হাতে পেরেকবিদ্ধ 'গীতাঞ্জলি', রবীন্দ্রনাথের 'বিতর্কিত' মূর্তিই প্রতিবাদের চিহ্ন হয়ে উঠল বাংলায়
Rabindranath Tagore Sculpture Dhaka : হাতের বইটি হল ‘গীতাঞ্জলি’। একটি মোটা, ঘাতক পেরেক সেই বইটি ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। সেখানে লেগে আছে লাল রং; রক্ত…
হলদেটে সাদা একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ঠিক পাশেই। বাচ্চা থেকে বুড়ো – প্রত্যেকে এক ঝলক দেখলেই চিনে যাবে সেই মূর্তিটি আসলে কার। লম্বা জোব্বা, হাতে বই, দীর্ঘ চুল আর দাড়ি – ঋষিপ্রতিম চেহারাটির সঙ্গে বাংলা তথা গোটা পৃথিবীর আলাপ অনেক যুগ ধরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু সাধারণত তাঁর যে মূর্তি দেখা যায়, তার থেকে খানিক যেন আলাদা। এখানে রবীন্দ্রনাথের মাথাটা সামান্য নিচের দিকে ঝোঁকানো। চেহারায় বিষণ্ণ একটি ভাব ফুটে উঠেছে। মুখে নীল স্কচ টেপ পরানো। আর হাতের বইটি হল ‘গীতাঞ্জলি’। একটি মোটা, ঘাতক পেরেক সেই বইটি ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। সেখানে লেগে আছে লাল রং; রক্ত…
এই একটি মূর্তি ঘিরেই বিতর্ক ঘন হল বাংলায়। পশ্চিমবঙ্গ নয়; ওপার বাংলায়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে এমন একটি মূর্তি দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশেই এই বিশেষ মূর্তিটি বসানো হয়েছে। পাথরের নয়, বরং ১৯ ফুট লম্বা মূর্তিটি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছে বাঁশ, থার্মোকল, কাগজ। জানা গিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্ররা এই বিশেষ মূর্তি তৈরি করেছেন।
এরপরই ওই ভাস্কর্যটির ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কেবল বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গেও এই বিশেষ মূর্তিটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের মুখ বন্ধ, গীতাঞ্জলির বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে রক্তাক্ত পেরেক। সেই গীতাঞ্জলি, যার ইংরেজি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এনে দিয়েছিল নোবেল পুরস্কার। সেই গীতাঞ্জলিই আজ রক্তাক্ত! কেন এমন অদ্ভুত আর বিতর্কিত মূর্তি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
আরও পড়ুন : ঘনিয়ে আসছে ‘কালো অধ্যায়’! ফের আচমকা কেন অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ?
শিল্প মানে কেবল মনোরঞ্জন নয়। শিল্প হল প্রতিবাদের একটা রাস্তা, একটা ভাষা। যুগে যুগে, কালে কালে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে এমন মনোভাবের কথাই বলে গিয়েছেন অনেকে। ঋত্বিক ঘটকের মতো করেই তাঁরা বলেছেন, “আমি সস্তার আনন্দ দিতে আসিনি।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথের এই মূর্তিটিও আসলে প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদের একটা কাঠামো। যারা এই মূর্তি তৈরি করেছেন, সেই চারুকলা অনুষদের ছাত্রদের বক্তব্য, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদেই এই মূর্তি তৈরি করা হয়েছে।
কী ঘটনা? এই মুহূর্তে বাংলাদেশে চলছে একুশে গ্রন্থমেলা। সেখানে এবছর আদর্শ প্রকাশনীর স্টল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি বইও নাকি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকদেরও হঠাৎ করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পরিচালক মোস্তফা ফারুকীর একটি সিনেমাকেও ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। যে কোনও সভ্য, গণতান্ত্রিক দেশে বাকস্বাধীনতার গুরুত্ব রয়েছে। মানুষ নিজের মতটি প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু সেজন্য গ্রেফতার, বই নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনা কেন ঘটবে?
এর জন্যই প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের এই মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে। তবে এই একটি গণ্ডির মধ্যে মূর্তিটি হয়তো আর সীমাবদ্ধ নেই। কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও এটি আর নেই। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত সহ গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ভারতের ছবিটাই দেখুন! শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে প্রতিবাদীদের। তিনি পশ্চিমবঙ্গের অম্বিকেশ মহাপাত্রই হন, অথবা জেএনইউ-র উমর খালিদ – ট্র্যাডিশন অব্যাহত। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, শাসক কিংবা ক্ষমতামাত্রেই চায় বিরুদ্ধমতকে দমিয়ে রাখতে। আর এই ঝড়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে স্বাধীন চিন্তা।
আরও পড়ুন : ক্রিকেটার কবিগুরু! যে রবীন্দ্রনাথকে আজও চেনেই না বাঙালি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই স্বাধীন চিন্তারই প্রতীক। মুখ টেপ দিয়ে বন্ধ রাখা মানে, মতপ্রকাশকে জোর করে দমিয়ে রাখা। গীতাঞ্জলি মানে জ্ঞান, বইয়ের আলো, যুক্তি, স্বাধীন মতামত। তাকেই পেরেক দিয়ে বিঁধে রক্তাক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এখানেই সর্বজনীন জায়গা নিয়ে নিল এই ভাস্কর্যটি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বারবার রবীন্দ্রনাথ কেন? এপার বাংলায় রোদ্দূর রায়ের ঘটনা এখনও পুরনো হয়ে যায়নি। ওপার বাংলায়ও এই মূর্তি ঘিরে বিতর্কের ঝড়। রবীন্দ্রনাথই তো বঙ্গভঙ্গের সময় খালি পায়ে রাস্তায় নেমে গিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিমকে এক করে রাখীবন্ধন করেছিলেন। স্বাধীন চিন্তাকে গুরুত্ব দিতেন। বাংলা ভাষায় তিনিই তো অন্যতম মনীষী। তাই ভাষা দিবসের আগে এমন প্রতিবাদের ‘ভাষা’ও দেখল আপামর বঙ্গদেশ।
অবশ্য এখানেও থামেনি ঘটনাটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে রবীন্দ্রমূর্তিটি বসার বেশকিছু সময় পর সেই মূর্তিটি হঠাৎ করেই সরিয়ে নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই ব্যাপারে কিছু বলছে না। কিন্তু এটা বারবার বলা হচ্ছে, এমন মূর্তি ‘অত্যন্ত অশোভনীয়’। সেই ফাঁকা জায়গায় অবশ্য ছাত্ররা একটি ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছেন। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ!’ এটাও এক ধরনের প্রতিবাদ। রবীন্দ্রনাথ কি মূর্তি হয়েই গুম হয়ে গিয়েছেন, নাকি সার্বিকভাবেই হারিয়ে গিয়েছেন? সেই কথাটাই যেন প্রকারান্তরে বলতে চাইলেন পড়ুয়ারা। এ কেবল বাংলাদেশের প্রতিবাদ নয়; বর্তমান সভ্যতা ও শাসকদের দিকে তাকিয়ে মানুষের প্রতিবাদ।