সত্যিই তবে জলের খোঁজ মিলল চাঁদে? চ্যালেঞ্জ পুরনো তত্ত্বকে
Water Molecules On Moon: চাঁদের মাটি থেকে এক হাজারটিরও বেশি খনিজ জমাট বিচ্ছিন্ন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে একটি প্লেটের মতো স্বচ্ছ স্ফটিক ছিল, যার নাম রাখা হয়েছে "unknown lunar mineral" (ULM-1)।
চাঁদ নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কিছু দিন আগেই জানা গিয়েছে, চাঁদের মাটিতে রয়েছে নাকি সুবিশাল সব গুহাপথ। যা দেখার পর চাঁদে বসবাসের নানা জল্পনা কল্পনাও কষে ফেলেছে মানুষ। চাঁদে যে জল নেই, তেমন একটা ধারণা ছিল এতদিন ধরে। কার্যত ধরেই নেওয়া হয়েছিল, চাঁদের মাটি শুকনো, খটখটে। এবার সেই ধারণাকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করে বসল চিন। তাদের মহাকাশচারীদের দাবি, চাঁদের মাটিতে মিলেছে জলের সন্ধান।
জলের অন্য নাম জীবন। জলের সন্ধান মানে প্রাণের সন্ধান মেলার সুযোগও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তবে কি সেদিন আর বেশি দেরি নেই, যেদিন চাঁদে মিলবে মানুষের মতোই প্রাণীদের। না, সে নিয়ে অবশ্য এখনও ঢের বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে চাঁদের এ হেন জলের সন্ধান মেলা কিন্তু মহাকাশ গবেষণায় একটা বড় মাইল ফলক তো বটেই।
মহাকাশের লড়াইয়ে কেউ কাউকে এক চিলতে জমি ছাড়েনি কখনও। এমনকী সেই লড়াই কোনও অংশে যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। চাঁদে প্রথম পা রেখেছিল আমেরিকা। যদিও তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বহু। অনেকেই মনে করেন প্রায় ৫৫ বছর আগে অ্যাপলো ১১-র চাঁদ জয়ের ঘটনা নাকি গোটাটাই স্টুডিওতে করা শুটিং। নীল আর্মস্ট্রংদের চাঁদে পা দেওয়া নিয়ে তাই সংশয়ের শেষ নেই।
আরও পড়ুন: বসবাস করতে পারবেন মানুষ? চাঁদের বুকে খোঁজ মিলল আশ্চর্য গুহার
এরপর রাশিয়া, চিন এবং ভারত— এই চার দেশই চাঁদের মাটিতে পুঁতে এসেছে নিজেদের দেশের ঝান্ডা। এবং সেটুকুতেই আশ মেটেনি তাদের। চাঁদকে আরও জানতে, আরও বুঝতে অহরহ গবেষণা চালিয়ে গিয়েছে তারা। চলেছে অভিযান। আমেরিকা অ্যাপলো ১১ মিশনের পরেও আরও পাঁচ বার চাঁদে গিয়েছে। সম্প্রতি চাঁদে পা রেখেছে জাপানও। পিছিয়ে নেই চিন এবং রাশিয়াও। চাঁদ নিয়ে মানুষের অপার জানার আগ্রহ বারবার তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে চাঁদ নামক ওই আশ্চর্য উপগ্রহের মাটিতে।
কয়েক দশক আগে চাঁদ থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল অ্যাপলো মিশনে। সেই নমুনা পরীক্ষা করে তাতে জলের কোনও চিহ্ন খুঁজে পায়নি নাসা। যার থেকে এরকম ভাবে ধরে নেওয়া হয়, চাঁদের মাটি শুকনো খটখটেই। ২০২০ সালে চ্যাং'ই-৫ মিশনে চিন সংগ্রহ করে চাঁদের মাটির নমুনা। সেই নমুনা বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি নাকি জলের খোঁজ পেয়েছেন চিনা বিজ্ঞানীরা। মিলেছে জলের অণু। সূত্রের খবর, ২০২০ সালে Chang'e-5 মিশনে সংগ্রহ করা মাটির নমুনার উপর ভিত্তি করে সেখানকার বিজ্ঞানীদের ধারণা, চাঁদে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন অণুর আকারে হাইড্রেটেড খনিজ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই গবেষণা সম্প্রতি পিয়ার-রিভিউ জার্নাল নেচার অ্যাস্ট্রোনমিতে প্রকাশিত হয়।
২০২০ সালে নাসা চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে ক্ল্যাভিয়াস ক্র্যাটারে জলের অনু শনাক্তকারী ইনফ্রারেড প্রযুক্তির দৌলতে চাঁদের আলোকিত পৃষ্ঠে জলের অণু আবিষ্কার করেছিলেন। গত বছর নাসার তরফে জানানো হয়েছিল, চাঁদের আলোকিত পিঠেই রয়েছে জলের হদিস। অবশ্য তা জমে রয়েছে বরফ হিসেবে। নাসার সোফিয়া অর্থাৎ স্ট্র্যাটোস্ফেরিক অবজারভেটরি ফর ইনফ্র্যারেড অ্যাস্ট্রোনমি (SOFIA) একপ্রকার নিশ্চিত করেছে যে চাঁদের ক্লেভিয়াস গহ্বরে হাইড্রজেন ও অক্সিজেন মৌল জোট বেঁধে H2O জলের অণু তৈরি করেছে। চাঁদের পিঠে হাইড্রজেনের খোঁজ মিলেছিল। কিন্তু এই হাইড্রজেন, অক্সিজেনের সঙ্গে কোন রাসায়নিক ফর্মুলায় জোট বেঁধেছে সেটা জানা যায়নি এতদিন। নাসা জানিয়েছে, ক্লেভিয়াস ক্রেটারে ১২ আউন্স মতো জল জমে আছে। চাঁদের মাটি ও ধূলিকণায় এক ঘনমিটার অবধি জায়গা জুড়ে সেই জলের অণু ছড়িয়ে আছে।
১৯৬৯ সালে নাসার অ্যাপোলো মিশনে জানা গিয়েছিল চাঁদের পিঠ একেবারে রুক্ষ, শুষ্ক। জলের ছিটেফোঁটাও থাকতে পারে না। পরবর্তীতে ‘নাসার লুনার ক্রেটার অবজারভেশন অ্যান্ড সেন্সিং স্যাটেলাইট’ জানান দিয়েছিল, শুষ্ক নয় চাঁদের পিঠ, বরং বরফ জমে আছে চাঁদের মেরুতে। এরপরে নাসার একাধিক চন্দ্র-অভিযানে সে প্রমাণ মিলেছে। ক্যাসিনি মিশন, ডিপ ইমপ্যাক্ট কমেট মিশনে মহাকাশবিজ্ঞানীরা একই কথা বলেছিলেন।
ইসরোর প্রথম চন্দ্রযাত্রা তথা চন্দ্রযান-১ মিশন সফল না হলেও, মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলেছিলেন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বরফ জমে আছে সেটা ধরা পড়েছিল চন্দ্রযান-১ এর অরবিটারে। সেটা অবশ্য সেই ২০০৯ সালের কথা। মাস দেড়েক আগেই ইসরো এবং স্পেস অ্যাপলিকেশন সেন্টারের করা একটি স্টাডিতে ধরা পড়ে চাঁদে বিপুল পরিমাণ জলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়। এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আইআইটি ধানবাদ এবং আইআইটি কানপুরের গবেষকেরাও। গবেষণায় জানা গিয়েছে, চন্দ্রপৃষ্ঠের তুলনায় মাটির নীচে প্রায় ৫ থেকে ৮ গুণ বেশি জল বরফ আকারে সঞ্চিত রয়েছে। ইসরো আরও জানিয়েছে এই বিপুল পরিমাণ জল বরফ আকারে সঞ্চিত আছে চাঁদের দুই মেরুতেই।
তবে চিনা বিজ্ঞানীরা নতুন কী খুঁজে পেলেন চাঁদের মাটিতে? জানা যাচ্ছে, চাঁদের মাটি থেকে এক হাজারটিরও বেশি খনিজ জমাট বিচ্ছিন্ন করেছেন তাঁরা। এর মধ্যে একটি প্লেটের মতো স্বচ্ছ স্ফটিক ছিল, যার নাম রাখা হয়েছে "unknown lunar mineral" (ULM-1), আর তার মধ্যেই মিলেছে নাকি জলের অণু। যাতে অন্তত ৪ শতাংশ জলের খোঁজ মিলেছে। কোনও ভাবে কি রকেট মিশন থেকে আসা দূষিত পদার্থ থেকে ওই জল আসতে পারে? যদিও সেই সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছেন চিনের বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন: চাঁদ এখন শ্মশান! কেন চাঁদের মাটিতে মানবভস্ম, ডিএনএ পাঠানোর এমন ধূম জানেন?
শুকনো খটখটে মাটি থেকে চাঁদে জলের খোঁজ, এই তত্ত্বের আবিষ্কারে বিন্দু বিন্দু অনুদান রয়েছে আমেরিকা, ভারতের মতো বহু দেশেরই। তবে চাঁদের মাটিতে যে সত্যিই জল আছে, তার হাতেনাতে প্রমাণ কিন্তু প্রথম পেয়েছিলেন চিনা গবেষকেরাই। আর তা মিলেছিল ২০২০ সালেই। সম্প্রতি চাঁদ থেকে ফিরেছে Chang'e-6 চন্দ্রযান। চাঁদের অববাহিকা থেকে ২ কেজি উপাদান সংগ্রহ করে এনেছে বলে খবর। যা নিয়ে গবেষণা শেষ হলে আরও অনেক রহস্যেরই সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে কি চাঁদজয়ের লড়াইয়ে শেষমেশ আমেরিকা, ভারতকে মাত দিয়ে দেবে চিনই! নাকি শেষ হাসি হাসবে নাসা, ইসরোরাই। সেটাই দেখার।