পনা করেছি। কর্পোরেটের দখলদারি মুক্ত কৃষি-শিল্প-চাকরি যদি সুনিশ্চিত করতে হয় তাহলে রাজনীতিতে দখল বাড়াতে হবে। যদি দখল বাড়াতে হয় তবে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
অর্ক: কেমন সা়ড়া পাচ্ছেন?
দীপঙ্কর: বিরাট সাড়া পাচ্ছি। 'কর্পোরেটের বন্ড বনাম খেটেখাওয়া মানুষের কুপন', এই শিরোনামের খবর পড়ে মানুষ বলছে আমরাও এদের টাকা দিতে চাই। অফলাইন-অনলাইন দুই ব্যবস্থাই চালু হয়েছে। প্রথম দিনেই পঁচিশ হাজার টাকা উঠে এসেছে। আমাদের মতো ছোট পার্টির জন্য তো এ ঘটনা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।
অর্ক: স্রেফ সিপিএম নয়, যে কোনও বিজেপি বিরোধী শক্তিকে ভোট দিতে বলায় সিপিএম সমর্থকদের একাংশ আবার ট্রোল করছে আপনাকে। কীভাবে সামলাচ্ছেন?
দীপঙ্কর: পেশাগত ঝামেলা বলা যায় আর কী। কিন্তু যে কথাটা বেশি করে মনে হয়, রাজনীতিটা এত চটুল জায়গায় চলে গিয়েছে এখানে, সেটা বোধহয় ঠিক নয়। সিপিএম বলছে বিজেপি-তৃণমূল এক। আমরা বলছি, এক করে দেখা ঠিক নয়। এই মুহূর্তে বিজেপির সঙ্গে কোনও দলের তুলনা চলে না। দিল্লির সিপিএম এক কথাই বলছে। ধরে নিলাম রাজ্যের বাস্তব অবস্থায় দাঁড়িয়ে ওরা এমন বলছে, কিন্তু মতের অমিল হলে এরাই আমাদের ট্রোল করে চরম আনন্দ পাচ্ছে। আমরা তো পশ্চিমবঙ্গে খুবই সীমিত শক্তি নিয়ে আছি, আমাদের ট্রোল করতে হবে কেন? এটা করে সিপিএম বুঝিয়ে দিচ্ছে কোথায় চলে গিয়েছে ওরা।
আরও পড়ুন- ভোটে হারার ভয়েই কর সন্ত্রাস? ভয়াবহ অভিযোগ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে
অর্ক: পূর্ব বর্ধমানে বিজেপি প্রার্থী পাচ্ছিল না, অসীম সরকারকে তুলে আনতে হলো। তৃণমূলের প্রার্থী শর্মিলা সরকারও আনকোরা। আপনারা এই আসনটাই বেছে নিলেন কেন?
দীপঙ্কর: বাংলায় তিনটে, চারটে, কখনও পাঁচটা আসনেও লড়েছি। তার মধ্যে বর্ধমান সব সময়েই আমাদের কাজের জায়গা। আমাদের নেতা সজল দে যুবদের আন্দোলনের পরিচিত মুখ। সেই কারণেই ওঁকে সামনে রেখে লড়ব।
অর্ক: ২০২৬-এ বাংলায় সর্বশক্তি দিয়ে লড়বেন? আমাদের রাজ্য রাজনীতিতে একটা ফাঁকপূরণ দরকার।
দীপঙ্কর: লড়ব। তৃণমূল ২০২১-এ তৃতীয়বার ক্ষমতায় এল, তাদের বিরুদ্ধে মানুষের প্রবল ক্ষোভ রয়েছে। গণতন্ত্রে নানামাত্রায় আক্রমণ নেমে আসছে। পঞ্চায়েতে ব্যাপক মারামারি হয়েছে। এটাই যদি চলতে থাকে, যদি বিকল্প না আসে, সমূহ বিপদ। বিজেপি এই সুযোগে ক্রমাগত বাড়ছে। মানুষের শুভবুদ্ধির উপর আমরা আশা করে রাখছি। কিন্তু মানুষকে আমরা বিকল্প রাজনৈতিক বিন্যাস দিতে পারছি কি? এখানে তো কেন্দ্রে বামপন্থীদেরই থাকার কথা। সিপিএম ক্ষমতায় ছিল। মানুষ তাদের সরাল বাধ্য হয়ে। এটা নিয়ে সিপিএম-এর কোনও আত্মসমালোচনা নেই। সেই কারণেই সিপিএম সম্পর্কে মানুষের ক্লান্তি বিরক্তি শেষ হয়ে যায়নি। ১৩ বছর ক্ষমতায় নেই দলটা, তবুও বড় অংশ এই প্রতিষ্ঠানটাকে পছন্দ করছে না। বারবার সিপিএম জোটসঙ্গী হাতড়ে বেড়াচ্ছে। এখানে যে একপেশে রাজনীতিটা হচ্ছে তা বিজেপির জন্য জায়গা খুলে দিচ্ছে। গোটা দেশে মানুষ এটাকে একটা অস্বাভাবিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন হিসেবে নিচ্ছে। আর বাংলায় এটা স্থানীয় নির্বাচনে পর্যবসিত হচ্ছে। গত দশ বছর বিজেপি এখান থেকে ফায়দা নিয়েছে। নাহলে এত রমরমা হয় না। লোকে ঠেকে শেখে, দেখে শেখে। সিপিএম-এ অনেক সৎ চিন্তাশীল সত্যিকারের মানুষ আছেন। তারা হয়তো ভেবে দেখবেন। এই মন্থন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন বিন্যাস নিয়ে আসবে।
অর্ক: সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহর ছাপ ভোটের ফলে পড়বে?
দীপঙ্কর: সন্দেশখালিতে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে (যে মাত্রাতেই ঘটে থাকুক না কেন) তৃণমূল ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বলপ্রয়োগ করেছে। আমাদের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম সেখানে যখন ঢুকতে চাইছিল, তাদের আটকেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যদি সেখানে যেতেন এতদূর জল গড়াত না। অনেকে বলার সুযোগ পেল: মোদি মণিপুর যাননি। মমতা সন্দেশখালি যাননি। শেষপর্যন্ত লোকগুলিকে গ্রেফতার তো করতেই হলো। তৃণমূল এই ঘটনায় খুব রক্ষণাত্মক ভাবে খেলেছে। এর ফল বিজেপি কিছুটা পাবে। শুধু বসিরহাটে নয়, গোটা দেশে বিজেপি এটার ফায়দা নিতে মরিয়া। এই সন্দেশখালিকে সামনে রেখে দিল্লিতে কুস্তিগীরদের সঙ্গে হওয়া ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা চলল, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নিগ্রহ আ়ড়াল করা হলো। বিজেপির মতো দলকে নারীমুক্তির প্রবক্তা হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া বড় ভুল। এখন মানুষের পরিমিতিবোধ, চেতনাই ভরসা। ভাবতে হবে, বিজেপি মতাদর্শগতভাবে মনুস্মৃতিকে সামনে রাখে যা ঘোষিত ভাবে নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধী, পরাধীনতার দলিল। দশবছরে বিজেপি যেমন দুর্নীতিগ্রস্তদের আস্কারা দিয়েছে, তেমনই ধর্ষকদের সুরক্ষা দিয়েছে বারবার। এমন দলের হাতে মহিলাদের সম্মানরক্ষার এজেন্ডা তুলে দেওয়া ভুল। এখন সন্দেশখালিকে ওরা নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর করতে পারবে পারবে কিনা তা সময় বলবে। তবে মানুষের অভিজ্ঞতা বেদনাদায়ক।