দুই বাংলার বানান-ভাবনা: মিল ও অমিল
International Mother Language Day: ‘বাংলা’ শব্দগুলির বানানের, ক্রিয়াপদ আর তদ্ভব শব্দের বানানের, কোনও মা-বাপ নেই। যে যেমন পারছে, লিখছে।
১
বাঙালির বানান নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয় উনিশ শতকে, মুদ্রাযন্ত্র আসার পরে। আপনারা যদি তার আগেকার বাংলা বই, অর্থাৎ হাতে লেখা পুথি দেখেন, তা হলে তার দু'টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করবেন। এক সংস্কৃত বা তথাকথিত তৎসম শব্দগুলির বানান মোটামুটি ঠিকই আছে— সংস্কৃতে যে রকম লেখা হত, মোটামুটি তা-ই আছে। কিন্তু ‘বাংলা’ শব্দগুলির বানানের, ক্রিয়াপদ আর তদ্ভব শব্দের বানানের, কোনও মা-বাপ নেই। যে যেমন পারছে, লিখছে। প্রেস এল ইংরেজ মিশনারিদের হাত ধরে, তাঁরাই বাঙালিদের সাহায্য নিয়ে ছেনি দিয়ে বাংলা হরফ শুরু করলেন। প্রেসের প্রথম বইগুলিও তাঁরাই ছাপতে শুরু করলেন। হয়তো তাঁদেরই মনে হল, এ কী রে বাবা! ইংরেজিতে এক শব্দের বানান মোটামুটি এক, বাংলায় তা নেই কেন ? তখন তাঁরা শুনেছি ভাটপাড়ার সব পণ্ডিতদের প্রুফ দেখানোর কাজে লাগালেন, এবং তাঁরাই মোটামুটি সংস্কৃত বানানের অনুসরণে বাংলা বানানের মধ্যে একটা একরূপতা (uniformity) আনবার চেষ্টায় লাগলেন। ফলে বাড়ি হল বাড়ী, বাঁশি হল বাঁশী, পাখি হল পাখী, সংস্কৃতের বাটী, বংশী, পক্ষীর অনুসরণে। আমরা যাকে সাধু ভাষা বলি, তার বানান মোটামুটি একটা স্থির চেহারা পাচ্ছিল।
এই ভাবেই চলছিল। কিন্তু এর মধ্যে গোল বাধল সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রয়োগে। সেটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কিছু বইয়েই (১৮০১-১৯৩৫) চলিত ভাষার নমুনা এসেছিল, পরে ১৮২৩ থেকে ‘নকশা’ সাহিত্যে তার বেশ ভালোরকম প্রবেশ ঘটতে লাগল। ১৮৬২-তে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-তে তা একটি ধাক্কার মতো দেখা দিল। ১৮৫২-র পর থেকে বাংলা নাটকেও তার আবির্ভাব ভালো রকম ঘটবে। বিশেষ করে নারী ও সাধারণ লোকের সংলাপে। বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যে ব্যাপারটাকে পছন্দ করবেন না, কিন্তু শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় ১৮৭৭ সালে চলিত ভাষায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তক রচনাও সুপারিশ করবেন। বঙ্কিমচন্দ্র তা-ও পছন্দ করবেন না। তবু ১৮৮২ সালে সারস্বত সমাজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের খবর পাই, যেটি সম্ভবত বাংলা বানানে শৃঙ্খলা আনার প্রথম সংঘবদ্ধ প্রয়াস। তার কোনও নথি আমরা পাইনি।
আরও পড়ুন: সরকারি বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষার দফারফা! বিজ্ঞাপন লিখিয়েদের কী কী শিখতেই হবে…
এর পরে ১৯১৪তে ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকার জন্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একটি বানান-নীতি তৈরি করে দিয়েছিলেন। জানি না, কেন পরে তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩৩২ সনে প্রশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নামে ছাপা হয়। আমাদের মতে তা ঊর্ধ্বকমা, ও-কার ইত্যাদির বাহুল্যে অত্যন্ত জবরজঙ একটি নীতি ছিল, পরে ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত বানান-সংস্কার সমিতির সুপারিশে যা বর্জিত হয়।
২
বস্তুত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার থেকেই বাংলা বানান সংস্কার চেষ্টার মূল ধারাটির সূত্রপাত হয়। এবং পরে বাংলার প্রকাশনা জগৎ, পত্রপত্রিকা ইত্যাদি যাকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করে। সকলে রাতারাতি নিজেদের বানান বদলে ফেলেছিল এমন হয়নি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-নীতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছিল এইরকম কয়েকটি : এক, তৎসম শব্দের বানান মোটামুটি সংস্কৃতানুগ হবে, কিন্তু তৎসম ও অন্যান্য শব্দে রেফের নীচে ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব বর্জন করা হবে। তৎসমতেই আগের পদে যদি শেষে ‘ম্’ থাকে তবে পরের পদের সঙ্গে সমাসে তা ‘ং’ হত। দু'টিতেই বিকল্প রাখা হয়েছিল। দুই, অতৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ আর দীর্ঘ ঊ-কার বর্জন করা হবে, মূর্ধন্য ণ-ও। আর সব ছোটখাটো সংস্কার, যেমন তদ্ভব শব্দে মূল সংস্কৃতের ‘য’-এর জায়গায় ‘জ’ লিখতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যেমন ‘জোয়াল’, ‘জুঁই’ ইত্যাদি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কারই পরবর্তীকালের সমস্ত বানান-সংস্কার বা সমতাবিধান চেষ্টার মূল ভিত্তি। এর পরে দুই বাংলার বাকি সব ছিল নিছক ব্যক্তিগত প্রস্তাব, এবং কিছুটা উৎকেন্দ্রিক। যেমন, হ্যালেডের ‘এ গ্রামার অব দ বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৭৭৮) অর্থাৎ ইংরেজিতে বাংলার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশের দ্বিশতবর্ষে অধ্যাপক জগন্নাথ চক্রবর্তী বাংলা বানান সংস্কারের একটি বিপ্লবাত্মক প্রস্তাব করেন, যা খুব মৌলিক নয়। ১৯০৫ সাল নাগাদ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এমন প্রস্তাব করেছিলেন, আবার ১৯৪৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-র নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার নিযুক্ত একটি কমিটিও প্রায় এই রকম একটি প্রস্তাব করেছিল। দু'টির কোনওটিই গৃহীত হয়নি। তার কারণ, আমরা আমাদের ‘বাংলা বানান সংস্কার, সমস্যা ও সম্ভাবনা’ বইয়ে দেখিয়েছি যে, উচ্চারণ অনুযায়ী বাংলা বানান করতে গেলে (যুক্তাক্ষর ভেঙে) বাংলা হাতের লেখা আর টাইপ করার সময় কীরকম বেড়ে যাবে। তাতে শুধু তালব্য-অনুস্বার, দন্ত্য-ন ইত্যাদি রেখে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল। যাই হোক, সে সব প্রস্তাব, আমি যেগুলিকে বলি প্রান্তিক প্রস্তাব, সেগুলির কোনওটিই দুই বাংলার কোথাও গৃহীত হয়নি। বরং পরবর্তীকালে মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখের ব্যক্তিগত আলোচনা বানান সংস্কারের ওই কেন্দ্রীয় বা মূল ধারার অনেক কাছাকাছি ছিল।
১৯৮৬-র ২০মে পশ্চিমবঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি গঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে, মনস্বী অন্নদাশঙ্কর রায়কে সভাপতি করে। ঢাকার বাংলা একাডেমি তার প্রায় তিরিশ বছরের অগ্রজ। কলকাতার আকাদেমি প্রতিষ্ঠার আগের বছর তার প্রাগ্ভূমিকা হিসেবে আয়োজিত বাংলাভাষা বিষয়ক এক বহুমুখী আলোচনাচক্রে প্রয়াত অধ্যাপক ক্ষেত্র গুপ্তও একটি উচ্চারণ নিয়ন্ত্রিত বাংলা বানান-নীতির প্রস্তাব করেন, তাঁর মতে সেটা হত বাংলা বানানের ‘গণতন্ত্রীকরণ”। অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রস্তাব অনুসারে আকাদেমি প্রথম দিকেই বাংলা বানান সংস্কারে উদ্যোগী হয়। এই উদ্দেশ্যে সে প্রায় দু-হাজার প্রস্তাব-পুস্তিকা দুই বাংলারই বাংলাভাষার বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠায়। শিলচর আর ত্রিপুরা এবং দিল্লি ও পাটনাতেও সেগুলি পৌঁছে যায়। তার থেকে মোট চারশোটি নানা মন্তব্য-সহ ফেরত আসে। সেই অনুসারে আকাদেমির বানানের সমতাবিধান কমিটি কাজ শুরু করে। এই সমিতিতে ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, সৌরীন ভট্টাচার্য, সুভাষ ভট্টাচার্য, সুবীর রায়চৌধুরী, নির্মল দাশ এবং এই লেকক।
সমিতির প্রস্তাবে দু'টি দিক ছিল। এক কিছুটা লিপি সংস্কার, অর্থাৎ কিছু যুক্তব্যঞ্জনকে ‘স্বচ্ছ’ করে দেওয়া, যাতে কী কী ব্যঞ্জন যুক্ত হচ্ছে সেটা বোঝা যায়। তখনকার প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার আর নতুন সাক্ষরতা আন্দোলনের কথা মনে রেখে এটি করা হয়েছিল, মূলত বর্তমান লেখকের পরিকল্পনায়। বানানের চেয়ে লিপি-সংস্কার নিয়েই বেশি বিতর্ক চলে সংবাদ-সাময়িক পত্রে, কিন্তু সরকার এবং ছোটদের গ্রন্থ প্রকাশনায় এই নীতি গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী অভিধানও প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ রেখেই এই সংস্কারগুলি করা হয়েছিল। নব্বইয়ের প্রথম দিকে (১৯৯২) এবং পরে তা ২০০০ সালে কিছু সংশোধন লাভ করে। সম্ভবত ২০১৩-তে ঢাকার বাংলা একাডেমি আরও একটি নীতি প্রণয়ন করে। তার ভূমিকাতেও লেখা হয়েছে, “জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ বিস্তারিত আলোচনার পর ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর পরিমার্জিত সংস্করণ যুক্ত করা হয়।” এতেই এই প্রয়াসগুলি যে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা সূত্রেই এগিয়েছে, তার খবর পাওয়া যায়।
৩
ফলে, আমাদের মত, দুই বাংলার বানানের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ বা তারও বেশি ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। কিছু পার্থক্য আছে, তা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এর মূলে আছে কিছু সামাজিক আবেগও। যেমন বাংলাতে ইংরেজি ‘z’ ধ্বনিটির প্রতিবর্ণীকরণে বাংলাদেশে ‘য’ দিয়ে লেখার একটি রীতি ছিল, তা অনেকেই অনুসরণ করেন, যদিও ‘জ’ লেখাও চালু আছে। পশ্চিমবঙ্গের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ এ ক্ষেত্রে নীচে ফুটকি দেওয়া ‘জ’-এর প্রচলন করেছে, যদিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই তা প্রথম সুপারিশ করেছিল। ‘ইদ’ কথাটি পশ্চিমবঙ্গে ঢাকার বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক অভিধান অনুযায়ী ‘ই’ দিয়ে লেখা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে ‘ঈদ’ ব্যাপকভাবেই প্রচলিত। বাংলাদেশেও প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলির দু-একটি নিজস্ব বানান-নীতি তৈরি করেছে, সব ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির নীতি অনুসরণ করে না। কলকাতাতেও কোনও কোনও দৈনিক বাংলা আকাদেমির বানান সম্পূর্ণ মানে না, যদিও বাংলা আকাদেমির প্রস্তাবিত ‘শ্রেণি’, ‘কাহিনি’, ‘মফস্সল’ ইত্যাদি বানান গ্রহণ করেছে। ঢাকার বাংলা একাডেমি ক্রিয়াপদের ‘হতো’, ‘হলো’ ইত্যাদি চেয়েছে, কিন্তু কলকাতার আকাদেমি ওগুলিতে ও-কার দিতে বলেনি। কলকাতার ‘গণশক্তি’ পত্রিকা আবার অতীত আর ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়ায় শেষের ল আর ব-এ ওকার দেয়, যা আকাদেমির প্রস্তাবে নেই।
আরও পড়ুন: বাংলা উচ্চারণের অভিধান থাকা কেন জরুরি?
কাজেই দু-দেশের একাডেমি আর আকাদেমির বানানে অল্পস্বল্প তফাত আছে, আর সাধারণ ব্যবহারে তফাত আর-একটু বেশি। এ ক্ষেত্রে একাডেমির মান্যতার এলাকা হয়তো একটু বেশি। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির বানান স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বেশি গৃহীত। তবু আমি বলব, দুই বাংলার বানান-নীতির মধ্যে ঐক্যের এলাকা, পার্থক্যের এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণভাবে ব্যাপক প্রয়োগ সম্বন্ধেও একই কথা বলা যেতে পারে। দু-দেশের বই আর পত্রপত্রিকা পড়তে গিয়ে দু-দেশের পাঠককে কোনও বড় লিপি ও বানান-বিচ্ছেদের মুখোমুখি হতে হয় না।