ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী এক জনতার শিল্পী
Banksy, The Artist and Israel-Palestine War: কাল রাতে যে সেনা বাড়িজুড়ে তল্লাশি চালিয়েছে, মেয়েদের জামা খুলিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে, শিশুকেও ছাড়েনি, সকালে উঠে সবাই দেখবে, দেওয়ালে কে যেন এঁকে গিয়েছে সেই সেনার শরীর তল্লাশি করছে...
একটা কবিতা কখন যে কোন মানে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে, তা কেউ জানে না। কয়েক দিন ধরেই যেমন ভাবাচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটি। আরও সরাসরি বললে বিদ্রোহী কবিতার একটি লাইন-
"আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক তাপ হানা খেয়ালী
বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!"
আমাকে ভাবাচ্ছে ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার অভিপ্রায়। কে এই ভগবান? তার বুকে কে পদচিহ্ন আঁকবে? উত্তর আছে পরের লাইনে। কবির বয়ানে, যিনি এ কাজ করবেন তিনি একজন ঘাতক (সূদন শব্দের অর্থ) স্রষ্টা। অর্থাৎ তার ধ্বংসের নিবিড়ে আছে সৃষ্টির ডাক। উল্টো করে বললে, তার সৃষ্টি যেন ধ্বংসের দামামা। যে নিয়ম মানুষের প্রাণ নেয়, যে নিয়ম 'শোক-তাপ' ডেকে আনে, এই স্রষ্টা সেই সব চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুনের বুক চিড়ে ফেলবে তার শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়েই। ১৯২১ সালের এক শীতের রাতে তালতলার ভাড়াবাড়িতে বসে এই কবিতা লিখেছেন নজরুল। নজরুল ইসলাম সেই বাঙালি কবি যিনি লেখার জন্যেই জেলে গিয়েছেন। রাজবন্দি হয়ে দিন কাটিয়েছে। বন্দি অবস্থায় ৩২ দিন অনশন করেছেন। এক দশক ধরে শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছেন। ১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু সে তো এক শতাব্দী আগের কথা। আমার সময়ে এমন শিল্পী কেউ আছেন যিনি ঈশ্বরের বুকে পা রাখার স্পর্ধাধারী? প্রশ্নটা নিয়ে শুতে চলে যাই।
আরও পড়ুন: শোকের বিগ্রহ
উত্তর পাই ঘুমের মধ্যে। ঘুমের মধ্যে মাথায় ঘুরতে থাকে একের পর এক ছবি। কোনো ছবিতে দেখা যায়, এক সেনাকর্মী অস্ত্রহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দেহ তল্লাশি করছে একটি শিশু। কোনো ছবিতে দেখা যায়, একটি শিশু গ্যাসবেলুনে চড়ে উড়ে যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে পড়ি, মনের কোন অতলে এতদিন পড়েছিল এইসব ছবি। আজ তারা সব ভেসে উঠেছে। ছবিগুলি আবার দেখি ইন্টারনেটে। সেই সঙ্গে সামনে আসে আরও আরও ছবি। কোথাও হয়তো, একজন প্রতিবাদী, মুখে রুমাল বাঁধা, উল্টোদিকে হ্যান্ডগ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গি তার। কিন্তু তিনি ছুঁড়ছেন এক গুচ্ছ ফুল।
এই সমস্ত ছবি আঁকা হয়েছে গত দু'দশকে। এই সমস্ত ছবি আঁকার জমি কোনো ক্যানভাস নয়, সবটাই আঁকা হয়েছে দেওয়ালে। যে দেওয়াল তুলে প্যালেস্টাইনকে কার্যত অবরুদ্ধ করেছে ইজরায়েল। এই দেওয়াল ২০০৪ সালে অনৈতিক বলে ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক আদালত৷ কিন্তু তারপরেও গায়ের জোরে তোলা দেওয়াল ভাঙেনি ইজরায়েল সরকার। বেওয়ারিশ জমি দখল করে যার দেশ তাকেই আটক করে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তোমাকে এটুকুর মধ্যেই থাকতে হবে। এই দেওয়াল ৭০০ কিলোমিটার চওড়া, ৩৮ ফুট উঁচু। ফিলিস্তিনিদের একদল এই মস্তানির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করেছে, গান্ধী এবং নেলসন ম্যান্ডেলাকে স্মরণ করেছে। আরেক দল নাম লিখিয়েছে হামাস শিবিরে। যার যেমন প্রতিবাদের ভাষা। এসবের মধ্যেই একজন ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। দেওয়ালের যে দিকে প্যালেস্টাইন সেদিকে রাতের অন্ধকারে দ্রুত গতিতে অজস্র ছবি এঁকে রেখেছেন। যে ছবি সাধারণ ফিলিস্তিনির বেদনার দিনলিপি। তাঁর ছবি এক ধরনের গেরিলা ওয়ারফেয়ার। অক্ষমের প্রতিশোধ। কাল রাতে যে সেনা বাড়িজুড়ে তল্লাশি চালিয়েছে, মেয়েদের জামা খুলিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে, শিশুকেও ছাড়েনি, সকালে উঠে সবাই দেখবে, দেওয়ালে কে যেন এঁকে গিয়েছে সেই সেনার শরীর তল্লাশি করছে এক শিশু। অক্ষমের প্রত্যুত্তর। প্রতিটি ছবির পাশে লেখা শিল্পীর নাম, দেওয়ালে কুঁদে লেখা- বাঙ্কসি। ঠিক যেমন নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় বারবার ফিরে আসে 'আমি'।
কে এই বাঙ্কসি? গত তিরিশ বছর তাঁর পরিচয় খুঁজেছে বিশ্বের তাবড় মিডিয়া। দেখা যাচ্ছে কুড়ি বছর আগে বিবিসি'র সাংবাদিক নাইজেল রেঞ্চ একটি সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করেন, "আপনাকে পুরো নামে সম্বোধন করি? আপনার কি আপত্তি আছে?"
বাঙ্কসি বলেন, "করতে পারেন।"
সাংবাদিক বলেন, "আপনার নাম রবার্ট ব্যাঙ্কস তো?"
বাঙ্কসি শুধরে দিয়ে বলেন, "রবার্ট নয় রব্বি।"
২০০৮ সাল নাগাদ কেউ কেউ বলতে শুরু করে ব্রিস্টলের বাসিন্দা রবিন গানিংহামই বাঙ্কসি। কেউ আবার মনে করেন হিপহপ ব্যান্ড ম্যাসিভ অ্যাটাকের সদস্য রবার্ট ডেল নেজাই বাঙ্কসি। গুজব উঠেছে, বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে, দুঁদে ডিটেকটিভরাও তিনি কে, এই রহস্যের কিনারা করতে পারেনি।
১৪ বছর বয়সে স্কুলছুট বাঙ্কসিকে ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে জেলে যেতে হয়েছে। গ্রাফিত্তি সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ, কাজেই প্রথম থেকেই নিজের চেহারাছবি লুকিয়ে এসেছেন তিনি। নানা সময়ে তাকে দেখা গিয়েছে মুখোশে মুখ ঢাকা অবস্থায়। দলের মধ্যে। সে দলে পুরুষ যেমন আছে তেমন মহিলাও আছে। ফলে বাঙ্কসি পুরুষ না মহিলা, সাদা না কালো, ভিড়ের মধ্যে কোনটা তিনি বোঝার উপায় নেই। বাঙ্কসি কেউ নয়, অথবা বাঙ্কসি সবাই।
গ্রাফিত্তির কাজ রাতের অন্ধকারে দ্রুত সারতে হয়। বাঙ্কসি প্রথম প্রথম রঙের কৌটো ব্যবহার করতেন। Wall and Piece বইয়ে তিনি লিখেছেন, প্রথম দিকে হয় পুলিশের ভয়ে কাজ অসমাপ্ত রেখে পালাতে হত। অথবা মাঝপথে পুলিশ ধরে নিত। একদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে আবর্জনা বোঝাই লড়ির নীচে লুকিয়ে থাকার সময় চোখে পড়ে স্টেনসিলে লেখা গাড়ির নম্বর। সেই থেকে তিনি স্টেনসিল ব্যবহার করেন।
এক কথায় বাঙ্কসির কাজ লোক ক্ষ্যাপানো। ব্রিটিশ পুলিশের এই একই অভিযোগ ছিল নজরুলের বিরুদ্ধে, তাঁর লেখা আনন্দময়ীর আগমনে কবিতাটির বিরুদ্ধ। লোকের সঙ্গে তো গ্যালারির সম্পর্ক নেই। কাজেই গ্যালারিতে ছবি দেখাতে স্বচ্ছন্দ নন বাঙ্কসি। বিবিসি-র ইন্টারভিউতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, "আমি আর্টের পৃথিবীর লোক নই। আমাকে এসব টানে না। আমি সেই আর্টের পক্ষে যার বিচার করে মানুষ। কোনো কোটিপতি আমার বিচার করছে, আমার কাজ কতটা শিল্প, কতটা শিল্প নয়, এসব নিদান দিচ্ছে, আমার পোষায় না।" গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বাঙ্কসি বলেছেন,"মিউজিয়াম কখনও শিল্প দেখার সঠিক জায়গা হতে পারে না। কারণ সেখানে একটি শিল্পবস্তুর পাশে সম্পূর্ণ কার্যকারণ সম্পর্কবিহীন আরেকটি শিল্পবস্তু রাখা থাকে। "
অতীতে বাঙ্কসি ১০ টাকার (ব্রিটিশ মুদ্রা) নোটে ব্যাঙ্কের (bank) জায়গায় বাঙ্কসি (banksy) লিখে, ব্রিটিশ রানির জায়গায় বসিয়ে দিয়েছেন ডায়নার ছবি। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে। টিকি পায়নি। বাঙ্কসি জানেন, যে পুলিশ রাষ্ট্রের চাপে তাকে তাড়া করে, সেও দিন শেষে তার কাজের সমঝদার, সমর্থক। সে কারণেই কি বারবার হাতফসকে যায় বাঙ্কসি?
যেখানে অশান্তি, যেখানে যুদ্ধ, আগ্রাসন, ফ্যাসিবাদ, রাষ্ট্র দাঁতনখ বের করে আছে, কর্পোরেট মানুষকে দাস বানাচ্ছে, সেখানেই বাঙ্কসি আসেন রাতের আঁধারে চুপিসার। তাঁর শিল্প প্রশ্ন করে, রাজা তোর কাপড় কোথায়! রাশিয়া, ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন- কাউকে রেয়াত করেন না বাঙ্কসি।
যে ফিলিস্তিনি শিশু দেখতে চায় দেওয়ালের ওপারটা কেমন, তাকে ছবিতে বেলুন হাতে দিয়ে উড়িয়ে দেয় বাঙ্কসি। যে ফিলিস্তিনি যুবক প্রতি শুক্রবার নিরস্ত্র বিক্ষোভে জমা হয়, বাঙ্কসি দেওয়াল ছবিতে তার হাতে গুঁজে দেন ফুল।
২০০৩-২০০৪ সাল থেকেই বাঙ্কসির উপস্থিতি টের পাওয়া যায় প্যালেস্টাইনে। সেজে উঠতে থাকে গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দেওয়াল। আপনি ছবিতে বেড়ালকে গোলাপি বো পরালেন কেন? প্রশ্নের উত্তরে বাঙ্কসি বলেন, "এই বেড়ালটা গোটা পৃথিবীকে বলে, সে ভালো নেই। তবু খেলার জন্যে ওর একটা বো আছে। প্যালেস্টাইনের বাচ্চাদের জন্যে কিছুই কি অবশিষ্ট আছে?" ২০১৫ সালে ফিলিস্তানি জীবনের ধ্বংসের ইতিবৃত্ত বাঙ্কসি একটি ভিডিওয় তুলে ধরেন। ভিডিওটির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় দেওয়ালে কেউ লিখে দেয়, "ক্ষমতাবান আর অক্ষমের লড়াইয়ে আপনি যদি হাত ধুয়ে ফেলেন, চুপ করে যান, তবে আপনি ক্ষমতাবানের পক্ষই নিলেন।"
ক্ষমতার সঙ্গে বাঙ্কসির সম্পর্ক মস্করার। সেনাবাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ লোকে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে বাঙ্কসি দেওয়াল জুড়ে এঁকেছে, গাধার থেকে পরিচয়পত্র চাইছে ইজরায়েলি সেনা। শত দুঃখেও সেই ছবি দেখে দিনভর খ্যাকখ্যাক করে হাসে ফিলিস্তিনিরা।
আরও পড়ুন: নিকষ আঁধারে ওরা হাঁটছে…
২০১৭ সালে জেরুজালেম চেকপয়েন্টের কাছে একটি হোটেল তৈরি করেন বাঙ্কসি। নাম- দ্য ওয়াল্ড অফ হোটেল। সেই হোটেলের প্রতিটি ঘর থেকে দখলদার ইজরায়েলের তোলা দেওয়াল দেখতে পাওয়া যাবে। শোয়ার ঘরের দেওয়ালে দেখা যাবে ফিলিস্তিনিদের জীবন নরক করে দিচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। সামনে সমুদ্র অথচ এই হোটেলের একটিও ঘর থেকে তাকে দেখার উপায় নেই। এই হোটেলে একদিন থাকলে বোঝা যাবে ফিলিস্তিনিদের দিন কেমন কাটে। গোটা হোটেল সাজানো হয়েছে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে। তার মধ্যে রয়েছে সিসিটিভি, রয়েছে কার্তুজ, বাতিল টিয়ার গ্যাস, ওয়াকিটকি। রয়েছে ১০০ বছর আগে ব্রিটিশদের প্যালেস্টাইন দখলের ইতিহাসকে কটাক্ষ করে বাঙ্কসির বানানো নানা আর্টপপ।
ইজরায়েল ক্ষমতাবান। ইজরায়েল ঈশ্বর। তার কাছে অস্ত্র আছে, নজরদারি প্রযুক্তি আছে। আমার দেশের কত মানুষ, প্রতিবেশী তার কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনির দুঃখে তার চোখে জল আসে না। আর বাঙ্কসি, ইজরায়েল হোক বা রাশিয়া, হেলায় ঈশ্বরের বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। বলছেন, "কে ভালবাসার দিকে তুলেছ আঙুল, দূরে যাও!"
ঘুমে আর জাগরণে ভাবি, আমাদের একজন নজরুল ইসলাম ছিলেন। আমাদের একজন বাঙ্কসি আছেন।