বাংলাদেশে কি আসলে উত্তর কোরিয়া? হাসিনার হাসিতে যে সত্য লুকিয়ে
Bangladesh Election: হাসিনার 'বিএনপি মুক্ত বাংলাদেশ' আর মোদীশাহ'র 'কংগ্রেস মুক্ত ভারত' কি একই ডাক নয়? ভবিষ্যতে বাংলাদেশকেই গুরু মেনে ভোট করবে ভারত-নেপাল-শ্রীলঙ্কা?
আরও একবার বাংলাদেশে ক্ষমতায় শেখ হাসিনা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মঙ্গলবার অভিনন্দন জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা। এই নির্বাচনের পরে বাংলাদেশে কার্যত নিশ্চিহ্ন বিরোধীরা। ৩০০ আসনের সংসদে আওয়ামী লীগ জিতেছে ২২২টি আসন। হাসিনা পঞ্চমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিত্বে আসায় খুশি দিল্লিও। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশেই। উঠে আসছে স্বৈরাচারের অভিযোগ।
হাসিনা বলেছেন, এ'বারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। "জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।" অথচ বাস্তব চিত্র ঠিক তার বিপরীত। অভিযোগ, নির্বাচনের দিন কেন্দ্রগুলিতে যে সারিসারি ভোটার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের অনেকেই প্রকৃত ভোটার নন। আবার অনেকগুলি কেন্দ্রে একেবারেই ভিড় ছিল না। বিরোধী-বিহীন নির্বাচনের বেশ কিছু কেন্দ্রে হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন কমিশনার বলছেন, প্রত্যাশার থেকে অনেক ভালো ভোট হয়েছে। তবে কি আরও বড় গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলেন তিনি?
অসম প্রতিযোগিতাকে ঠিক প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ নির্বাচন বলা যায় কিনা─তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি। রসিক জনেরা নির্বাচনী অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলছেন, একবার মনে হচ্ছিল নৌকা জিতবে তারপরেও মনে হচ্ছিল নৌকাই জিতবে। হাসিনা বারবার বলছেন, দেখতে হবে মানুষ অংশগ্রহণ করেছে কিনা। তথ্য বলছে, এই নির্বাচনকে বয়কট করেছেন বাংলদেশের সাধারণ মানুষই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনকে স্বচ্ছ নির্বাচনের তকমা দিতে নারাজ। নির্বাচন পূর্ববর্তী হিংসা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘও। অভিযোগ, নির্বাচনের আগে গ্রেফতার হয়েছেন প্রায় কুড়ি হাজার বিরোধী নেতা।
এই নির্বাচনে উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনী মডেলের ছায়া দেখছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমেদ। কেউ কেউ এই শাসনকে আইয়ুবি স্বৈরশাসনের থেকেও ভয়ঙ্কর মনে করছেন। উত্তর কোরিয়ার সংসদের আনুষ্ঠানিক নাম 'সুপ্রিম পিপলস্ অ্যাসেমব্লি'। এতে ভোটদান বাধ্যতামূলক। সরকারি তালিকার বাইরে অন্য কোন প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে না। বিরোধী দল বলেও কিছু নেই। এই ধরনের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ১০০%। সরকার যে জোট তৈরি করবে সেই জোটকেই সর্বসম্মতভাবে ভোট দিতে হবে।
পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের শেষ সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮৬.২৯ শতাংশ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন। সেবারও নির্বাচনে কারপচুপির অভিযোগ তোলে বিএনপি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে কোন পথে নিয়ে যাবেন শেখ হাসিনা?
২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ মাত্র ৪১.৮ শতাংশ। যদিও সরকারি হিসেব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। অলি আহমেদের দাবি ৫ থেকে ১০ % ভোট পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদের সাফ কথা, ভোটার টার্নআউট ২০ শতাংশের বেশি হতেই পারে না। এই পরিস্থিতিতেও নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছেন বিগত সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য প্রমুখও পরাজিত হয়েছেন নির্বাচনে। যদিও অধ্যাপক আসিফ নজরুলের দাবি, এই পরাজয়ও হয়েছে শেখ হাসিনার অঙ্গুলিহেলনেই। এই নির্বাচনে একজনই ভোটপ্রার্থী। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। হাসিনা না চাইলে এই তিনশো আসনে কেউ জিততে পারবেন না। তবে কি কেবল একদলীয় সরকার নয়, এক ব্যক্তির সরকার প্রতিষ্ঠা হল বাংলাদেশে?
হাসিনা বারবার দাবি করছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে। তাহলে ভোটারের সংখ্যা এতখানি কমে গেল কেন? দেশজুড়ে হিংসার আগুন ছড়াল কেন? কেন বিরোধী নেতাদের প্রায় সকলকেই গ্রেফতার করল হাসিনার সরকার? বিএনপি-জামাত সহ সমস্ত বামদলগুলি নির্বাচন বয়কট করেছিল। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি কি ক্ষমতায় আসত? বিএনপি-র নেতারা কোথায়? বিরোধী-শূন্য অবস্থাতেই কি নির্বাচন জিততে চাইছিলেন হাসিনা? হাসিনা জেতার পরে ভারত সহ বহু দেশ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এই বিষয়ে কটাক্ষ করে অলি আহমেদ বলেছেন, 'পর্যবেক্ষকের নামে ভাড়াটে বিদেশিদের দিয়ে নিজেদের পক্ষে কথা বলাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। শিগগির সরকারকে বিদায় নিতে হবে।’ তবে কি ফের নির্বাচন হতে চলেছে বাংলাদেশে? এই নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন বিরোধীরা? শোনা যাবে সাধারণ মানুষের কণ্ঠ? বাংলাদেশে কি কার্যকর হয়ে গেল নর্থ কোরিয়া মডেল? হাসিনার 'বিএনপি মুক্ত বাংলাদেশ' আর মোদীশাহ'র 'কংগ্রেস মুক্ত ভারত' কি একই ডাক নয়? ভবিষ্যতে বাংলাদেশকেই গুরু মেনে ভোট করবে ভারত-নেপাল-শ্রীলঙ্কা? আসুন, জেনে নিই বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন!
হিরো আলম, বাংলাদেশ
বাংলাদেশে এই নিয়ে টানা চারবার ক্ষমতায় এলেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় থাকার জন্য ক্রমাগত দমনপীড়ন চালিয়ে আসছেন তিনি। এ'বারের নির্বাচনে ভোটার তেমন ছিলই না। নির্বাচন কমিশন ভুয়ো রিপোর্ট দেখাচ্ছে। কুড়ি শতাংশ ভোটার ভোট দিতে এলেও দশ কুড়িজনের এক দু'টো লাইন দেখা যায়। কিছুই ছিল না এ'বারের নির্বাচনে। পোলিং এজেন্টরা বুথগুলির বাইরে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। ৪০ শতাংশ ভোটের বেশিরভাগই ছাপ্পা। জনগণ এই ভোট প্রত্যাখ্যান করেছে।
টাকা দিয়ে ভোটারদের নিয়ে আসা হয়েছে। এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও টাকা দিয়েছে সরকার। পাঁচ-ছ'টি বিরোধীদল মিলে এক একটি জোট। তাদেরও টাকা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পাঁচ-ছ'টি করে আসনের সমঝোতাও হয়েছিল। মোটামুটি সকলেই জানত, আওয়ামী লীগের হাতে সমস্ত আসন। তাই টাকা না দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কেউ নির্বাচন লড়তে আসতেন না। হার নিশ্চিত জেনে কেউ কি নিজের টাকা খরচ করে নির্বাচন লড়তে আসে?
বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম) আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী (ডাব প্রতীক) হিসেবে আমি লড়েছিলাম। আমার দলকে প্রথমে এক কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়া, পোস্টার ব্যানার করার খাতে বরাদ্দ ছিল এই টাকা। কিন্তু দলের চেয়ারম্যানসহ জোটের ছয়জন মিলে সেই টাকা চুরি করেছেন। এ'নিয়ে দলে গন্ডগোলও দেখা দিয়েছে। এক একজন বিশ তিরিশ হাজার টাকা পেয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও খুব বেশি টাকা পাননি। ফলে অনেকে মনোনয়ন ফিরিয়ে নিয়েছেন। দল থেকে সরে গিয়েছেন। শেষ মুহূর্তে দেখা গেল সরকার আসনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা আর রাখতে পারছে না। কারণ যে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন লড়েছেন, এরা মূলত আওয়ামী লীগেরই ডামি প্রার্থী।
আরও পড়ুন: নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসের জেল! ঠিক কোন অভিযোগে কারাদণ্ড দিল বাংলাদেশের আদালত?
আমার মনে হয়েছিল, বাইরের দেশগুলি যেরকম চাপে রেখেছে বাংলাদেশকে, তাতে এইবার সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা রয়েছে। হয়তো নতুন দলগুলিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কিছু আসন ছাড়বে সরকার। কিন্তু শেষ অবধি দেখা গেল, সমস্ত আসন তারা নিজের দখলে রাখতে চায়। আর কাউকে কোনও রকম সুযোগ দেওয়া হবে না। ফলে এই নির্বাচন পুরোটাই লোকদেখানো নাটক মাত্র। এর কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। বাইরের দেশ থেকে যারা এই নির্বাচনের প্রশংসা করছে, তারাও আসলে আওয়ামী লীগের ভাড়া করা লোক।
বাংলাদেশে বিরোধীরা একজোট হয়ে প্রচুর আন্দোলন করেছেন। কিন্তু সরকারের কোনও হেলদোল নেই। কোনও কথা সরকারকে শোনানো যায়নি। বিএনপি-জামাতের সে ক্ষমতাও নেই যে তারা সরকার বদলে দেবে। একমাত্র সমস্ত বিশ্ব যদি বাংলাদেশ বয়কট করে, সমস্ত লেনদেন বন্ধ করে দেয়, তবেই হয়তো এই সরকারের পতন ঘটবে। বাংলাদেশের বিরোধীদের সেই ক্ষমতা নেই।
মাসুদ কামাল, সাংবাদিক, বাংলাদেশ
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বীজ নিহিত অতীতে। ১৯৯৬ সাল বা ২০০১ সালের নির্বাচন হয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। এমনকি ২০০৮ সালের যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, সেই নির্বাচনও হয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। কেয়ারটেকার সরকার অর্থে এমন একটা সরকার, যারা নির্বাচনের কার্যনির্বাহ করবে, কিন্তু নির্বাচনে কোনও প্রার্থী দেবে না।
১৯৯৬-এ দুটি নির্বাচন হয়। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। বিএনপি ঘোষণা করে তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। প্রথম নির্বাচনটি হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি। তখন আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনের চাপেই কেয়ারটেকার সরকারের ধারণাটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে বিএনপি। ফলে, সেই বছরেই আবার নির্বাচন হয়। এই দ্বিতীয় নির্বাচনটি হয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। তাতে আওয়ামী লীগ জেতে। এরপরে, ২০০১-এর নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন তাদের ছিল। দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন থাকলে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব। ক্ষমতায় এসে সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ। তার মধ্যে অন্যতম, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থাটি বাতিল করা।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয় বাংলাদেশে। তখন বিএনপি সহ বহু বিরোধী দল দাবি করেছিল, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। আওয়ামী লীগ সে দাবিতে কান দেয়নি। বিএনপি সেবারও নির্বাচনে যোগ দেয়নি। ফলে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি জোট। সেই শুরু। এরপর বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলে আর কিছু রইল না। ২০১৮ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেভাবে চায়, সেভাবেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নির্বাচন।
হিরো আলমের অভিযোগগুলি অত্যন্ত সত্য। নির্মলেন্দু গুণের একটি বিখ্যাত কবিতার পংক্তি— "তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর"। এইবার নির্বাচনের অবস্থাও ঠিক তাই। যে চিহ্নেই ভোট দিন জনগণ, তা আওয়ামী লীগের পক্ষেই যাবে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যে আসনে মনোনয়ন দিয়েছেন, সে আসনে আওয়ামী লীগের তিন হাজার মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন। তার মধ্যে তিনশো জনকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। সভানেত্রী তখন ঘোষণা করলেন, বাকিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী, ডামি প্রার্থী , এমনকি বিরোধী প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে না দল। ফলে নির্বাচনটা হয়ে গেল আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ।
আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা
বিরোধী হিসেবে যে দলগুলি দাঁড়িয়েছে, তাদের কোনও সাংগঠনিক পরিকাঠামোই বাংলাদেশে নেই। এরা একেবারেই অপরিচিত। আমাদের সাংবাদিকরা পর্যন্ত চেনেন না এদের সাধারণ সম্পাদক কে, সভাপতির কী পরিচয়! নির্বাচনের নামে লোকঠকানোর ব্যবসাটি ফাঁদার জন্যই এই আঠাশটির মতো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই দলগুলি আরেকটা নিয়মের সুবিধা নিয়েছে। বাংলাদেশে একটি অদ্ভুত নিয়ম রয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে, সেই প্রার্থীকে, নিজের এলাকার মোট ভোটারের এক শতাংশের সই সহ একটি দরখাস্ত জমা দিতে হবে। এই এক শতাংশ, সই সহ জানাবে যে, তারা এই দরখাস্তকারী ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়। এক শতাংশ মানুষের সই সংগ্রহ করা কি সহজ কথা! আর যিনি ভোট দেবেন, তিনি কি প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন কাকে ভোট দিতে চান! ভোটের গোপনীয়তা তাহলে আর থাকছে কই! এই ঝুঁকি সাধারণ মানুষ নেবেই বা কেন! যদি কেউ সই করেও, নির্বাচন কমিশন পুলিশ পাঠিয়ে সেই সই যাচাই করবে। সাধারণ মানুষের বাড়িতে পুলিশ গেলে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে না? এই সই-সাবুদের ঝামেলা এড়াতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এইসব ছোটখাটো দলগুলির প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান। তাতে ঝক্কি অনেক কম। দলের আদর্শের প্রতি নৈতিক সমর্থন রয়েছে বলে নয়, নির্বাচন কমিশনের বিদঘুটে নিয়ম এড়াতে প্রার্থীরা এই দলগুলির হয়ে লড়ছেন। মাঝখান থেকে এইসব ছোটখাটো দলগুলি ব্যবসা করছে। এই পদ্ধতিগুলি তৈরি করাই হয়েছে, আওয়ামী লীগকে বারবার নির্বাচন জেতানোর জন্যে। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই এখন আওয়ামী লীগের লক্ষ্য।
সুমন ভট্টাচার্য
১৯৯৬-এর নির্বাচন যখন বিএনপির অধীনে হল, তখন আওয়ামী লীগ সেই মাপের গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল, যার চাপে সংবিধান বদলাতে বাধ্য হয় বিএনপি। আবার নির্বাচন হয় বাংলাদেশে। এবং বিএনপি সরকারের পতন ঘটে। ২০১৪ থেকে ২০২৪—তিনটি নির্বাচনের বিরুদ্ধেই অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি বিরোধীরা। এখানেই হাসিনার সাফল্য।
আওয়ামী লিগ সফল ভাবে দেখাতে পেরেছে, তাঁর সমর্থন ছাড়া তাঁর বিরোধীদের কোনও ক্ষমতাই নেই। ওয়ান-ইলেভেনের পরে শেখ হাসিনা সংবিধানটাই পরিবর্তিত করে ফেললেন। সে'সময় সংবিধান পরিবর্তনের বিরোধিতা সেভাবে করতে পারেনি বিরোধীরা। রাস্তায় নেমে সেই মাপের গণ-আন্দোলন গড়ে তোলাই গেল না। ফলে একটা দ্বিমুখী সমস্যার সৃষ্টি হল। শেখ হাসিনা যে ব্যবস্থাটা তৈরি করেছেন, সেটার বিরোধিতা করার ক্ষমতা কোনও বিরোধী দলের নেই। শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ক্ষেত্রটিতে যে সাহস দেখিয়েছে, যে দাপটের সঙ্গে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছিলেন, আজ তারেক রহমানের সেই দুঃসাহসও নেই। ঢাকায় আসছন না, সমর্থকদের বারবার হতাশ করছেন তারেক। সরকারের বিরোধিতা করতে যে নূ্যনতম সাহস প্রয়োজন, তা নেই বিরোধীদের। বিরোধী দলগুলির সঙ্গে যা হয়েছে, ঠিক হয়নি। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভাবে লড়তে গেলে নির্বাচনে জিততে হবে। অথবা রাস্তায় নেমে এমন বিপুল আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, যে সরকারের পতন ঘটবে। তাছাড়া আর উপায় নেই। চল্লিশ শতাংশ লোকের ভোটে যে সরকার এসেছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করতে গেলে ষাট শতাংশ মানুষকে একত্রিত করে রাস্তায় নামতে হবে। শুধু ভিডিও বার্তা দিলে কাজ হবে না। আর তা না হলে হাতের পাঁচ রইল সেনা অভ্যুত্থানের বিকল্প পথ। সেটা কখনওই গণতান্ত্রিক পথ হতে পারে না। বিএনপির চরম ব্যর্থতা এই যে, হাজার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার সদ্ব্যবহার করতে পারল না তারা।
দক্ষিণ এশিয়ার ফোন বুথ সামলানোর ক্ষমতা আমেরিকার নেই। বিদেশিদের দ্বারা বাংলাদেশ বয়কটের আশাও বৃথা আশা। বাইরের দেশগুলোর স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। তারা কেন সেই স্বার্থ ত্যাগ করবে! ফলে, বাংলাদেশে স্বৈরাচারের বিরোধিতা করার একমাত্র পথ, তারেক রহমানকে এ'দেশে এসে আন্দোলন করতে হবে। তার জন্য জেল হলে হবে। রাজনীতি করতে গেলে জেলে যেতেই হবে। তারপরেও আপনি কতটা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন, তার উপরে নির্ভর করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
সম্বিত পাল
ভারতের রাজনীতিতে এখন যে ঝোঁকটা দেখা যাচ্ছে, তাতে একনায়কতন্ত্রের চিহ্নগুলি স্পষ্ট ফুটে উঠছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এই ঝোঁকটিই এখন স্বাভাবিক ঝোঁক। ফলে বাংলাদেশেও তাই করছেন শেখ হাসিনা। এই ধরনের সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন প্রথমেই, তারা বিদেশি রাষ্ট্রের সহযোগে পরিকাঠামোর উন্নতির উপরে জোর দেয়। এরপরে একজন বহিরাগত শত্রুর ধারণা গড়ে তোলে তারা। এই শত্রুর ধারণা সামনে রেখে চলে জনগণের আবেগ নিয়ন্ত্রণ। সমস্ত কায়েমী স্বার্থ এই পথেই এগোয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে; পশ্চিমবঙ্গ পারেনি : কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
বিদেশি রাষ্ট্রেরা কেন বাংলাদেশ বয়কট করবে? তাদের কোনও স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে না। বরং অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করছে তারা বাংলাদেশ থেকে। চীন-ভারত-আমেরিকা সবার স্বার্থ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। ভারতবর্ষ চাইবেই জামাত বা বিএনপি যাতে সরকারে না আসে বাংলাদেশে। বিএনপি-জামাতকে সমর্থন করলে একটি ইসলামী মৌলবাদী শক্তিকে প্ররোচনা দেওয়া হবে, যা মোদী-শাহ'র হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। এইসব নানা কারণে বিদেশি শক্তিগুলি বাংলাদেশ বয়কট করবে না।
এত আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও সংগঠিত বিরোধী শক্তি নেই। ফলে শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে কেউ নেই মানুষের কাছে। ভারতের এখন যা সমস্যা ঠিক সমস্যাই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও। এই অবস্থায় অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হবেন। তাদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যাবে, তখন হয়তো তারা বিদ্রোহ করবেন। সেই বিদ্রোহ যতদিন সামাল দিতে পারবেন একনায়কতন্ত্রী স্বৈরাচারী নেতা, ততদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। এ'ছাড়াও হাসিনার বয়েস এখন ৭৬। তাঁর পরে কে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন—তার উপরেও নির্ভর করবে কতদিন ক্ষমতায় থাকবে আওয়ামী লীগ।