মফস্‌সলের রান্নাঘরের খুনসুটির দুলুনি ছিল প্রতুলদার উচ্চারণে

Pratul Mukhopadhyay: মাসিমা, ঠাকুমারা যেভাবে দুলে দুলে গান গাইত নাড়ু পাকানোর সময়— একেবারে সেইরকম একটা দুলুনিতে গান গাইতে পারতে তুমি প্রতুলদা!

সে আবার কী? রকস্টার, বুদ্ধিজীবী, বিদগ্ধ অ্যাক্টিভিস্ট, "এই তো প্রায়" দার্শনিক সব এক টেবিলে আড্ডা মারবেন? সত্যি মাইরি! কুঁজোরও ইচ্ছে করে চিৎ হয়ে শোওয়ার, আর গামছারও ইচ্ছে করে ধোপা বাড়ি যাওয়ার! ক্লাস বলে একটা কথা আছে তো?

এরকম হয় না এমনিতে, যদি না পাশের টেবিলে কেউ একটা পরিচিত গান ধরেন কিঞ্চিৎ টলমলে গতিতে,

"আমি বাংলায় মাল খাই, আমি শুধুই বাংলা খাই"

রেগে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল পাশের টেবিলের ভিজিটররা। খালাসিটোলা জমজমাট! ভিজিটররা সাধারণ নন। তাই পঞ্চার এই গানের সঙ্গে পরিচিত নন। এই গান পঞ্চা রোজ গায়। রোজ। পরিবর্তন এসে যাওয়ার পর থেকেই পঞ্চার এই পরিবর্তন। তারপর পঞ্চাকে কেলিয়ে পাট করে একই টেবিলে গান ধরলেন,

"বাংলা আমার তৃষ্ণার জল
তৃপ্ত শেষ চুমুক
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ
আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই
আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন
আমি বাংলায় বাঁধি সুর
আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর
বাংলা আমার জীবনানন্দ
বাংলা প্রাণের সুখ
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ"

পঞ্চাও মার খেয়ে সুরে সুর মিলিয়ে গাইছিল ভয়ে ভয়ে।

গান পারে। থেকে যেতে পারে। গায়ক-নায়ক-জাজমেন্ট-সমালোচক-ক্রিটিক বা আমার মতো অর্বাচীন পারে না। গান পারে। ভালো লোকেরা ভালো থাকতে পারে না। বিপ্লবীরা লোভী হয়ে ওঠেন। দর্শনিকরা দর্শন ছেড়ে সং সেজে ঢং করে স্টেজে উঠে 'ছিছিকাকা ছিছিকাকা একাপেলা' করতে পারেন। সাবঅল্টার্নদের প্রিয় অ্যাক্টিভিস্টরা স্টেজে উঠে ভগবতী পুরস্কার নিয়ে মার্কিন ইংরেজিতে 'সো কাইন্ড অফ ইউ' বলে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দিতে পারেন প্রাক্তন মন্ত্রীর সঙ্গে তোলা ছবি।

গান তেমন না। গান বিমূর্ত। গান নির্যাস। একসঙ্গে। এক মুহূর্তে।

গুলিয়ে যাচ্ছে সব। অহংকার, উচ্ছ্বাস, ভয়, ক্ষমতা; জীবন থেকে মৃত্যুতে, গানে গানে। শেষ হইয়াও হইল না শেষ। প্রতুলদা! চলে গেলেন? সব গুলিয়ে গেল যে! একটা ছোট পাহাড়ি নদীতে যেমন গুলে যায় পৃথিবীর আদিম অ্যামিবা ভাইরাসগুলোর ফসিল। তারপর সদ্য গজিয়ে ওঠা শ্যাওলাগুলো পাথরের খাঁজে খাঁজে ওদের অসহায়ী বাসা তৈরি করে দেয়। জল গোড়াতেই গড়াতে শুরু করেছিল। তালে, ছন্দে, আপন খেয়ালে। তখন থেকেই সুর গড়াচ্ছে। আপনি ধরতে পেরেছিলেন সেই সুরকে।

চার্লি চ্যাপলিনের প্রেমকে ছোট করতে দেয়নি বাংলা গান। গলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না মধ্যবিত্তের। তাই সেই ছোট্ট দু'টি পা গানটির যন্ত্রানুসঙ্গে প্রেম-প্রেম-প্রেম বলে মুখেই একটা গিটার সোলো বাজানো আছে। প্রেম শব্দটাই যে পার্কাসিভ এটা আর অনুভব করে না দক্ষিণ কলকাতা। নব্বইয়ের দশকে যখন 'কমিউনিস্ট' কথাটা পাশ্চাত্যে উচ্চারণ করাই ব্লাসফেমি, ঠিক তখন বেহালা বা টালিগঞ্জের বাচ্চাদের মনে চার্লি চ্যাপলিনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল খনা গলার এই প্রিংপ্রিং প্রেম-প্রেম। বন্ধু জয়রাজ ভট্টাচার্য এই ব্যাপারটা এখনও অভিনয় করে দেখায়।

নদীটা কিন্তু আজও বেশ ঠান্ডা আর খরস্রোতা। তুবড়ে যাওয়া ওয়াই-ওয়াইয়ের প্লাস্টিকের ঠোঙা, এক টুকরো লাল সিল্কের ছেঁড়া কাপড়, গাছ থেকে পড়া পাইনকোন সব মিলে মিশে গোল চক্কর কাটছে একটা তিব্বতি গ্রামের ঘাটের পাশে। এখনও জল বাড়েনি। এখন ক'দিন ওগুলো ওখানেই থাকবে। একটি পূর্ব ইউরোপিয় কিশোরী গিটার বাজিয়ে we shall overcome গাইছে। বাঙালি সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি ঝগড়া করে নদীর ধরে এসে বসে বাংলায় গলা মেলানোতে চমকে উঠল কিশোরী। "তুমি এই গান টা জানো?" হ্যাঁ জানে। এও জানে তিব্বত এখন চিন। বলতে সাহস হয় না। "আমার বাবা কিন্তু লেনিনপন্থী ছিলেন!" কিন্তু স্লোভাক মেয়েটির কাছে বাবার রাজনৈতিক পরিচয় তো দূরের কথা, কিছুই বলার সাহস নেই মেয়েটির।

একবার গিটারটা দেবে? একটা গান শোনাব?

তুমি গিটার বাজাতে পারো?

তারপর অনেকগুলো গান, কোনওটা হ্যারি বেলাফন্টের গানের অনুবাদ, কোনওটা রোবসনের।

তোমার হাতে ওই লাল চুড়িটা সুন্দর। কোথায় পাব অমন একটা চুড়ি?

এমা, ওটা এমনি এমনি পরে নাকি? বিয়ে করলে করলে পরতে হয়।

তাই? আমি স্লোভাক নই পুরোপুরি। আমার বাবা আর্জেন্টিনার মানুষ। পালিয়ে এসেছিল জার্মানিতে ৭০-এর দশকে। আমার মাকে বিয়ে করেছিল। আমার বাবা কমিউনিস্ট ছিল। বাবা এখন আর বেঁচে নেই। মার জন্য ওরম একটা লাল চুড়ি কিনে নিয়ে যাব।

এবার মেয়েটি নির্দ্বিধায় ডি মাইনর কর্ড ধরে গান ধরে,

লোহার সাঁকো টাটুর বুকে হিম শীতল
পথেই হই পার
তুষার ঝড়ে নিযুত শিখর
রোদে ঝলোমল
মিঙ পাহাড়, মিঙ পাহাড়
মিঙ পাহাড় লাফিয়ে পার লাল ফৌজ আহা
হাসির মেজাজ সবার

থাক না হাজার অযুত বাধা
থাক না হাজার অযুত বাধা
দীর্ঘ দূরযাত্রার কিসের ভয়?

মৃত্যুর মুখে খুশির মেজাজ রাখতেই হবে যে। আর কবে খুশি হব নাহলে। গানে যেভাবে প্রতুলদা লাইনটি গেয়েছেন, তা কপি করতে যাওয়া বৃথা। ওই খুশির মেজাজ আমার আপনার জন্য নয়। আমরা যাঁরা রিল হাতড়াই কাজের ফাঁকে ফেসবুকে, তাঁরা কি সত্যিই ভালোবাসি পিকসো-বুনুয়েল-দান্তে?

গত ১ মাস আমাদের কারও ইসার নদীর পাড়ে যাওয়া হয়নি। এখানে এখন -৩°। নাকটুকু বেরিয়ে থাকলেও ঠান্ডা লাগে। মিউনিখে ফ্লু হচ্ছে সবার। একা একা ঘরে বসে রেকর্ড করা, ৩০-এর দশকের প্যারিস শহরে রেডিওতে চলা জোসেফিন বেকারের গান ট্রান্সক্রাইব করা, এই এখন আমার আর কৌস্তভের আগামী দু'মাসের কাজ। রান্না করতে করতে মার কথা মনে পড়ে। বরিশাল শহরের স্মৃতি মা ভুলে যেতে চেয়েছে। ভুলতে পারেনি। মা গুনগুন করে গান করে রান্না করতে করতে। মায়ের মা-ও নাকি এমনি করতেন। আমিও করি। এই ক'দিন আগেই আলু কাটতে কাটতে একটা সুর গুনগুন করতে করতে দেখলাম কখন একটা পরিচিত গানে চলে এসেছি।

আলু বেচো ছোলা বেচো বেচো বাকরখানি
বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি

নিজেই কেমন একটা রাগ করে গানটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর আবার কিছুক্ষণ পরে বিরক্তিকর সুর আবার গেয়ে উঠলাম। কিছুটা ইচ্ছে করেই Scarborough Fair গানটায় চলে এলাম। হঠাৎ স্ট্রাইক করল মাথায়, কত কঠিন এমন সহজ সুর বানিয়ে ফেলা যা মাথা থেকে বেরোতেই চায় না। যে প্রতুলদা এত কঠিন-কঠিন অথচ মজার সুরের এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, তিনিই এমন অপূর্ব প্রাইমাল সুর করতে পারতেন।

মার থেকে বরিশালের গল্প শুনতে চাইনি কখনও। মায়ের বরিশাল বলতেও আমার কাছে কয়েকটা গান আর ছোটবেলার নাড়ু চুরি করার গল্প। ৭১ নিয়ে কথা বলা বারণ। আমি জানি, প্রতুলদাও বরিশালের মানুষ। প্রতুলদার আরেকটা গান আমি গুনগুন করার জন্যই রেখে দিয়েছি। মায়ের কথা ভাবলে গাই।

"দুইজনাই বাঙালি ছিলাম দেখো দেখি কাণ্ডখান
তুমি এখন বাংলাদেশী,আমারে কও ইন্ডিয়ান!"

লেখাটি অবশ্যই আমার মতো কয়েক কোটি মানুষের জন্য দু'পারেই চির প্রাসঙ্গিক, কিন্তু সুর! এমন সুর যে আমি কোত্থাও শুনিনি। রান্নাঘরে কান পাতলে মাসিমা, ঠাকুমারা যেভাবে দুলে দুলে গান গাইত নাড়ু পাকানোর সময়— একেবারে সেইরকম একটা দুলুনিতে গান গাইতে পারতে তুমি প্রতুলদা! যেমন আলি ফারকা তুরে সোজা পশ্চিম আফ্রিকার গ্রামের ধান ভানার সুর সোজা গানে নামিয়ে আনতে পারত, তেমন মধ্যবিত্ত মফস্‌সলের রান্নাঘরের খুনসুটির দুলুনি ছিল তোমার উচ্চারণে!

আলী ফারকা তুরেকে শুনে মার্কিন বিশ্ব সংগীতের দ্বিগগজরা আফ্রিকার ব্লুজ আর্টিস্ট আখ্যা দেওয়ায় আলী তাঁর বিখ্যাত অমলিন হাসিটা হেসে বলেছিলেন, অত নামকরণ বুঝতে চাই না, এসব কেবল পৃথিবীর কর্মরত মানুষের সুর।

আজকাল শুনছি, টাকা থাকলে পৃথিবীর বাইরে যাবে মানুষ থাকতে। তাতে নিশ্চয়ই দু-একজন বলবেন, তাঁরা প্রতুলদার মতো এন্টারটেইনার নিয়ে যেতে চান। সমস্যা যত গিয়ে দাঁড়ায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুর আর গায়ন ভঙ্গিতে। ওরম গায়কী আর আছে কি? ওটাকে আদৌ গায়কী বলা যায়? নাকি পুরোটাই আসলে সাহস! এত দুঃসাহস পেতেন কী করে? এরকম গানের কথা লেখার, এরকম মৌলিক উচ্চারণে গান গাওয়ার সাহস? অথচ এক মিনিটের জন্যও সুর না ছেড়ে!

আসলে তা না। নদীটা গুলিয়ে গুবলেট হয়ে গিয়েও বইছে। কেউ বলে গঙ্গা বুড়ি কেউ বলে Old Man river! নানা ঘাট পেরিয়ে বয়ে চলেছে নদীটা। প্রত্যেক ঘাটেই নানা অসুবিধা, হয়রানি পেরিয়ে। ওই ঘাটে যাঁদের অসুবিধাগুলো আমার আপনার চেয়ে একটু বেশি, তাঁদের নিয়ে ভাবনা ব্যাপারটাই অসুবিধার!

তা বলে কি অসুবিধা নেই? আছে! আপনি বললেই মেনে নেব, এমনটা ভাববেন না! কারণ অসুবিধা আছে! অসুবিধা থাকবে! অসুবিধা ছিলও!

দলীয় রাজনীতির কথা বলছি না এখানে! রেসিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধের মূল রাজনীতির কথাই বলছি। একটা সরল উদাহরণ দিচ্ছি। আচ্ছা বলুন তো, আমাদের চারপাশের বায়ুমণ্ডল যে পরিমাণ চাপ আমাদের শরীরের ওপরে দেয় এবং ক্ষণে ক্ষণে তার যে ধরনের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে তারপরও আমরা বেঁচে আছি কেন? ফেটে যাচ্ছি না কেন? আমাদেরও ধমনীতে বয়ে চলা রক্ত ভেসেলের দেওয়ালে অনবরত প্রয়োজন মতো ততটাই রেসিস্ট্যান্স বা চাপ সৃষ্টি করে যা উল্টোদিকের চাপকে প্রতি মুহূর্তে কাউন্টার করতে করতে যায়। প্রতিরোধ বা রেসিস্ট্যান্স শরীরের সত্য। প্রতিরোধ পার্মানেন্ট। প্রতিরোধ আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। বাইরের বায়ুমণ্ডলের চাপ কিন্তু পাল্টায়। ধমনীর প্রতিরোধকে ক্রমাগত নিজের পাল্টা চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে যেতে হয়।

তবে, সাপোর্ট পার্মানেন্ট নয়। সমর্থন সাময়িক। তার কারণ, প্রতিরোধকে পার্মানেন্ট অবস্থানে রাখতেই হবে। পার্মানেন্ট সাপোর্ট মানেই দালালি, চাটুকারিতা। মৃত্যু! রেসিস্ট্যান্সকে বাঁচিয়ে রাখুন। প্রতুলদা বা আলী বা সীগার বা রোবসন বা লোরকা বা গৌতম এঁরা কেউই অমরত্বের প্রত্যাশা নিয়ে গান লেখেননি। লিখেছেন নির্মাণের খাতিরে। এইটুকুই প্রতুলদার থেকে শিখেছি, পেছনে দাঁড়িয়ে।

শ্লোগান দিতে গিয়ে
আমি চিনতে শিখি
নতুন মানুষজন।
.
শ্লোগান দিতে গিয়ে
আমি বুঝতে শিখি
কে ভাই, কে দুশমন।
.
হাট মিটিংয়ে চোঙা ফুঁকেছি
গেট মিটিংয়ে গলা ভেঙেছি
চিনছি শহর গ্রাম।
.
শ্লোগান দিতে গিয়ে
আমি সবার সাথে
আমার দাবি
প্রকাশ্যে তুললাম।
.
শ্লোগান দিতে গিয়ে
আমি ভিড়ে গেলাম গানে
গলায় তেমন সুর খেলে না,
হোক বেসুরো পর্দা বদল,
মিলিয়ে দিলাম সবার সাথে
মিলিয়ে দিলাম গলা
ঘুচিয়ে দিয়ে একলা সিঁড়ে চলা।
.
জুটলো যত আমার মতো,
ঘরের খেয়ে বনের ধারে
মোষ তাড়ানোর উল্টো স্বভাব
মোষ তাড়ানো সহজ নাকি
মোষের শিং এ মৃত্যু বাঁধা
তবুও কারা লাল নিশানে
উস্কে তাকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে
শ্লোগান।
.
শ্লোগান দিতে গিয়ে
আমি বুঝেছি এই সার
সাবাশ যদি দিতেই হবে
সাবাশ দেব কার।
.
ভাঙছে যারা ভাঙবে যারা
খ্যাপা মোষের ঘাড়।"

আমার শিক্ষা বলে প্রশ্ন করো, সব কিছুকে। নিজেকে দিয়ে শুরু করো। শাসক বদলেছে। বদলাবে। সর্বত্র।

More Articles