রেহাই পায়নি কোলের শিশু, অন্তঃসত্ত্বা বধূও, এক ঘণ্টার 'অপারেশনেই' ঝাঁঝরা শেখ মুজিবের পরিবার
Assassination of Sheikh Mujibur Rahman : মাত্র এক ঘণ্টার অপারেশনে শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের অভিভাবক ও তাঁর পরিবারের জীবন।
সালটা ১৯৭৫। মাত্র কয়েক বছর আগেই পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। ’৪৭-এর দেশভাগের পর শুরু হয়েছিল সংগ্রাম। তারপর ঘটে গিয়েছে অজস্র নারকীয় ঘটনা, বাংলার মাটি ভেসে গিয়েছে তাজা রক্তে। সেই সংগ্রামের শেষেই স্বাধীন হয়েছে একটি দেশ। পুরনো নাম ঝেড়ে ফেলে নতুন নামেই হয়েছে সূর্যোদয় – বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসটা তাই অন্যান্য দিনের মতো হতেই পারত। ধানখেতে ঠিক যেভাবে হাওয়া দেয়, পাখি উড়ে যায় নীল আকাশের দিকে। রাখাল কিশোর গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজায়। এমন মনোরম ছবিই হতে পারত। কিন্তু তার রং বদলে গেল নিমেষে। রক্তের মতো লাল হয়ে উঠল ফ্রেমটা। দিনটা আরেকবার মনে করুন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট।
একটুখানি ফিরে যাওয়া যাক ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চে। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মানুষের ভিড়। ততদিনে জব্বর, রফিক, বরকতদের রক্ত দেখে নিয়েছে বাংলা। দেখে নিয়েছে অজস্র যুবক, মহিলা, তরুণ-তরুণীর মৃত্যু। দেখেছে পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকারদের নারকীয় হত্যালীলা, ধর্ষণ আর হাড়-মাংসের ছড়াছড়ি। এসবের থেকেই দেশকে মুক্তি দিতে হবে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র কয়েক মিনিটের বক্তব্য। তাতেই যেন আগুন জ্বলে উঠল ওপার বাংলায়। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম… এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” স্বাধীনতা – এই শব্দটা আবারও বাঙালির মনে গেঁথে গেল। বাকি গল্পটা এক অন্য ইতিহাস।
তার বেশ কয়েকবছর পরের ঘটনা। ততদিনে বাংলাদেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদে বসেছেন সেদিনের সেই বিপ্লবী, ব্যক্তিত্বময়ী বাঙালি নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না সরকারের। একবছর আগেই দেশে লেগেছে দুর্ভিক্ষ। তাছাড়াও সেনাদের ভেতরে বিভাজন যেন দিনকে দিন স্পষ্ট হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে মাথাচাড়া দিচ্ছে ইসলাম মৌলবাদ। সেইসঙ্গে আড়ালে আবডালে পাকিস্তানের ‘কলকাঠি নাড়ানো’ তো আছেই। সবই বুক চিতিয়ে সামলাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর লক্ষ্য, স্বপ্ন, বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে। নিজের বাসভবন থেকে তাই গণভবনে গিয়ে রাতদিন কাজ, তারপর বাড়ি ফিরে পরিবারকে সময় দেওয়া। এভাবেই চলছিল।
কিন্তু ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট কী যে হল তাঁর! মনটা কিছুতেই প্রফুল্ল নেই। কাজ শেষে গণভবনের বাগানে হাঁটাচলা করা, লেকের মাছেদের খাওয়ানো, গাছেদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলা – এসবই ছিল তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। কিন্তু ওইদিন যেন কিছুতেই মনটাকে বশ করতে পারছেন না। চঞ্চল হয়ে উঠছেন তিনি, বাড়ি যেতে হবে তাড়াতাড়ি। গাড়ি এল; সাদা নয়, বাড়ি থেকে বিশেষ একটি কালো রঙের গাড়ি তাঁকে নিতে এল। মনটা আরও ভেঙে গেল। কালো গাড়িতে যাবেন তিনি। কালো তো…! মনের মধ্যে কু ডাকছে কেন এত! সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সেই গাড়িতে উঠেই চললেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটিতে।
১৪ আগস্টের ওইদিনই বাংলাদেশের আরেক প্রান্তে চলছে গোপন মহড়া। সেনাবাহিনীর কামানগুলি হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল সন্ধ্যার অন্ধকারে। রাত একটু গাঢ় হতেই সেগুলো বিমানবন্দরের কাছে জড়ো হতে শুরু করল। যখন প্রায় মাঝরাত, এক এক করে জড়ো হতে শুরু করলেন সেনাবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসাররা। সেখানে ছিলেন মেজর ডালিম, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর নূর, মেজর শাহরিয়র সহ অন্যান্যরা। থমথমে মুখ সবার, চোয়াল শক্ত। চোখে যেন ছাইচাপা আগুন জ্বলছে। কিছু একটা যেন চলছে সবার মধ্যে। দেখতে দেখতে মধ্যরাত পেরল। মুখ খুললেন মেজর ফারুক। কেন জড়ো হয়েছেন সবাই? কারণ, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটা কাজে যেতে হবে। খুব বড় কাজ। কী সেটা? বরফশীতল গলায় মেজর ফারুক জানালেন, “শেখ মুজিবুর রহমানকে আজই হত্যা করতে হবে, সপরিবারে।”
আরও পড়ুন : ভাষা আন্দোলনের অক্লান্ত সৈনিক ছিলেন শেখ মুজিব
প্রেক্ষাপট অবশ্য তৈরি হয়েইছিল। যার হাত ধরে স্বাধীনতা পেল বাংলাদেশ, তাঁকেই মারতে হবে, এমন একটা ধারণা দেশের একাংশের মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবুও, বঙ্গবন্ধু, ওরকম একজন ব্যক্তিত্বময় মানুষ, তার ওপর দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। ঠাণ্ডা স্রোত একটু হলেও বয়ে গেল। কিন্তু নীল নকশা যখন তৈরি হয়ে গিয়েছে, তখন আর দেরি করে লাভ কি! ভোর পাঁচটা হতে না হতেই বেরিয়ে পড়ল সেনাবাহিনীর গাড়ি। সেখানে ওই মেজরদের সঙ্গে রয়েছে আরও সেনা। মূল লক্ষ্য তিনটি জায়গা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ছাড়াও টার্গেট ছিল আরও দুটি বাড়ি। এক, শেখ মণি এবং দুই, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা। সেনাদের হাতে তাজা বারুদ, গুলি আর স্বয়ংক্রিয় বন্দুক। সোয়া পাঁচটা নাগাদ মোসলেম উদ্দিন তার ফৌজ নিয়ে উপস্থিত হয় ধানমন্ডির শেখ মণির বাড়িতে। সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে। ঘুম থেকে জেগে সবেমাত্র কাগজ পড়ছিলেন তিনি। কথা বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে তাঁকে ঝাঁঝরা করে দিল মোসলেমের বন্দুক। ঘরের ভেতর ছিলেন শেখ মণির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। তাঁরও পরিণতি হয় স্বামীর মতোই। রক্তে ভরা ঘরে কেবল বেঁচে যান তাঁদের দুই সন্তান।
এরপরের লক্ষ্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি। মেজর ডালিমের নেতৃত্বে এক দঙ্গল সৈন্য এসে ঢোকে তাঁর বাড়ি। গুলির আওয়াজ শুনে ততক্ষণে জেগে গেলেও শেষ চেষ্টা করতে পারেননি সেরনিয়াবাত। বাড়ির সদস্যদের লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হয় ঘরের ভেতর। সেরনিয়াবাতের সঙ্গে ছিলেন তাঁর কিশোরী মেয়ে, ছেলে, ভাগ্নে, কাজের লোকেরা, অতিথিরা। এমনকী, চার বছরের কোলের শিশু, নাতি বাবুকেও সেখানে দাঁড় করানো হয়। তারপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ঘরে তখন কেবল রক্ত আর রক্ত। দুধের শিশুটিও নিথর দেহে পড়ে রইল সেখানে।
এরপর আসল টার্গেট। ধানমন্ডির ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে ততক্ষণে খবর পৌঁছে গিয়েছে। প্রধান ফটকের বাইরেও গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছে। গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই বেরিয়ে এলেন বঙ্গবধু শেখ মুজিবুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী, শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। বাড়ির কর্মী রমা আর আব্দুল ততক্ষণে সবাইকে জাগিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিগত সচিব মহিতুল ইসলামকে পুলিশের কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে বলেন মুজিব। কিন্তু সেখানে কিছুতেই লাইন লাগেনি। শেষমেশ সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। হামলার খবর জানানোর পর তড়িঘড়ি উদ্যোগ নেন তিনি। কর্নেল জামিল নিজের গাড়িচালককে নিয়ে রওনা দেন রাষ্ট্রপতির বাড়ি। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। সেনারা বঙ্গবন্ধু বাড়ি আসার রাস্তাও ঘিরে রেখেছিল। রাস্তাতেই গুলি করে কর্নেল জামিলকে হত্যা করা হয়।
আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু-জিয়াউর রহমানের রক্তাক্ত লাশ, খুনির বিবরণে লেখা কথা ও RAW কর্তার সতর্কতা
ততক্ষণে নীচের তলায় নেমে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল। পরিচয় জানার পর মেজর বজলুল হুদার বন্দুক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরোয়। রক্তে ভেসে যায় নিচের তলা। ছেলে যে আর বেঁচে নেই, জেনে গিয়েছেন খোদ মুজিবুর রহমানও।
তখন দোতলার ঘরে পরিবারকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেষমেশ সেনাবাহিনী তাঁর ঘরের বাইরে পজিশন নেওয়ার পর তিনি বেরিয়ে আসেন। বজ্রকন্ঠে একটাই উক্তি বেরিয়ে আসে, “তোরা কী চাষ? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে? আমাকে মারতে চাস?” বাঙালি জাতির প্রতি ভালোবাসা ওই মুহূর্তেও তাঁকে আঁকড়ে ছিল। সিঁড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু। আর কেউ দেরি করেনি। মেজর হুদা আর নূরের বন্দুক গর্জে ওঠে। মোট ১৮টি গুলি গেঁথে যায় বঙ্গবন্ধুর শরীরে। সিঁড়ি দিয়ে বইতে থাকে রক্তের নদী।
এক এক করে পরিবারের বাকি সদস্যদেরও একই পরিণতি হয়। সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে শেখ নাসেরকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে গুলি করা হয়। তারপর জল খেতে চাইলে আরও গুলি গেঁথে দেওয়া হয় শরীরে। আর শেখ রাসেল? বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে তখন কাঁদছে। তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাঁর মায়ের রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে। আর সিঁড়িতে রয়েছে বাবার দেহ। সেখানে নিয়ে গিয়ে সোজা মুখে গুলি করা হয়। মাথা থেঁতলে যায়, চোখ বেরিয়ে আসে কোটর থেকে। গোটা বাড়িটা তখন রক্তের সমুদ্র। যেখানেই দেখা যাচ্ছে, থইথই করছে রক্ত। আর সেখানে বিশ্বাসঘাতকদের রক্তমাখা বুটের ছাপ। দিনটা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। মাত্র এক ঘণ্টার অপারেশনে শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের অভিভাবক ও তাঁর পরিবারের জীবন।
এই নারকীয়, নৃশংস ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন কেবল দুজন। বঙ্গবধুর দুই মেয়ে, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। দুজনের কেউই দেশে ছিলেন না। তারপরও বহুদিন তাঁরা ফিরতে পারেননি বাংলাদেশে। বাবার রক্তমাখা লাশের ছবি বুকে নিয়েই পথ চলছেন তাঁরা।