পদ্মা সেতুর পর কোটি মানুষের স্বপ্নপূরণ বঙ্গবন্ধু টানেলে, কতটা এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ?

পদ্মা সেতুর মতোই বঙ্গবন্ধু টানেলও দেশের যানচলাচলে গুরত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। সরকারি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় মানুষরা তাই ভীষণ আশাবাদী, এশিয়ার বৃহত্তম টানেল প্রকল্পকে ঘিরে।

গত বছরেই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল বাংলাদেশ। এই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাপকাঠি বহু উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। জুন মাসেই বাংলাদেশের মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে উদ্বোধন হয়েছে পদ্মা সেতুর। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পর এবার কয়েক মাসের মধ্যেই চালু হতে চলেছে বঙ্গবন্ধু টানেল। নতুন এই টানেলও বাংলাদেশের উন্নয়নের গাড়িতে নতুন রসদ জোগাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর মতোই বঙ্গবন্ধু টানেলও দেশের যানচলাচলে গুরত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। সরকারি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় মানুষরা তাই ভীষণ আশাবাদী, এশিয়ার বৃহত্তম টানেল প্রকল্পকে ঘিরে।

২৬ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে পদ্মা নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম ছিল সদরঘাট টার্মিনালের লঞ্চ ও ফেরি। তাতে যাত্রাপথে সময়ও লাগত অনেক। কিন্তু স্বপ্নের পদ্মা সেতু সেই কষ্ট লাঘব করেছে। একই ধারায় কর্ণফুলি নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানলেও যাতায়াতের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে । চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্ন এই টানেলের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এই পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, দেশের সড়ক পরিবহণ এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, টানেলের প্রায় ৮৭ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী। ফলে মনে করা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়, অর্থাৎ চলতি বছরের ডিসেম্বরের আগেই খুলে যাবে বঙ্গবন্ধু টানেল।

বঙ্গবন্ধু টানেলের বিশেষত্ব
টানেলটি চট্টগ্রাম মহানগরী এবং নদীর দক্ষিণ তীরের আনোয়ারা উপজেলার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মসৃণ করে তুলবে। এর ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়া সম্ভব হবে। এই টানেলের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩.৩৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার। দু'টি টানেলে লেন থাকছে চারটি। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকছে। আনোয়ারা প্রান্তে থাকছে ৭২৭ মিটারের দীর্ঘ ফ্লাইওভার। প্রথম টানেল খননে সময় লেগেছে ১৭ মাস। দ্বিতীয়টি তৈরিতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ মাস। ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় তৈরি করা হয়েছে দু'টি টানেল। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত এবং ১৬ ফুট উচ্চতার। প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী জানিয়েছেন টানেলের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন ভেতরের লেন তৈরি-সহ বেশ কিছু টেকনিক্যাল কাজ বাকি রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করার প্রচেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুই নির্বাচনে বৈতরণী পার করাবে হাসিনাকে?

এর আগে পদ্মা সেতুর নির্মাণে ব্যয় নিয়ে বিরোধীরা আক্রমণ করছেন হাসিনা সরকারকে। কিন্তু এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যতিক্রম। শুরু থেকে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। সময় নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর। এই টানেল বাংলাদেশের এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে তৈরি প্রথম ও দীর্ঘতম টানেল।

টানেল নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির হাতে দেওয়া হয় এই টানেল নির্মাণের দায়িত্ব। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধু টানেলের ফলে কতখানি বদলাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি?
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের কারণে চট্টগ্রাম মহানগরী অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও কর্ণফুলির ওপারে আনোয়ারা অবহেলিত থেকে গেছে। সড়ক যোগাযোগ না থাকায় নদীর ওপারে বন্দর প্রসারিত হয়নি। এই টানেল চালু হলে কর্ণফুলির দক্ষিণ তীরে আনোয়ারা, বাঁশখালি, পটিয়া এবং চন্দনাইশ-সহ চট্টগ্রামের দক্ষিণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ পাড়ে নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং বন্দরের কাজকর্ম প্রসারিত হবে। মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত শিল্প করিডর গড়ে তোলা হবে। কর্ণফুলি নদীর দুই তীরে চিনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন গড়ে তুলতেই বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ সরকার।

টানেল রোডের পাশে আনোয়ারা অঞ্চলে নতুন ব্যবসা স্থাপনের জন্য শিল্পমালিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পিছিয়ে নেই স্থানীয় মানুষরাও। বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ, শপিং মলের মতো বিভিন্ন ব্যবসা গড়ে তুলতে চায় তাঁরাও। ব্যবসায়ীদের মতে, বঙ্গবন্ধু টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনীতি নয় দেশের অর্থনীতিতেও সার্বিক উন্নতি আনবে কারণ এর ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলার পাশাপাশি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলবে। ফলে বাংলাদেশের যোগাযোগ, বিনিয়োগ, পর্যটন এবং শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে চলেছে বঙ্গবন্ধু টানেলের হাত ধরে।

 

More Articles