বাংলা জুড়ে পাঁচিল তুলেছিলেন, কৈবর্ত রাজা ভীমের যে ইতিহাস আজও অজানা
Kaivarta King Bhim: দ্বৈত শাসন সামলাতে সামলাতে বাঁচা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল কৈবর্তদের। ফলে বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে (১০৭০-১০৭৫) কৈবর্ত নেতা দিব্যোকের নেতৃত্বে হল 'কৈবর্ত বিদ্রোহ'।
সিরাজগঞ্জের সীমানা থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিমের শেরপুর হয়ে বগুড়া শহরে প্রান্ত─এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দেখা যায় একটি উঁচু পাঁচিল। এর প্রচলিত নাম 'ভীমের জাঙ্গাল'। কথিত, আসামের কামরূপ থেকে ঘোড়াঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই পাঁচিল। এখনও তার ৭০ কিলোমিটার মতো অবশিষ্ট রয়েছে। করতোয়া নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার দামুকদহের বিলে গিয়ে মিশেছে এই বিশাল পাঁচিল। পরে ফের দিনাজপুরের বিরাটনগর ও ঘোড়াঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কোথাও কোথাও এর উচ্চতা চীনের প্রাচীরের থেকেও বেশি। এই সুবিশাল প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন বাংলার কৈবর্ত রাজা ভীম। চল্লিশ মাইলেরও বেশি বিস্তৃত এই পাঁচিলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস।
বাংলায় পালরাজাদের শাসনকালটি বড় দীর্ঘ। বৌদ্ধ পালরাজারা আনুমানিক ৭৫০ সাল থেকে ১১৬১ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। বাংলাভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ যেমন এই সময় রচিত হচ্ছে, ঠিক তেমনই এই সময় ঘটে যাচ্ছে এমন এক ঘটনা, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে যার নজির বিরল। বাংলার কৃষক ও জেলেরা রাষ্ট্রশক্তি দখল করে ফেলছে। ৩৭ বছর এক স্বাধীন আমজনতার শাসনের স্বাদ পাচ্ছে বঙ্গভূমি। এই ঘটনা ইতিহাসে কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে খ্যাত।
পাল রাজারা ছিলেন মূলত বৌদ্ধ বজ্রযান ধারাটির অনুগামী। সোমপুর বিহার বা জগদ্দল বিহার সেই সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে সে'খানে লোকে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এমন তথ্যও পেয়েছিলেন, যে এই জগদ্দল বিহার থেকে প্রায় দশ হাজার বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিহারগুলিতে তন্ত্র, জ্যোতিষ, ন্যায়শাস্ত্র, হিন্দু-জৈন-লোকায়ত বিশ্বাস─বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা হত, গবেষণা হত। শুভংকর গুপ্তের মতো বিখ্যাত ভিক্ষু এই বিহারে থেকেছেন। কিন্তু এই চর্চার মূল্য দিতে হচ্ছিল সাধারণ মানুষকেই। ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দিকে ঝুঁকছিলেন পাল রাজারা। ফলে কৈবর্ত কৌমের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল। তার উপর মন্দির-বিহার, সংঘারাম, দেবকূলের বোঝাও চাপছিল তাদের কাঁধে। বিহারের অধ্যাপকেরা বেতন হিসাবে পেতেন দশ দ্রোণ দশ পাটক জমির আয়। প্রত্যেক ছাত্র পড়াশোনার খরচ হিসেবে পেতেন ১ পাটক জমিত আয়। তার সঙ্গে ছিল অজস্র কর্মচারীদের বেতন। বিহারের নামে যে পাঁচ-দশটি গ্রাম দান করতেন রাজারা, সেই গ্রামের সিংহভাগ মানুষ ছিলেন কৈবর্ত। জমির ফসল তো হাতছাড়া হতই, জঙ্গলে শিকার করতে গেলে কর, নদীতে মাছ ধরতে নামলে কর─হাজার রকমের শোষণ চলত অবাধে। একদিকে রাজার খাজনা, অন্যদিকে মঠ-মন্দির-বিহারগুলির পুরোহিত-আচার্য-অধ্যক্ষদের খাজনা─দ্বৈত শাসন সামলাতে সামলাতে বাঁচা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল কৈবর্তদের। ফলে বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে (১০৭০-১০৭৫) কৈবর্ত নেতা দিব্যোকের নেতৃত্বে হল 'কৈবর্ত বিদ্রোহ'। পালরাজাদের বিরাট সাম্রাজ্য কেঁপে উঠল সেই বিদ্রোহে।
সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিতম' গ্রন্থে এই বিদ্রোহের কথা রয়েছে। দ্বিতীয় মহীপাল যুদ্ধে নিহত হন। তাঁর দুই ভাই দ্বিতীয় শুরপাল ও দ্বিতীয় রামপালকে বন্দি করেন দিব্যোক। বঙ্গের বুকে স্থাপিত হয় চাষি ও জেলেদের এক স্বাধীন রাজ্য। শান্তি ফেরে বঙ্গভূমিতে। দিব্যোকের মৃত্যুর পর রাজা হন তাঁর ছোট ভাই রুদ্রক। রুদ্রকের পুত্র এই ভীম। ভীম শাসক হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রায় তিন দশক বাংলা স্বমহিমায় শাসন করেন তিনি। তাঁর আমলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বরেন্দ্রভূমি ধীরে ধীরে সম্মৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। সুবিধাভোগী ব্রাহ্মণ-পুরোহিত, অধ্যক্ষ এই সব শ্রেনীর উপরে কর বসান ভীম। সেই অর্থ ব্যবহৃত হত সাধারণ মানুষের কল্যাণে। রামপাল ভাইয়ের রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য ক্রমাগত আক্রমন চালিয়ে যেতে থাকেন। ভীম সেই রাজা, যাঁর প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রচালনার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, কৌটিল্যের মতো মন্ত্রণাদাতা ছিলেন না কেউ, কুশলী সেনাধ্যক্ষ ছিল না─কেবল আত্মবিশ্বাসের জোরে একের পর এক আক্রমণ ঠেকিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু আমজনতা রাষ্ট্র চালাবে? মেনে নিতে পারছিলেন না কেউই। রামপালের সঙ্গে যোগ দিলেন আঠেরোটি রাজ্যের রাজা, সামন্ত ও মহাসামন্ত। অঙ্গ, মগধ, উৎকল─কে নেই সেই জোটে! এই আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এক দীর্ঘ পাঁচিল তুললেন ভীম। সেই যাবতীয় ইতিহাস পেরিয়ে, যা বাংলার বুকে কৈবর্ত বিদ্রোহের স্পর্ধা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজও।
আরও পড়ুন: বাংলার প্রথম দলিত বিদ্রোহ ও এক ভুলে যাওয়া সংগ্রামী লেখক
একদিকে পাঁচিল নির্মাণের কাজ চলছে, অন্যদিকে ঘোড়া সংগ্রহের চেষ্টা। ঘোড়া ছাড়া যুদ্ধ কীভাবে হবে! কিন্তু কেনার টাকা নেই। পীঠি থেকে কিছু ঘোড়া পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পীঠির রাজা নিজেই সসৈন্য রামপালের দলে যোগ দিলেন। বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না ভীম। জঙ্গল থেকে শত শত বুনো মহিষ আনা হল। তৈরি হল মহিষারোহী বাহিনী। যুদ্ধ চলল প্রবল বিক্রমে। কিন্তু কতদিন? অসম যুদ্ধে ধীর ধীরে পরাজিত হল বঙ্গের সেই স্বাধীন রাষ্ট্র। যুদ্ধে বাংলার তরুণ বিদ্রোহী রাজা ভীমের মৃত্যু হল। রাষ্ট্রক্ষমতা আবার ফিরে গেল রামপালের হাতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আশেপাশের সাবর্ণ রাজারা। মুছে দেওয়া গেল কৌবর্ত কবি পপীপের কীর্তি। বাংলার ইতিহাসে পৃষ্ঠপোষকের প্রতি যাবতীয় চাটুকারিতা নিয়ে থেকে গেলেন সন্ধ্যাকর নন্দী।
বাংলার ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন, অনেকেই সচেতন ভাবে এই ইতিহাস এড়িয়ে গিয়েছেন। অথবা কৈবর্তদেরই অসভ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবেই তুলে ধরেছেন। নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার সময় ধীরে ধীরে এই ঘটনার দিকে নজর যায় মানুষের। বাংলার সেই আদি কৃষি বিদ্রোহ, সম্ভবত একমাত্র সফল বিদ্রোহও, যা প্রায় চার দশক আমজনতার শাসন বজায় রেখেছিল। কিন্তু যতই এড়িয়ে যান ঐতিহাসিকেরা, ক্ষমতাবানেরা, জনমানস থেকে তা মুছে দেওয়া গিয়েছে কি? এই বিস্তীর্ণ পাঁচিল ধরে যখন সেই ইতিহাসের খোঁজে দিনরাত হেঁটে বেড়াচ্ছেন জাকির তালুকদার, তখন সাধারণ মানুষরাই তাঁকে জানাচ্ছেন ভীমের কথা, তাঁর রাজধানীর কথা, মহাস্থানগড়ের কথা। মানুষের মুখে মুখে এখনও প্রচলিত সেই ইতিহাস। তাঁরা ভোলেননি। দিনাজপুরের কৈবর্ত স্তম্ভটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্বমহিমায় রয়েছে ভীমের পান্টিও। দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়ার মানুষও আজও স্মরণ করেন, হাজার বছর আগে, এক তরুণ বাঙালি কৈবর্ত রাজা ভীম, নিজের সর্বস্ব পণ রেখে আমজনতার স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই স্পর্ধার পদচিহ্ন মুছে ফেলার ক্ষমতা সম্ভবত কারও নেই।
কৃতজ্ঞতা-জাকির তালুকদার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কালের কণ্ঠ