প্রতিষ্ঠানকে সওয়াল করা 'জোকার'! ভোটকেন্দ্রে তাই কি মার হিরো আলমকে?
Hero Alam: অশ্লীল গালমন্দ শেষ না হতেই শুরু হয় মার। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন হিরো আলম। কিন্তু হামলাকারীরা তাঁকে ধাওয়া করেন অনেক দূর পর্যন্ত।
এ দুনিয়ায় তাঁরাই 'হিরো', যাঁরা রূপে কার্তিক, গুণে গণেশ। পুরুষদের ক্ষেত্রে এমন উপমা খাটে কিনা জানা নেই, কিন্তু কালে কালে, যুগে যুগে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই এমন পুরুষদেরই আমরা 'হিরো' বলে জেনে এসেছি। সুদর্শন, সুঠাম, দীর্ঘদেহী যাকে বলে এক কথায় 'টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম'। এখন অবশ্য নারী-পুরুষ ভেদেই ফর্সার বাজার। সে ফর্সা হোক বা কালো, ভালো নাচতে পারেন, গাইতে পারেন, নারী হৃদয়ে দোলা কিংবা পুরুষ হৃদয়ে হিংসার উদ্রেক করতে পারেন, তেমন পুরুষই না 'হিরো'। তবে এই সমস্ত ধারনাকে ভেঙে চুরমার করে যিনি নিজের নামের গোড়ায় জুড়ে নিতে পারে স্বেচ্ছা 'হিরো'-র উপাধি; উৎকট নেচে, গেয়ে, অভিনয় করে সাজিয়ে তোলা সমস্ত 'সংস্কৃতি'-র মুখে ছুঁড়ে মারতে পারেন এক বস্তা সন্দেহ, তিনি বোধহয় হিরো আলম।
আরও পড়ুন: গান থামালে অভিনয়! কেন হিরো আলমকে নস্য়াৎ করতে পারবে না বাংলাদেশ
মিউজিক ভিডিও থেকে মডেলিং, সিনেমা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, নাচ থেকে গান- প্রায় সব জায়গায় তিনি অবাধ এবং স্বাধীন। বেসুরো গান, বেখাপ্পা নাচেন, অভিনয়ও তথৈবচ। তবু খবরে থাকেন তিনি। এক কথায় বলতে গেলে তিনি 'টিকটক স্টার', সস্তা মনোরঞ্জন, মিমের উপাদান মাত্র। কিন্তু শুধু কি তাই! নাকি তিনিও প্রশ্ন তোলেন তথাকথিত 'ভদ্রলোকের' সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অনায়কচিত চেহারা, কণ্ঠস্বর- হিরোইজমের সঙ্গে যা কিছু সাযুজ্যপূর্ণ, তারই যেন বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন বাংলাদেশের এই উঠতি তারকা হিরো আলম। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার। কীসের টানে আসেন তাঁরা? সস্তা খোরাকের? নাকি কমবেশি আমাদের সকলের মধ্যেই অবচেতনে বাস করে এমন এক মধ্যবিত্ত মন, যারা কোথাও না কোথাও সস্তা মনোরঞ্জন, তথাকথিত সংস্কৃতির বিপরীত দিকটিকে দেখতে ভালোবাসে, উপভোগ করে। নাকি আমাদের সকলের ভিতরেই ঘুমিয়ে রয়েছে এক পিছিয়ে পড়া না-হিরো সত্তা, যারা ভিড় বাসে গুঁতো খায়, অফিসে বসের ঝাড় খায়, বাড়িতে বউয়ের ধ্যাতানি খায়.. আর তাঁরা দেখে হিরো আলমকে, দেখে আদ্যপান্ত সাধারণ, কিছু না-পারা ছেলের হিরো হওয়ার ছবি, যার নায়ক হতে সংস্কৃতির মান্যতা লাগে না, লাগে না কারওর সিলমোহর। এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর সাক্ষাৎকার পেতে ভিড় করেন দুই বাংলার সাংবাদিকেরা, তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয় দু-দেশেই।
এ হেন হিরো আলম এবার ভোটের মঞ্চে। সোশ্যাল মিডিয়া, সিনেমার পর এবার রাজনীতির রাস্তায় আরশাফুল আলম সইদ। হ্যাঁ, এটাই পোশাকি নাম তাঁর। বেশ কয়েক বছর ধরেই রাজনীতিতে আসার লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হিরো আলম। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ আসনে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেন। ফের ২০২২ সালে উপনির্বাচনে নির্দল হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন হিরো আলম। না, শিকে ছেঁড়েনি রাজনীতিতে। তবে বাকি সব কিছুর মতোই এখানেও হাল ছাড়তে নারাজ তিনি। এ বছর ফের ভোটে দাঁড়িয়েছেন হিরো আলম।
সোমবার ছিল ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন। বনানী এলাকায় নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন হিরো আলম। আর সোমবার ভোটচলাকালীন ওই এলাকাতেই দুষ্কৃতীদের হাতে বেধড়ক মার খেলেন আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। কার্যত গণপ্রহার বললেও ভুল হয় না। সকাল বেলাই হিরো আলম অভিযোগ করেছিল, তাঁর কেন্দ্রে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। তার পরেই বিকেল তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ নিজের কেন্দ্রে গেলে বিরোধীদের হাতে বেধড়ক মার খান হিরো আলম। অভিযোগের তির নৌকা প্রতিকের প্রার্থীদের সমর্থকদেক বিরুদ্ধে। ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে দেখা গিয়েছে হামলাকারীদের অনেকেই নৌকা প্রতিকের ব্যাজ পরেছিলেন।
ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, অশ্লীল গালমন্দ শেষ না হতেই শুরু হয় মার। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন হিরো আলম। কিন্তু হামলাকারীরা তাঁকে ধাওয়া করেন অনেক দূর পর্যন্ত। শেষমেশ বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে গিয়ে একটি রিকশায় উঠে প্রাণ বাঁচান। তাঁর উদ্দেশে হামলাকারীদের বলতে শোনা গিয়েছে- 'সে করে টিকটক, সে হলো জোকার, সে কেন গুলশান-বনানীর এমপি হতে চায়? এমপির মানে সে জানে?' হামলাকারীদের একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
আরও পড়ুন: রিল মানে কি সহজেই হাততালির লোভ? ‘রিয়েল’-কে পাশ কাটিয়ে কত দূর যাব আমরা?
কেন এই হামলা, তার কারণ পরিষ্কার নয়। ভোটে হিংসা, হারজিত, দলীয় কোন্দল নতুন কথা নয়। তবে হিরো আলমের মতো অসমর্থীত নির্দল প্রার্থী কি সত্যিই লড়াইয়ের ময়দানে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ? না হিরো আলমের মতো তথাকথিত 'না-হিরো' দুর্বল সত্তার উঠে আসা বা প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করাটাই চোখে লাগছে ক্ষমতাবানের। আসলে ক্ষমতার তেমন কোনও চেহারা বা মুখ হয় না। নিজের থেকে যে কোনও দুর্বলকেই পায়ের তলায় চেপে রাখাতেই তাঁর ক্ষমতার প্রকাশ। আর সেখানে দাঁড়িয়ে হিরো আলম তো সেই দুর্বলতর প্রতিনিধির জিতে যাওয়া মুখ। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি সওয়াল করে এসেছে বরাবর। তাই কি এমন নির্দয়ী হামলা!
এই গণপ্রহারকারীরা কি শুধুই তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী! নাকি এই গণরোষ আসলে সেই সব রক্ষণশীলদের, যাদের এ যাবৎকালের ধারণায় গিয়ে সমূলে ধাক্কা মারতে পেরেছেন সমস্ত হেরে যাওয়া অ-নায়কদের 'হিরো' হিরো আলম?