গাছ সত্যিই হাঁটে? বটগাছের এই অভাবনীয় ঘটনার আড়ালে কোন সত্য?

The Walking Banyan Tree : হাওড়ার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু বোটানিক্যাল গার্ডেনে অবস্থিত এই গাছটির ছায়ায় আস্ত ম্যানহাটন শহর ঢুকে যেতে পারে!

ঘুমঘোরে মানুষ হাঁটে। স্লিপওয়াকিংয়ের কারণ নিয়ে, প্রভাব নিয়ে বিবিধ লেখাপত্তরও সহজেই মেলে। মানুষ হাঁটে ঘুমে ঠিকই, তবে গাছও কি হাঁটে? ভারতীয় উপমহাদেশের বনেবাদাড়ে ঘটনাটি কিন্তু নেহাত হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এই অসাধারণ ঘটনা সত্যিই ঘটে এখানে, ‘গাছ হাঁটে"।কিন্তু কীভাবে?

বটগাছ এই দেশের বিশেষ এক গাছ। বটবৃক্ষ হিন্দুধর্মে পবিত্র গাছ। গাছ নিয়ে তাই স্বাভাবিকভাবেই পৌরাণিক আখ্যান রয়েছে প্রচুর। বলা হয়, নিজেদের পায়ের ছাপ ফেলে ফেলেই নাকি শিকড় বিস্তার করে বটগাছ। আদতে তো গাছের বা সাপের কারও পা থাকার কথাই নয়, নেইও। ফলে শিকড় বিস্তার করতে হেঁটে চলে বেড়ানোর কথা নিতান্তই গল্প। কিন্তু গল্পের নেপথ্যের কাহিনিটি কী? আসলে এই জাতীয় শিকড়গুলি নরপম এবং এগুলি মাটির মধ্যে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। যে জায়গায় গাছ নিজের বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি সূর্যালোক এবং পুষ্টি পায় সেখানেই নিজেকে মেলে ধরে। গাছ এভাবেই ধীরে ধীরে সূর্যালোক পেতে, পুষ্টি পেতে নিজেকে এগিয়ে এগিয়ে দেয়, যা দেখে মনে হয় তারা হাঁটছে।

এই ক্ষমতার কারণেই বটগাছ কিন্তু এত বিশাল। একটি একক বটগাছই অনেকখানি জায়গা দখল করে থাকে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্বের বৃহত্তম গাছ হিসাবে স্বীকৃত বটবৃক্ষ। একটি বটগাছ (Ficus benghalensis) দেখলে তাই মনে হতেই পারে আস্ত একটা বন দেখছেন। বটগাছ আসলে এক বিশাল জীব। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে দ্য গ্রেট বেনিয়ান। এই বটগাছটি ১৪,৫০০ বর্গফুট (১,৩৪৭ বর্গ মিটার) জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিশাল বটবৃক্ষটি রয়েছে আমাদেরই রাজ্যে। হাওড়ার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু বোটানিক্যাল গার্ডেনে অবস্থিত এই গাছটি কত বিশাল ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। আস্ত ম্যানহাটন শহর ঢুকে যেতে পারে এই গাছের ছায়া। এতটাই বিস্তৃত এই দ্য গ্রেট বেনিয়ান!

কীভাবে এত বিস্তার লাভ করে গাছটি?

বটগাছ বীজ থেকেই জন্মায়। বটফলের বীজ অন্য গাছের উপর পড়ে। ধীরে ধীরে বটগাছের শিকড় ওই অন্য গাছগুলির শিকড়গুলিকে নষ্ট করে নিজেকে বিস্তার করতে থাকে। প্রকৃতির নিজস্ব মাৎসন্যায়! ধীরে ধীরে মূল অন্য গাছটি মারা যায়। বট গাছটি নিজের সমস্ত শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে ক্রমেই বেড়ে ওঠে। মূল গাছের ডালপালাকে ভারসাম্য দিতে দিতে এই অংশগুলি এমনভাবে বেড়ে ওঠে যে মনে হয় অনেক ক'টি গাছ জন্মেছে।

কিন্তু মানুষ বা পশুর যত দ্রুত হাঁটে, এই গাছের 'হাঁটা' তো ততটা দ্রুত নয়। গাছ আসলে এমন গতিতে বনের পথে 'হাঁটে' যা মানুষের পক্ষে দেখা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু গাছ নিজের মতো জায়গা করে এগিয়ে যায়, নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে, বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। ২৫০ থেকে ৫০০ বছরও বয়স হয়ে যায় এক একটি গাছের।

ভারতের পুরাণে বটগাছটি প্রতীকীভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতে বট বৃক্ষ মৃত্যুর দেবতা যমের সঙ্গে সম্পর্কিত। এমন গাছ হামেশই শ্মশানের কাছে জন্মাতে দেখা যায় বলে ধারণা পোক্ত হয়েছে আরও। কাহিনিতে বলা হয়, কৃষ্ণ একটি বটগাছের নীচে দাঁড়িয়েই ভগবৎ গীতার উপদেশগুলি অর্জুনকে দিয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের মহাজাগতিক 'বিশ্ববৃক্ষ' আসলে একটি উল্টোনো বট, যার শিকড় রয়েছে আকাশে (স্বর্গে) এবং পৃথিবীর দিকে বৃদ্ধি পায় এর শাখা প্রশাখা।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বট জীবন, উর্বরতা এবং পুনরুত্থানের বিভিন্ন আখ্যানকে আঁকড়ে রেখেছে। শুধু পুরাণ নয়, বটগাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের গন্ধ। ব্রিটিশরা যখন ভারত আক্রমণ করে এই বটগাছগুলিতেই বহু ভারতীয়ের ফাঁসি দিয়েছিল তারা। শতাব্দীকালের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বটগাছেরা, ভারতের জাতীয় বৃক্ষ।

More Articles