আবু সাঈদের স্বপ্নের মৃত্যু, একবার, আবার, বারবার
Bangladesh Quota Protest 2024: হাসিনাএবারও ভেবেছিলেন, বড়জোর রাস্তায় হেলমেটবাহিনী অর্থাৎ ছাত্রলীগের গুন্ডা নামিয়ে দিলেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পন্দনে এক অদম্য দুন্দুনবা দ্রিমদ্রিম বাজনা আলোড়িত হচ্ছে আজকে।
ফ্যসিবাদের পুলিশের লীগের একপাল ক্ষুধার্ত হায়নার র্যাবের আর্মার্ড কারের হেলমেট আর হকিস্টিকের তীব্র জোয়ারের সামনে অটল দাঁড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা— শুধুমাত্র সাহস— শুধুমাত্রই, শুধুমাত্রই সাহস ছাড়া যাদের আর কোনও, আর কোনওই যুদ্ধাস্ত্র নেই। তারা ছাত্র যোদ্ধা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের স্বপ্নকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে তুলে ধরে রেখেছেন, ঢাকার রাজপথ স্পন্দিত হচ্ছে তাদের রক্তে, তাদের প্রতিরোধে, তাদের ক্ষোভের চিৎকারে। তারা এমন এক প্রজন্ম যাদের ‘বেয়াদব’ বলে চুপ করানো যায় না, যারা হালুয়া-রুটির লোভে কথা বলেন না, যাদের মাথায় হাত দিয়ে ‘চেতনার’ বড়ি খাওয়ানো যায় না, যাদের ‘জামাত শিবির মোল্লা’ বলে ডিভাইড অ্যান্ড রুলের প্রাচীন খেলা খেলা যায় না, তাদের রাজাকার-দেশদ্রোহী বলা হলে তারা সেই বলাবলিতে আহত হয়ে কাউকে থামাতে যান না। তারা তার উত্তরে গলা উঁচু করে, মেরুদণ্ড সোজা করে স্পষ্টভাষায় বলেন, “হ্যাঁ আমরাই রাজাকার। অধিকার চাইতে গেলে যদি রাজাকার হতে হয় তো আমরা একশোবার, এক লক্ষবার রাজাকার।”
রাজাকার শব্দের কনোটেশন বাংলাদেশি মাত্রই জানেন। কেউ সুস্থ মাথায়, স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে নিজের গায়ে রাজাকার শব্দ টেনে আনবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণরা কেন স্বেচ্ছায় নিজেদের গায়ে 'রাজাকার' যুক্ত করছেন? আমাকে বলেন, কেন করবেন না? এই শব্দের যত্রতত্র নোংরা ব্যবহার কি বাংলাদেশ গত চোদ্দ বছরে দেখে নাই? দেখে নাই, বিপক্ষ শক্তিকে দমন [পড়েন: কচুকাটা] করতে গিয়ে, মধ্য বামপন্থী একটা তুমুল জনপ্রিয় দল, বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিন শেখের বেটির যেই দলের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুশো ছেষট্টি দিনের গৌরবের ইতিহাস যুক্ত, সেই দল প্রথমে স্বৈরাচার এবং পরবর্তীতে রক্তলোলুপ ফ্যাসিস্ট শয়তান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় কীভাবে তার বিরুদ্ধে একটা সমালোচনামূলক শব্দ উচ্চারণ করার ‘গণতান্ত্রিক’ ‘অপরাধে’ প্রতিটা কণ্ঠস্বর চেপে ধরেছে? কীভাবে কার্টুনিস্টদের দেশছাড়া করেছে, লেখক সাংবাদিক সাগর, রুনি, অভিজিৎদের হত্যা করেছে এবং সেই হত্যার সব রকমের ষড়যন্ত্র তত্ত্বীয় দায় দিয়েছে জামাত শিবির রাজাকারদের ওপর? বাংলাদেশ কি দেখে নাই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে স্বজনপ্রীতির রাজনীতিতে কারা বাজারে আগুন ধরিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে? বাংলাদেশ কি দেখে নাই এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে, জাতীয়তাবাদের দেশপ্রেমের এক ভাঙা রেকর্ড কানের কাছে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম কবরের তলদেশের অধঃ, ঊর্ধ্ব, ঈশান, অগ্নি, নৈঋত, বায়ু সব দিক থেকে বাজিয়ে কীভাবে নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে সাধারণ মুসলমানকেই অপরায়ন করেছে? কীভাবে দাড়ি-টুপি-হিজাবকে বহিরাগতের চিহ্ন বলে, রাজাকারের চিহ্ন বলে সরলীকরণ করে সাধারণ মুসলমানকে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের সামনে ফেলা হয়েছে?
আরও পড়ুন- বাড়ি থেকে বেরোবেন না! বাংলাদেশের প্রবাসী ভারতীয়দের সাবধান করলেন মোদি
কেন ছাত্ররা নিজেদের রাজাকার বলবেন না? কেন বলবেন না?
আমি রাজাকার অ্যাপোলজিস্ট না। আমি জামাত শিবিরকেও ধোওয়া তুলসিপাতা, খেজুরপাতা, পবিত্রতার আহা-উহু সংজ্ঞা বলে জাস্টিফাই করছি না। আমি ১৫ অগাস্ট বা ২১ অগাস্ট কোনওটাই অগ্রাহ্য করি না কিন্তু আমার মতোই বাংলাদেশের তরুণরা তো এক দাড়িওয়ালা মোল্লাজুজুর ভয় পান না আর। সেই এক জঙ্গিবাদের ওয়ার অন টেররের “বাংলা হবে আফগান”-এর ইসলামি শরিয়ার গাইনের গীত বাংলাদেশের তরুণরা তো আর খান না। সেই এক কাল্পনিক বাঘের ভয় দেখিয়ে আওয়ামী রাখাল বালক আর কতদিন বাংলাদেশকে 'আর বিকল্প কোথায়'-এর বড়ি গেলাবে?
এই লেখাটা যখন লিখছি, আস্ত বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট বন্ধ। ফোনের নেটওয়ার্ক শাটডাউন অনেকাংশে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগের মুহূর্তে দেখা গেছে, ঢাকা শহরকে বিষম অন্ধকার চাদরে মুড়ে ফেলা হচ্ছে৷ গুলির ঝড় বইছে সারা শহরে। চিৎকার গোঙানি বুলেটের শব্দ আর কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে চারপাশ। শুনতে পাচ্ছি, কারফিউ জারি হয়েছে। সৈন্য নামছে, তৈরি হচ্ছে ট্যাংক।
আমার নিজের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। আজন্ম মুক্তিযুদ্ধের গল্প— পাকিস্তানি বাহিনীর হিংস্রতা আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কুৎসিত দিন আর ততোধিক কুৎসিত রাতের কথা শুনে এসেছি আমি। বুদ্ধিজীবী হত্যা, লাশের পাহাড়, গণহত্যা, গুমখুন এবং তার বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের ইমেজ আমার বেড়ে ওঠার প্রতিটা ক্ষণের সঙ্গে বাবার মুখের বয়ানের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। শেষ খবর পাওয়া অবধি, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ১৬ জুলাই ৬ জন [সূত্র-০১] এবং ১৮ জুলাই অন্তত ১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে [সূত্র-০২]। আহত হয়েছেন তিনশোর ওপরে। ক্লাস এইট, নাইনের বাচ্চাদের উপর নির্দ্ধিধায় গুলি চালাচ্ছে পুলিশ। যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত দুইজনের বয়স ১৮-র নিচে— তাহমিদের বয়স ১৪ এবং ফাইয়াজের ১৭। এরকম গণহত্যা, এই লাশের পাহাড়ের ইতিহাস ও তার পুনরাবৃত্তি যে স্বাধীন বাংলাদেশে নানা সময় হয় নাই তাও নয় কিন্তু এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গেছে দিল্লির তাবেদার ফ্যাসিস্ট হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাওলানা ভাসানির সভা পাকিস্তানি পুলিশ পণ্ড করতে গেলে তিনি নাকি নামাজে বসে যান শুনেছি এবং নামাজ না ছেড়েই মোনাজাত শুরু করে বক্তব্যের পুরাটাই বলে দেন। পাকিস্তানি বাহিনী মোনাজতরত ভাসানিকে কিছুই করতে পারে না কিন্তু এখন শহিদ ছাত্রের গায়েবানা জানাজা থেকে ইমামতিতে দাঁড়ানো ব্যক্তিকেও 'গণতন্ত্রের আম্মা'— আক্ষরিক অর্থে রাজাকারের বেয়াই হাসিনার পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে! আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, এই বাংলাদেশ নামের উপত্যকা যা মুঘলদের মোকাবিলা করেছে, ব্রিটিশদের প্রতিহত করেছে, পাকিস্তান কায়েম করেছে এবং পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশও সৃষ্টি করেছে, স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়েছে, সেনাবাহিনীর কেয়ারটেকার সরকারকে উচ্ছেদ করেছে আর সেই পরম্পরাতেই কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্ররা প্রাণ দিচ্ছেন— সেই পরম্পরাতে আবু সাঈদ নামের এক নিরস্ত্র ছাত্রকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছে আজ। এই হত্যার দৃশ্যে ফেসবুক ছয়লাপ এখন।
ভাইরাল হওয়া কয়েকশো ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আবু সাঈদ সম্পূর্ণ খালি রাস্তায় দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে শান্ত ঈগলের মতো দাঁড়িয়ে আছেন সোজা হয়ে, আর রাস্তার অন্যপাশ থেকে রাষ্ট্রের পোষা পুলিশ বাহিনীর কয়েকশ ধ্বজভঙ্গ পুলিশ গুলি ছুঁড়ছেন ‘একজন’ নিরস্ত্র সাঈদের দিকে। এরকম পরাবাস্তব আলেহান্দ্রো ইয়োদরভস্কিয় দৃশ্য স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে বাংলাদেশ দেখে নাই। পাকিস্তানি দানব আইয়ুব খাঁর আমলে এরকম কোনও ঘটনার সাক্ষী হন নাই কেউ এবং এই দৃশ্যের সবচাইতে বড় আইরনি হচ্ছে আবু সাঈদের ফেসবুকের প্রোফাইলের ছবিতে তার কপালে বাংলাদেশের পতাকার ব্যান্ডানা বাঁধা, তার শেষ পোস্টগুলির মধ্যে একটা পোস্ট শেখ মুজিবকে “হে মহান নেতা” বলে সম্বোধন করা একটা ভিডিও এবং সেই পোস্ট বা কপালের সেই জাতীয় পতাকার পরেও এভাবে, এইভাবে রাস্তায় লাশ হয়ে শহিদ হয়ে যাওয়ার পরেও, অনলাইনে লীগ বাহিনী তাকে দেশদ্রোহী, রাজাকার বানাতে বদ্ধপরিকর। তার ফেসবুক প্রোফাইল খুঁড়ে তিনি কোথায় 'ইনশাল্লাহ' বলেছেন, ‘কার’ মৃত্যুতে ‘জান্নাত’ কামনা করেছেন, সেই সব ‘ইসলামি’ তথ্য বের করে তাকে জামাত শিবির বানাতে বদ্ধপরিকর।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন, মৃত্যু নিয়ে কেন চুপ হাসিনার ‘বন্ধু’ ভারত?
এখানে প্রশ্ন করেন, দয়া করে এই প্রশ্ন করেন— জামাত শিবির দেশদ্রোহী রাজাকার হলেও, দেইল্লা রাজাকারের সমর্থক হলেও, একজন প্রভোকেশনহীন রাষ্ট্রীয় নাগরিককে রাস্তায় বিচারবহির্ভূতভাবে এইভাবে হত্যার অধিকার কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র রাখে?
১৯৭২ সালে চালু হওয়া সরকারি চাকরিতে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে ২০১৮ সালে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবি ছিল, কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনও ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা [সূত্র-০৩]। লাগাতার আন্দোলনের মুখে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থার একাংশ, অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল হয় ২০১৯ সালে [সূত্র-০৪]। এরপর এই বছরের জুন মাসে হাইকোর্টের রায়ে বাতিল হওয়া কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে জুলাইয়ের ৪ তারিখ থেকে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয় আবার। এই পর্যন্ত সব কিছু ঠান্ডা, নিয়মানুগ, শান্তিপূর্ণ ‘বাই-দ্য-বুক’ পদ্ধতিতেই চলছিল কিন্তু ঝামেলা শুরু হয় ১৪ জুলাই লাইলাতুল ইলেকশনের অবৈধ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার অপরিণামদর্শী বক্তব্যের জের ধরে, যেখানে তিনি আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের 'রাজাকার' বলে সম্বোধন করেন।
শেখ হাসিনার ‘মুখের’ দোষ নাই। তিনি নিজের বাবা এবং পরিবারের সদস্যদের ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে খুন হওয়ার দায় দেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর। অন্তত তাঁর কথায়, কাজে, আচরণে তা বারবার প্রমাণিত। আমার পরিবারের সবাইকে একদিনের মধ্যে মেরে ফেলা হলে আমি কী করতাম জানি না, তবে আমি এদ্দূর জানি, এত প্রতিহিংসা নিজের ভেতরে লালন করলে আমি অন্তত রাষ্ট্র শাসন করতে যেতাম না। কিন্তু হাসিনা তো নিজের বিচক্ষণতা, নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা শো-কেস করতে, মানুষকে ভালোবেসে বাংলাদেশকে ভালোবেসে, তাঁর বাবার স্বপ্ন পূরণে রাষ্ট্র শাসন করতে আসেন নাই। তাই তাঁর রাজনীতির ৯০ শতাংশই সেই প্রতিহিংসার রাজনীতি। তিনি মনে করেন, দেশ তাঁর বাপের। তিনি যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা একজন রাষ্ট্রীয় চাকর, তা তিনি মনে করেন না। তিনি ভাবেন, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী— যা ইচ্ছা তাই বলার, যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার একমাত্র তিনিই রাখেন এই বাংলাদেশে। যখন ইচ্ছা তিনি ইলেক্ট্রিসিটি বা ইন্টারনেট বন্ধ করে দেবার হুমকি দেন, রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে বেডরুমে সিসিটিভি লাগানোর নোংরা রসিকতা করেন, আর রাষ্ট্রীয় আম-কাঁঠালিয় জনগণ সেসব গুন্ডামিকে অ্যানেকডোট আকারে নিয়ে হাসিনাকে দুটো গালি দিয়ে পাঙাশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে মশারির নিচে পাশ ফিরে কাঁথা গায়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
এবার অবশ্য জনগণের কাঁথা গায়ে ঘুমানোটা আর হয় নাই।
এটা হাসিনার ক্যালকুলেশনের ভুল। তিনি এবারও ভেবেছিলেন, আগেরবারের মতোই তাঁর এক ধমকে সব সোজা হয়ে যাবে। এবারও তিনি ভেবেছিলেন, বড়জোর রাস্তায় হেলমেটবাহিনী অর্থাৎ ছাত্রলীগের গুন্ডা নামিয়ে দিলেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। তিনি বোঝেন নাই, ঘুঘু এতবার নির্বিঘ্নে ধান খেয়ে পার পেয়ে গেলেও একদিন না একদিন ঘুঘুকে ধরা খেতেই হয় এবং তাদের হাতেই খেতে হয়, যারা তার বিরোধী দলের জামাত শিবির রাজাকারের লোক না, তাকে ধরা খেতে হয় তাকে ভালোবাসা, তার বাবার জন্য বুকের ‘লহু’ নিয়ে আসা সাধারণ মানুষের হাতে, যারা শেখ মুজিবকে শেখ মুজিব বলে সম্বোধন করেন নাই কোনওদিন, যাদের কাছে শেখ মুজিব মানে শেখ সাহেব, বঙ্গবন্ধু ছিলেন। ধরা খেতে হয় এইসব বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাছে, যারা নিজেদের বাবা-মায়ের জেনারেশনের বুদ্ধিজীবীদের জাফর ইকবাল, মাসুদা ভাট্টি শাহরিয়ার কবীরদের মতো মেরুদণ্ডহীন, ধ্বজভঙ্গ, দালাল বুদ্ধিজীবীদের নির্লজ্জ মিথ্যা কথা দেখে ক্লান্ত হয়ে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নির্বিকারভাবে নিজেদের কৈশোরের সব ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ আর ‘আমার বন্ধু রাশেদ’-এ আগুন ধরিয়ে দেন।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা ঠিক কী? কেন এর বিরোধিতায় প্রাণ হারালেন পড়ুয়ারা?
মানুষ বাঁচে তো তার স্বপ্নে। হাসিনার সরকার গত চোদ্দ বছরে আমাদের হাতে উন্নয়ন নামের একখানি পদ্মাসেতু, একখানি দু’টাকার মেট্রোরেল, চার টাকা চুরির লেবেঞ্চুস ধরিয়ে দিয়ে আমাদের সকলকে আমাদের সকলের স্বপ্নের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে নিয়ে গেছে অসংখ্যবার। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, আনভির মুনিয়া, সুন্দরবন, তনু, হোলে আর্টিজান, সালমান এফ রহমান, কল্পনা চাকমা, রানা প্লাজা, ব্যাঙ্ক লুট, টাকা পাচার, খাবারে ভেজাল, পানিতে বিষ, বায়ু দূষণে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ অবস্থানে আমাদের মোরাল কম্পাসের ছোটবেলায় পড়া ধারাপাতের নীতির গল্পের ঈশপ মরে ইসলামি ভূত হয়ে আমাদের স্বপ্নগুলিকেও মেরে ফেলেছে অনেক আগেই। আবু সাঈদের তাই হয়তো রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর সামনে দুই হাত মেলে দাঁড়াতে ভয় হয় নাই। যার স্বপ্ন মরে গেছে অনেক আগে, রাষ্ট্র তাকে আর কতবার মারবে, বলেন?
তবে আবু সাঈদের এই নির্বিকার মৃত্যু একটা কাজ করে দিয়ে গেছে।
আবু সাঈদের এই নির্বিকার মৃত্যু এই ফ্যাসিস্ট রেজিমের মুখে একদলা ঘৃণার থুতু দিয়ে গেছে। এই সিউডো-উন্নয়নের লাল-নীল বাতিতে পদ্মা-যমুনা সেতুতে থুতু দিয়ে গেছে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জাল কাগজের এই ৩০ শতাংশ কোটা তো কবেই উড়ে গেছে এই থুতুর তোড়ে। এখন এই আন্দোলন, দুঃসাহসের রঙ, সকালবেলার সূর্যের আলোর মতো, বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়া পাহাড়ি নদীর স্রোতের মতো ঢুকে পড়েছে আমাদের রক্তপ্রবাহে— আমরা শুনতে পাচ্ছি একই তালে, একই লয়ে আমাদের মেরুদণ্ডের মজ্জায় বাজছে নূর হোসেনের “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”-এর এই দ্রিমদ্রিম দুন্দুনবা ড্রামবিটের শব্দ, আমরা দাঁতের নীচে টের পাচ্ছি ভাঙনের স্বাদ, আমরা বলছি—
“আবু সাঈদ ভাই আমার, আমরা তোমার মরে যাওয়া ভুলব না। তোমার লাশের ওপর তোমার বাবার জান্তব চিৎকারে আমাদের চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়বে না।
তোমার মৃত্যু আমাদের অন্ধকার সময়ে পথ দেখাবে, আমরা জানব, আমরা সঠিক পথে আছি। আমরা জানব, তুমি, আমি এবং আমরা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার, পৃথিবী থেকে হিটলার, মুসোলিনি, ইদি আমিন, শেখ হাসিনাদের পরিষ্কার করার— তাদের ঝুলন্ত লাশের উপর থুতু ফেলার দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি।”
সূত্র
১। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষ ও হতাহত, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের গভীর উদ্বেগ
২। সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহতের খবর