লক্ষ্য ৩০ হাজার কোটি! যে কারণে সাফ হচ্ছে হায়দরাবাদের জঙ্গল
Telangana Land Auction Protest: সরকারের পরিকল্পনা হলো, তেলঙ্গানা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার কর্পোরেশনের মাধ্যমে এই জমি আইটি পার্ক ও মিশ্র-ব্যবহারের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নিলামে তোলা।
আবারও উন্নয়নের নামে পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর আঘাত। এবার তেলঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদে। হায়দরাবাদ সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউনিভার্সিটি অফ হায়দরাবাদের চারপাশে ৪০০ একর জমি যা দাক্ষিণাত্য মালভূমির বৈশিষ্ট্যে ভরা—পাথুরে গঠন (যেমন মাশরুম রক), ঝোপঝাড় এবং ছোট ছোট অংশে জঙ্গল। পরিবেশবাদীরা দাবি করেছেন যে, এটি সুপ্রিম কোর্টের টি এন গোদাবর্মন থিরুমুলপদ বনাম ভারত সরকার মামলার রায় অনুযায়ী 'ডিমড ফরেস্ট' বা মান্য বনভূমি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। এই শ্রেণিবিভাগ গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এটি জমিকে উন্নয়ন থেকে আইনি সুরক্ষা দিতে পারে এবং এর বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারে। এই ৪০০ একর জমি নিয়ে বিরোধ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তেলঙ্গানার রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে উত্তপ্ত আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই জমি, যা কাঞ্চা গাছিবোলি এলাকায় অবস্থিত, তেলঙ্গানা সরকারের দাবি অনুযায়ী রাজ্যের সম্পত্তি এবং এটি আইটি পার্ক ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নিলামে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্প্রদায় এবং পরিবেশবাদীরা এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তাঁদের যুক্তি, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তির অংশ এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিরোধ শুধুমাত্র জমির মালিকানা নিয়ে নয়, বরং শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের মধ্যে একটি গভীর দ্বন্দ্বকেই প্রতিফলিত করে।
এই ৪০০ একর জমির উপর সরকার, জমি মাফিয়া, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় যুক্ত কর্পোরেটদের নজর বহুদিনের। জমি নিয়ে বিরোধের শিকড়ও বেশ পুরনো। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ২,৩২৪ একর জমি বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু এই জমির আইনি দলিল কখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে পুরোপুরি হস্তান্তরিত হয়নি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে এই জমির কিছু অংশ সরকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করেছে, যেমন আইআইটি হায়দরাবাদ, গাছিবোলি স্টেডিয়াম ইত্যাদি। ২০০৩ সালের ৯ অগাস্ট তৎকালীন তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নায়ডুর নেতৃত্বাধীন সরকার এই ৪০০ একর জমি 'আইএমজি আকাডেমি ভারত' নামে একটি বেসরকারি সংস্থাকে ক্রীড়া অবকাঠামোর জন্য বরাদ্দ করার প্রাথমিক অনুমোদন দেয়। জমির আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন হয়েছিল ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই চুক্তিতে হায়দরাবাদের উপকণ্ঠে ৮৫০ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছিল, যার মধ্যে বিতর্কিত ৪০০ একরও ছিল। পরবর্তীকালে এই প্রক্রিয়া বিতর্কিত হয়ে ওঠে এবং ২০০৬ সালে পরবর্তী কংগ্রেস সরকার এই MoU এবং জমি বরাদ্দ বাতিল করে, এটিকে একটি কেলেঙ্কারি হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২০০৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার এই বরাদ্দ বাতিল করে এবং জমিটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে নেয়। ২০২২ সালে তেলঙ্গানা হাইকোর্ট রায় দেয় যে এই জমির মালিকানার কোনও আইনি দলিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নেই। এরপর ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্টও রাজ্য সরকারের দাবিকে সমর্থন করে, যা বর্তমান সংকটের পথ প্রশস্ত করে।
আরও পড়ুন- বাসাহারা ময়ূরদের তীব্র কান্না! পরিবেশ শেষ করে তেলঙ্গানায় ৪০০ একর জমিতে বুলডোজার কেন?
তেলঙ্গানার বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে রয়েছে কংগ্রেস। সরকারের দাবি, এই ৪০০ একর জমি সম্পূর্ণভাবে রাজ্যের সম্পত্তি। তাদের মতে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সম্মতিতে একটি জরিপ করা হয়েছিল, যা নিশ্চিত করেছে যে এই জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে পড়ে না। সরকারের পরিকল্পনা হলো, তেলঙ্গানা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার কর্পোরেশনের মাধ্যমে এই জমি আইটি পার্ক ও মিশ্র-ব্যবহারের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নিলামে তোলা। এই প্রকল্প থেকে প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সরকারের দাবি। মুখ্যমন্ত্রী এ রেবন্ত রেড্ডি এবং আইটি মন্ত্রী ডি শ্রীধর বাবু জোর দিয়ে বলেছেন যে এই উন্নয়ন পরিবেশের ক্ষতি না করেই টেকসই হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও জমি এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। তাঁরা অভিযোগ করেছেন যে বিরোধী দলগুলো, যেমন ভারত রাষ্ট্র সমিতি এবং ভারতীয় জনতা পার্টি রাজনৈতিক স্বার্থে ছাত্রদের বিভ্রান্ত করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্প্রদায় এই দাবি মানতে নারাজ। তাদের মতে, এই জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক সীমানার অংশ এবং এটি হায়দরাবাদের শেষ 'সবুজ ফুসফুস' (green lungs) হিসেবে পরিচিত। এই এলাকা জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ — ২৩৭ প্রজাতির পাখি, ভারতীয় তারকা কচ্ছপ, চিত্রা হরিণ, এবং অন্যান্য সংরক্ষিত প্রজাতির বাস। ছাত্রদের অভিযোগ, বুলডোজার ও ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে গাছ কাটা এবং পাথর সরানোর কাজ শুরু হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ২০২৫ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিবাদে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, ছাত্রদের আটক এবং লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্র ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে, তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বয়কট করবে এবং জমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে নথিভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলি যেমন ভাটা ফাউন্ডেশন, এই জমিকে 'ডিমড ফরেস্ট' হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে তেলঙ্গানা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছে। তারা সুপ্রিম কোর্টের টিএন গোদাবর্মন মামলার রায়ের উল্লেখ করে বলেছে যে, এই জমি বনভূমি হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার যোগ্য, যদিও রাজস্ব রেকর্ডে তা বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দেবেশ নিগম একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক জরিপ হয়নি, যা সরকারের দাবির ঠিক উল্টো। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, জমির যেকোনও হস্তান্তরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের অনুমোদন প্রয়োজন, যা ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত। এই দ্বিমত সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতিকে স্পষ্ট করে।
এই বিরোধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, সরকারের উন্নয়নের পরিকল্পনা কি সত্যিই টেকসই? পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ছাড়াই বুলডোজার চালানোর সিদ্ধান্ত পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি উদাসীনতার ইঙ্গিত দেয়। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির আইনি মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিনের অস্পষ্টতার কেন সমাধান করা হয়নি? এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবকে প্রকাশ করে। তৃতীয়ত, ছাত্রদের প্রতিবাদকে কেবল 'বিভ্রান্তি' বলে উড়িয়ে দেওয়া কি ন্যায়সঙ্গত? তাদের শিক্ষার পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার উদ্বেগ অত্যন্ত যৌক্তিক। সরকারের যে দাবি করেছে, অর্থাৎ এই জমি বনভূমি নয়, তাও কতটা সত্য? সুপ্রিম কোর্টের গোদাবর্মন রায় অনুযায়ী, বনভূমির সংজ্ঞা শুধু রাজস্ব রেকর্ডের ওপর নির্ভর করে না, বরং এর পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের উপরেও নির্ভর করে। এই জমিতে প্রাকৃতিক শিলা গঠন (যেমন মাশরুম রক) এবং বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি একে পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল করে তোলে। উন্নয়নের নামে এই সম্পদ ধ্বংস করা হলে হায়দরাবাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কী উত্তর দেবে সরকার? হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি বিরোধ শুধু আইনি বা প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি শিক্ষা, পরিবেশ এবং উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার একটি পরীক্ষা। সরকারের উচিত এই প্রকল্পে তড়িঘড়ি না করে স্বচ্ছ জরিপ, পরিবেশগত মূল্যায়ন এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা। অন্যথায়, এই 'সবুজ ফুসফুস' হারানোর মাশুল হায়দরাবাদবাসীকে দীর্ঘমেয়াদে দিতে হবে। ছাত্রদের আন্দোলন দমন করার পরিবর্তে তাদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, কারণ তারাই ভবিষ্যতের প্রতিনিধি। স্বচ্ছ মূল্যায়ন ও সুষ্ঠু সমাধান ছাড়া, এই এলাকার বন্যপ্রাণী— যা ইতিমধ্যে হায়দরাবাদের দ্রুত নগরায়ণের চাপে রয়েছে— এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। প্রশ্ন হলো, অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার কি এই প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে হেলায় হারাবে, না কি ছাত্র ও পরিবেশবাদীদের কণ্ঠের জয় হবে অবশেষে?