স্বৈরাচারী এরশাদকেও গদি ছাড়তে হয়! বাংলাদেশে গণআন্দোলন কি আর সেই ক্ষমতা রাখে?
Bangladesh Dictators: ১৯৯০-এর ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতরা পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসক নেতা ডঃ শামসুল আলম মিলনকে হত্যা করে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর, গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়েছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ৩ ডিসেম্বর ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন দেশের সঙ্কট সমাধানের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ নেবেন। ১৯৯০-এ জরুরি অবস্থা এবং কার্ফিউয়ের মতো কঠোর পদক্ষেপের পরও এরশাদ বিরোধী আন্দোলন দমানো যায়নি। যখন আন্দোলন জোরালো হচ্ছিল, এরশাদ তখন সেনা সদরকে সামরিক আইন জারি করার প্রস্তাব দেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিনের বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে, প্রেসিডেন্ট এরশাদের সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর অফিসাররা মেনে নেননি। শেষমেশ, ৪ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর আব্দুস সালাম প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগ করা উচিত বলে জানিয়ে দেন। কীভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন এরশাদ? কেনই বা প্রেসিডেন্ট এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হলো?
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসেন তিনি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে, সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তখন জেনারেল এরশাদ সেনাপ্রধান ছিলেন। জিয়াউরের হত্যার ৯ মাস পর সামরিক শাসন জারি করেন এরশাদ। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ৯ মাস ধরে ক্ষমতা দখলের গুটি সাজাচ্ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান, হঠাৎই কোনও কিছু হয়ে যায়নি।
২৪ মার্চের অভ্যুত্থানে, বিচারপতি সাত্তার সরকারের নেতাদের দুর্নীতি ও দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে মূল ইস্যু হিসেবে সামনে আনেন। তখন এরশাদের সিদ্ধান্তেই মন্ত্রিসভা থেকে কিছুজন সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্যই আড়ালে জেনারেল এরশাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। ক্ষমতা দখল করতে সরকারের ভেতরেই অস্থিরতা তৈরির কৌশল করেছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধার বিভেদ তৈরি করেছিলেন।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন, মৃত্যু নিয়ে কেন চুপ হাসিনার ‘বন্ধু’ ভারত?
প্রয়াত রাজনীতিক মওদুদ আহমেদ 'গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ, প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন' বইয়ে, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতির বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন,
"১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ সামরিক অধিনায়কেরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ও কৌশল চূড়ান্ত করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১২৮ দিন এবং জিয়াউরের মৃত্যুর ২৭০ দিন (৯ মাস) পর ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী চূড়ান্ত ক্ষমতা দখল করে।"
জিয়াউর হত্যার দিনই এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারতেন কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত তিনি নেননি। মওদুদ আহমেদ তাঁর বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের দিনই রাষ্ট্রক্ষমতা নিলে জনগণের মনে সন্দেহ হতে পারত। তাঁরা ওই দিনের ঘটনার দায়ভার নিতে চাননি। তাই ক্ষমতা দখলের সুযোগ থাকলেও, সেদিন তা করেননি। আহমেদ আরও লিখেছেন,
"রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৩ দিনের মাথায় বিচারপতি আবদুস সাত্তার ৪২ জন সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। এর পরদিনই এরশাদ ঢাকার সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে একটি বিবৃতি মারফত সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার সম্পাদকদের কাছে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখা করেছিলেন।"
এক দলের মত, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি গোপনে হয়েছে। অন্য আরেক দল বলেন, তাঁর ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি নাকি অনেকটাই প্রকাশ্যে ছিল। ১৯৮১ সালের ২৩ মার্চ সেনা সদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যান। পরদিন ভোরেই সামরিক শাসন জারি করেন এরশাদ। ২৪ মার্চ বিকেলেই রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণে বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশজুড়ে সামরিক আইন জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সাত্তারের ভাষণের পরই এরশাদও ভাষণ দেন। সামরিক শাসন জারি করার ঠিক ১০ ঘণ্টা পর এরশাদ দেশবাসীকে জানান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে সাধারণ নির্বাচন হবে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর, তেত্রিশ বছর আগে সেই তীব্র গণআন্দোলনে বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের পতন হয়। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের আরেকটি গণআন্দোলন তিনি নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। সেই বছর পুলিশের গুলিতে নূর হাসানের মৃত্যুর পর আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। বুকে-পিঠে 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগান লিখে আন্দোলনে নামা নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। এই তরুণের মৃত্যুর আগের সেই ছবি এখনও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক। তিন বছর পর গড়ে ওঠা গণআন্দোলন ও বর্তমানে বাংলাদেশের চলমান গণআন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে নূর হোসেনের প্রতিবাদ। ১৯৮৭ সালে হোসেনের গুলিবিদ্ধ লাশ কারাগারে ফেলে রাখা হয়েছিল। পরে পরিবারকে না জানিয়েই হোসেনকে কবর দেওয়া হয়। সেদিন বাংলাদেশের জুরাইন কবরস্থানে হোসেনের সঙ্গে আরও তিনটি লাশ কবর দেওয়া হয়। কিছুদিন পর হোসেনের পরিবার লাশ কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে দেখতে যায়। চারটি কবরের মধ্যে কোন কবরটি তাঁদের ছেলের, যিনি কবর দিয়েছেন ঠিক বলতে পারছিলেন না। শেষে স্লোগানের কথা মনে করেই কবর চিনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যে স্লোগানের জন্য হোসেনের হত্যা করা হয়, সেই স্লোগানই তাঁর কবর চিহ্নিত করেছিল।
১৯৯০-এর ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতরা পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসক নেতা ডঃ শামসুল আলম মিলনকে হত্যা করে। অভিযোগ ওঠে, ডঃ মিলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দখল করার চেষ্টা করেছিলেন। এর জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়। ডঃ মিলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর দিয়ে রিকশা করে যাচ্ছিলেন, তখনই তাঁকে গুলি করা হয়। মিলনকে হত্যার পর যখন আন্দোলন তুঙ্গে, প্রেসিডেন্ট জেনারেল তখন সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে চেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীদের উপর যথেষ্ট চাপ দিয়েছিলেন। এই সকল কিছু আন্দোলনের 'টার্নিং পয়েন্ট' হয়ে দাঁড়ায়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীদের সমর্থনও কমে আসছিল। ক্ষমতা ধরে রাখতে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্মও ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তাঁর হাত ধরেই পরিবর্তন হয়।
অন্যদিকে, জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর, আন্দোলনকারী দলগুলি কী করবে, সেই নিয়ে একটি ফর্মুলার কথা ভাবা হয়েছিল। ফর্মুলা অনুযায়ী, সাধারণ নির্বাচনের আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার কথা ছিল কিন্তু সেই সরকারের প্রধান কে হবে তা নির্ধারিত হয়নি। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের পর, আন্দোলনকারী দলগুলি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য বেছে নেয়। আওয়ামী লিগ এবং বিএনপি-র রাজনৈতিক জোট একইসঙ্গে আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছিল। জামায়াতে ইসলামিও আন্দোলনে যোগদান করেছিল। দুর্নীতি বিরোধী সরকারের কথা বলে ক্ষমতা দখল করলেও, তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান, যাঁকে দুর্নীতির অভিযোগ কারাগারে যেতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন- থমকে আমদানি রপ্তানি! বাংলাদেশে আন্দোলনের জেরে যেভাবে ক্ষতি কয়েক’শ কোটির
সেনাকর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, এরশাদের পদত্যাগের কথা যেন তাঁকে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন সরাসরি বলেন। তেমনটা হয়নি। সেনাপ্রধান শুধুই জানিয়েছিলেন, দেশের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অফিসারেরা কোনও দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। সেনাবাহিনীর মনোভাব বুঝে আর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি এরশাদ। ৪ ডিসেম্বর রাতেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। ক্ষমতায় টিকে থাকতে নানা কৌশল অবলম্বন করলেও, শেষ রক্ষা হয়নি এরশাদের।
৬ ডিসেম্বর দিনটিকে এখনও আওয়ামী লিগ 'গণতন্ত্র মুক্তি দিবস', বিএনপি 'গণতন্ত্র দিবস', এরশাদের জাতীয় পার্টি 'সংবিধান সংরক্ষণ দিবস' হিসেবে পালন করে থাকে। একটানা ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় লড়াই করেছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং আরও কিছু দল। পরের দশকগুলিতে এই দুই দলের শাসনই দেখেছে বাংলাদেশ। তারাও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুরনো শাসকের কৌশলগুলিকেই ব্যবহার করেছে। জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের পর রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। দলে দলে মানুষ বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিল। উল্লাসে-আনন্দে মেতে উঠেছিল।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। দেশজুড়ে আন্দোলন, অবরোধ, বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন সাধারণ মানুষও। বাংলাদেশ জুড়ে কার্ফিউ জারি হয়েছে। তিনদিনে শতাধিক মৃত্যু হয়েছে। আহতদের মধ্যে রয়েছে শিশু, নারী, বয়স্ক, যুবক সকলেই। ক্রমশই স্বৈরাচারী রাজনীতির প্রকোপ বাড়ছে বাংলাদেশে। আদালতের রায়ে লক্ষ মানুষের জীবনে ভোগান্তি নেমে এলেও তা নিয়ে কথা বলা যাবে না। কারও ক্ষমতা নেই ঘোষিত সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলার। একেই বাংলাদেশ গণতন্ত্র বলে ডাকে। বিনা বিচারে হত্যা করা সবাইকেই 'আতঙ্কবাদী', 'সন্ত্রাসবাদী' বলে দাগিয়ে দেয় রাষ্ট্র। বাংলাদেশ হয়তো বুঝতেই পারেনি এরশাদের পদত্যাগের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল। বর্তমান বাংলাদেশকে দেখে তাই বলতেই হয়, স্বৈরাচারী শাসক যেমন ফিরে ফিরে আসে, গণআন্দোলনও ফিরে ফিরে আসে।