গান থামালে অভিনয়! কেন হিরো আলমকে নস্য়াৎ করতে পারবে না বাংলাদেশ
হিরো আলম সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, তাঁকে বাংলাদেশে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং গান গাওয়া বন্ধ করতে বলেছে।
যখন একজন বাংলাদেশি নাগরিক ভারত ভ্রমণ করে, তখন তাকে অনেকবারই একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। হিরো আলম কি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টারদের মধ্যে একজন?
এমনকী, বাংলাদেশে গুগল সার্চেও শুধু 'হিরো' লেখাতেই ভেসে আসে একঝাঁক মোস্টলি কমন আস্কড প্রশ্নের তালিকা, যাতে শুধু লেখা, হিরো আলম কে? কেন এত জনপ্রিয় সে? তাঁর ছবি, তাঁর ভাইরাল গান, তাঁর সাইকেলের দাম, তাঁর প্রাথমিক জীবন এবং কর্মজীবন, কীভাবে তাঁর মতো জনপ্রিয় হওয়া যায়, এইসব নিয়েই জমজমাট ইন্টারনেট।
আশরাফুল হোসেন আলম, একজন ইন্টারনেট সেনসেশন, যিনি হিরো আলম নামে পরিচিত, একজন বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সার মিউজিক ভিডিও মডেল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় অভিনেতা। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সদস্য নন, যদিও তিনি একজন স্বাধীন শিল্পী হিসেবে কাজ করেন যিনি সামাজিক প্ল্যাটফর্মে ভিডিও শেয়ার করেন। জীবনের প্রথম দিকে, আলম সিডি বিক্রির কাজ করেছিলেন কিন্তু পরে স্যাটেলাইট টিভি সংযোগের ব্যবসা শুরু করেন। শখের বশে মিউজিক ভিডিও করা শুরু করেন আলম।
আরও পড়ুন: লক্ষ লক্ষ ভক্ত, ভিডিও করে কোটিপতি! বাংলার ইউটিউবাররা যে নতুন পথ দেখাচ্ছেন
২০১৫ সালে তাঁর কিছু মিউজিক ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, এবং আলম অনলাইন ট্রোলিংয়ের একটি জনপ্রিয় লক্ষ্য এবং বাংলাদেশে মিমসের একটি জনপ্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। এখন তার ফেসবুকে দুই মিলিয়ন ফলোয়ার এবং ইউটিউবে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। আলম তাঁর পড়াশোনা শেষ করেননি, ১০ বছর বয়সে, তাঁকে তাঁর নিজের বাবা-মা পরিত্যক্ত করেছিলেন, পরে আব্দুল রাজ্জাক নামে একজন তাঁকে দত্তক নেন।
হিরো আলম সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, তাঁকে বাংলাদেশে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং গান গাওয়া বন্ধ করতে বলেছে। আলম বলেছিলেন যে, পুলিশ তাঁকে 'মানসিকভাবে নির্যাতন' করেছিল এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের শাস্ত্রীয় গান পরিবেশনের জন্য একটি 'ক্ষমা চাওয়ার' বন্ডে সইও করিয়েছিল। তিনি আরও বলেন যে, পুলিশ তাকে তাঁর নাম থেকে ‘হিরো’ নামক শিরোনাম নামিয়ে দিতে বলেছে, যে দাবি পুলিশ প্রত্যাখ্যান করে।
সম্প্রতি আলোচিত-সমালোচিত তারকা হিরো আলমকে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান না গাইতে মুচলেকা নেওয়ার ঘটনা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও স্থান পেয়েছে। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন-বিবিসি ও এজেন্সি ফ্রান্স প্রেস-এএফপি হিরো আলমকে পুলিশের তুলে নেওয়া নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অপমান-অপদস্থ করা-সহ রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান না গাওয়া, নাম থেকে ‘হিরো’ শব্দ বাদ দেওয়া নিয়ে পুলিশি কর্মকাণ্ডের ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এতে একরকম বিব্রত হয়ে পড়েছেন খোদ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, হিরো আলমকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে এই বিতর্ক হতো না।
গত ২৭ জুলাই ভোরে রামপুরার নিজস্ব কার্যালয় থেকে হিরো আলমকে তুলে আনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে প্রায় ৮ ঘণ্টা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মূলত একটি খণ্ড নাটকে পুলিশ কনস্টেবলের পোশাক পরে ডিআইজি-র ভূমিকায় অভিনয় করা নিয়ে তাঁকে তুলে আনা হয়। তবে ডিবি কার্যালয়ে পুলিশ তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান না গাওয়া-সহ তাঁর নাম থেকে ‘হিরো’ শব্দ বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বলে অভিযোগ আশরাফুল আলম সাঈদ ওরফে হিরো আলমের।
হিরো আলমকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান গাইতে নিষেধ করায় গোয়েন্দা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। একই সঙ্গে নাম থেকে হিরো শব্দটি বাদ দেওয়া ও চেহারা নিয়ে তাচ্ছিল্য করার বিষয়টিকে বর্ণবাদী আচরণ বলে আখ্যায়িত করেন অনেকেই। এরই মধ্যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পাওয়ায় অনেকটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে পুলিশ।
যদিও আলমের মনে হয়, তিনি একজন নায়ক। তাই তিনি হিরো আলম উপাধি নেন। "সকাল ৬টায় পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে আট ঘণ্টা আটকে রাখে। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি কেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান গাই,” ৩৭ বছর বয়সি আলম একথা বলেন। ঢাকার প্রধান গোয়েন্দা হারুন-উর-রশিদ এসব দাবির জবাবে বলেন, যথাযথ অনুমতি ছাড়াই ভিডিওতে পুলিশের ইউনিফর্ম পরার কারণে আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রধান গোয়েন্দা আরও যোগ করেছেন যে, তাঁরা আলমের বিরুদ্ধে পুরনো শাস্ত্রীয় গান নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছেন।
“আমরা তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। আলম সম্পূর্ণরূপে গানের ঐতিহ্যগত স্টাইল পরিবর্তন করেছেন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত দিয়েছেন যে তিনি এটি পুনরাবৃত্তি করবেন না,” হারুন এএফপি-কে একথা বলেন।
পুলিশ যেভাবে হিরো আলমের রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি গাওয়া বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল, তা নিয়ে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়াতেও তমুল তর্কবিতর্ক হচ্ছে। হিরো আলম নিজে এইটাকে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’-য় হস্তক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর সমর্থক ও অনুগামীরা তো বটেই, তাঁর গান শোনেন না, এমন অনেকে মন্তব্য করেছেন, "কে কীভাবে গান গাইবে সেটা কি রাষ্ট্র ঠিক করে দিবে না কি? যার ভালো লাগবে না তার না শুনলেই হলো, আর হিরো আলম তো অশ্লীল কিছু গাইছেন না!”
আসলে হিরো আলমকে পুলিশ ডেকে পাঠিয়ে যেভাবে হুমকি দিয়েছে এবং তিনি আর রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান গাইবেন না বলে মুচলেকা লিখে নিয়েছেন, তাতে অনেকেই ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম’-এর গন্ধ পাচ্ছেন। সেই কারণেই এই ঘটনার পর বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে তিনি, যাঁরা হয়তো তাঁর কনটেন্ট তেমন পছন্দই করতেন না।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, আলম একটি নতুন গান তৈরি করেন, যাতে দেখানো হয়েছে তাঁকে কারাবন্দি করা হচ্ছে এবং তিনি ফাঁসির অপেক্ষায় রয়েছেন।
আলম বর্তমানে তাঁর স্ত্রী সুমি এবং তাঁদের সন্তান আলো ও কবিরের সঙ্গে বগুড়ার অদূরে এরুলিয়ায় থাকেন। যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। এক শ্রেণির মানুষ তাঁর সমালোচনা করে, তারা ভাবে যে, বাংলাদেশ থেকে শুরুতে তাঁর ডিসলাইনে প্রচার করা মিউজিক ভিডিও নিয়ে তামাশা করে ধীরে ধীরে সকলের কাছে ট্রোলাররাই তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ায়। সে একজন নির্দোষ, খ্যাতিপাগল উৎসাহী ছাড়া আর কিছু নয়।
সেখানেই আবার অন্যদিকে আরেক শ্রেণির মানুষও আছে, যারা বলে যে, আলম যা করেন, তা করতে সফল হওয়ার জন্য, তাঁর আবেগ অনুসরণ করার জন্য এবং অবশেষে কিছু হওয়ার জন্যই সে কৃতিত্ব পেয়েছে। আরও বলে যে, আলমের জীবন থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলো, “তুমি যা, তার জন্য কখনওই লজ্জিত হয়ো না।"
আলোম জানান, তিনি অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এবং এছাড়াও ২০১৮ সালের বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে নিরপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে ৬৩৮ ভোট পেয়েছিলেন। চলচ্চিত্রে অভিনয় করা আলমের স্বপ্ন ছিল।
আলম এখনও পর্যন্ত অনেক সামাজিক মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে কাজ করেছেন, যার মধ্যে আছে দেশের সবচেয়ে ভাইরাল গান কাঁচা বাদাম, যা গেয়েছিলেন ভুবন বদ্যাকর। তাছাড়াও আছেন স্যান্ডি সাহা, যাঁকে এমটিভির রোডিজ এক্সট্রিম নামের রিয়্যালিটি শো তে দেখা গিয়েছিল। রানু মন্ডলের সঙ্গেও গান গেয়েছেন হিরো আলম।
'মার ছোক্কা' একটি বাংলা চলচ্চিত্র, যা স্বপ্নিল খান পরিচালিত করেন, সেখানে হিরো আলম কে অভিনয় করতে দেখা যায়। আলম-এর ওপর ভিত্তি করে একটি হিন্দি নাটক, এনএসডি-স্নাতক মহেশ রূপরাও ঘোড়েশ্বর পরিচালিত, ২০১৯ সালে আহমেদাবাদ এবং মুম্বইতে মঞ্চস্থ হয়েছিল, যা একটি কাল্পনিক বায়ো-প্লে ছিল।
ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত আলম একটি ফিচার ফিল্মেও অভিনয় করেছেন। মানুষ প্রায়ই বলে যে, আলম মূলত তাহের শাহের মতো, যিনি একজন পাকিস্তানি গায়ক, ২০১৩ সালে একটি গান, আই-টু- আই রিলিজ করে রাতারাত ইন্টারনেট সেনসেশন হয়েছিলেন।
বগুড়ার যুবক আশরাফুল আলমের ব্যস্ততা এখন অভিনয়, প্রযোজনা, আর গান নিয়ে। ফেসবুকে আলমের ফলোয়ার ১৯ লাখ। ইউটিউব চ্যানেল ‘হিরো আলম’-এ অফিসিয়াল সাবস্ক্রাইবার ১৩ লাখেরও বেশি। এই দুই মাধ্যম থেকে প্রতি মাসে তাঁর আয় হয় প্রায় দেড় লাখ, কোনও মাসে ৩ লাখ। আবার কোনও কোনও মাসে ৫০ হাজার টাকা।
বর্তমানে হিরো আলম অভিনীত ও প্রযোজিত ‘টোকাই’, ‘বউ জামাইয়ের লড়াই’ ও ‘নষ্ট হওয়ার কষ্ট’ সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায়। নতুন করে একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আসছেন তিনি। যার ঘোষণা কয়েক দিন আগে করেছেন।