ভারতে ঘন জঙ্গলে বাঘের প্রথম ছবি তুলেছিলেন কে?

India’s First Wild Life Photo of Tiger: সেই সময় ব্রিটিশরা শিকারপ্রেমী ছিলেন খুবই। তবে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন আলাদা। বিনোদনের জন্য বন্যপ্রাণীদের গুলি করে শিকার করা ছিল তাঁর তীব্র না-পসন্দ।

ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি এখন বেশ জনপ্রিয় বিকল্প পেশা। তবে, সব কিছুরই শুরুর কাহিনি নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। ভারতবর্ষের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বাঘের প্রথম ছবিটি কে কীভাবে তুলেছিলেন জানলে অবাক হতে হয়। নাম ফ্রেডরিক ওয়াল্টার চ্যাম্পিয়ন। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন সৈনিক, ইম্পেরিয়াল ফরেস্ট্রি সার্ভিসের (তৎকালীন ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস) একজন অফিসার এবং সংরক্ষক। ভারতের জঙ্গলে বাঘের প্রথম ছবি তুলেছিলেন তিনিই। ১৯২১-ব্যাচের এই কর্মকর্তা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইউনাইটেড প্রদেশে (অনুমান, বর্তমান উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের অংশ) দায়িত্ব পালন করেন এবং ডেপুটি বন সংরক্ষকের পদে উন্নীত হন। ক্যামেরার ফাঁদ পেতে বন্যপ্রাণী ছবি তোলার কৌশলের একজন পথপ্রদর্শক তিনি। বিশ্ববিখ্যাত শিকারি জিম করবেট বলেছিলেন, ভারতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফির পথপ্রদর্শক ফ্রেডরিক ওয়াল্টার চ্যাম্পিয়ন। উল্লেখ্য, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রতি চ্যাম্পিয়নের অদম্য ইচ্ছা দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে বন্দুক ছেড়ে দেন করবেট। একসঙ্গে তাঁরা ১৯৩৫ সালে ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়ে ওঠে। ১৯৫৮ সালে এই জাতীয় উদ্যানের নাম হয় করবেট ন্যাশনাল পার্ক।

চ্যাম্পিয়নের জন্ম ১৮৯৩ সালের ২৪ অগাস্ট, ইংল্যান্ডের সারেতে। চ্যাম্পিয়নের বাবা জর্জ চার্লস চ্যাম্পিয়ন ছিলেন কীটতত্ত্ববিদ। পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়নের ভাই, স্যার হ্যারি জর্জ চ্যাম্পিয়ন ভারতের বনের প্রকারভেদ নথিভুক্ত করেছিলেন। ১৯১০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতে আসেন চ্যাম্পিয়ন। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার পুলিশ বিভাগে কাজ করেন। তারপরে পদোন্নতি হয়ে যোগ দেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি রিজার্ভ অফ অফিসারে (অশ্বারোহী শাখা)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯২০-র দশকের গোড়ার দিকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর, ইম্পেরিয়াল ফরেস্ট্রি সার্ভিসে যোগ দেন চ্যাম্পিয়ন। সেই সময় ব্রিটিশরা শিকারপ্রেমী ছিলেন খুবই। অবসর কাটাতে প্রাচীন রাজাদের মতোই মৃগয়ার শখ ছিল শ্বেতাঙ্গ শাসকদেরও। তবে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন আলাদা। বিনোদনের জন্য বন্যপ্রাণীদের গুলি করে শিকার করা ছিল তাঁর তীব্র না-পসন্দ। বরং বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলে রাখতে পছন্দ করতেন তিনি।

আরও পড়ুন-মানুষের মতো গোনা অসম্ভব! কীভাবে গভীর জঙ্গলে গোনা হয় বাঘের সংখ্যা?

ইম্পেরিয়াল ফরেস্ট্রি সার্ভিসে যোগ দেওয়ার আগেও চ্যাম্পিয়ন বনমধ্যে বাঘের ছবি তোলার চেষ্টা করেছিল। বন্যপ্রাণী ইতিহাসবিদ রাজা কাজমি উল্লেখ করেছেন, চ্যাম্পিয়ন বাঘের চূড়ান্ত ছবিগুলি তুলতে পারেন দীর্ঘ ৮ বছর পরে। কুমায়ুন জঙ্গলে তোলা, এই ছবিগুলি প্রথম ১৯২৫ সালের ৩ অক্টোবর 'দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ'-এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। ছবির শিরোনাম ছিল 'আ ট্রায়াম্ফ অফ বিগ গেম ফটোগ্রাফি: দ্য ফার্স্ট ফটোগ্রাফস অফ টাইগারস ইন দ্য ন্যাচারাল হান্টস'।

দুই বছর পর ‘উইথ ক্যামেরা ইন টাইগার-ল্যান্ড’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন চ্যাম্পিয়ন। মানুষের নাগালের বাইরে, গভীর জঙ্গলে বন্যপ্রাণীরা কীভাবে জীবন যাপন করে, ছবিতে সেই মুহূর্তগুলি ছবিতে তুলে ধরেছিলেন এই বইয়ে। এই ছবিগুলি তোলার জন্য তিনি যে কৌশলটি ব্যবহার করেছিলেন তাকে বলা হয় 'ট্রিপ-ওয়্যার ফটোগ্রাফি'। রাজা কাজমি ব্যাখ্যা করেছেন, একটি বাঘ (বা অন্য কোন প্রাণী) যে পথে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যায়, সেই পথের নীচে সাবধানে ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা হয় তারের জালে। সাধারণত রাতের বেলা ছবি ওঠে। প্রাণীটি তারের উপর ছিটকে পড়ে গিয়ে নিজের ছবি নিজেই তুলে ফেলে।

চ্যাম্পিয়ন 'দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ'-এ একটি চিঠিতে এই প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করেছেন, "এই ফটোগ্রাফগুলি বেশ অনন্য। আমি যদ্দূর জানি, বাঘেদের নিজস্ব বাসস্থানে এর আগে কখনও তাদের এমন ছবি তোলা হয়নি।" এই কৌশলে দীর্ঘকাল ছবি তোলা হয়েছে ভারতে। এই কৌশলটি এখন 'ক্যামেরা ট্র্যাপ ফটোগ্রাফি' নামে পরিচিত। সংরক্ষণকর্মীরা এখন এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করেন বাঘ গণনায় এবং বাঘের গতিবিধি নিরীক্ষণ করতে। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং পরিবেশ চর্চা বিভাগের অধ্যাপক মহেশ রঙ্গরাজন দ্য টেলিগ্রাফে এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, চ্যাম্পিয়ন ২০০টি ক্যামেরা ফাঁদ পেতেছিলেন। যার মধ্যে বাঘ এসেছে মাত্র ১৮ বার। সব মিলিয়ে, ৯টি বাঘের ১১টি ছবি উঠেছিল। চ্যাম্পিয়ন নিজেই লিখেছিলেন,

 

আরও পড়ুন-আজও বাঘের চোখে চোখ রেখে জঙ্গলে পা ফেলেন সুন্দরবনের ‘বাঘ বিধবা’-রা

'ফাদার অফ ক্যামেরা ট্র্যাপ ফটোগ্রাফি' চ্যাম্পিয়ন এমন এক সময়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যে সময় ব্রিটিশ কর্মকর্তারা কছে শিকার ছিল বিশাল এক গর্বের বিষয়। সেই সময়ে, শিকারের ফলে বাঘের সংখ্যা হ্রাস সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। বন্দুকের লাইসেন্স সীমিত করার জন্য, সংরক্ষিত বনে গাড়ি প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া এবং বন্যপ্রাণী হত্যার জন্য নগদ পুরস্কারের অর্থ কমিয়ে দেওয়ার কথা জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন চ্যাম্পিয়ন।

ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভারতের দ্বিতীয় ও শেষ গভর্নর-জেনারেল তখন সি রাজাগোপালাচারী (রাজাজি) শিকার ও বন্যপ্রাণ বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আনেন। বলা হয়, নবনিযুক্ত গভর্নর জেনারেল রাজাজিকে শিকারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিন্তু তিনি শিবালিক এলাকার জীববৈচিত্র্য এবং বন্য প্রাণীর আধিক্য দেখে এতটাই প্রভাবিত হয়ে যান যে শিকারের বদলে তিনি এই অঞ্চলে একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে শিবালিকের এই অংশে একটি অভয়ারণ্য তৈরি করা হয় যা আজ রাজাজি জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত।

১৯৪৭ সালের পরে চ্যাম্পিয়ন পূর্ব আফ্রিকা চলে যান। ৭৬ বছর বয়সে, ১৯৭০ সালে মারা যান তিনি। অনেকে বলেন, ইন্দিরা গান্ধি ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যে প্রজেক্ট টাইগার চালু করেছিলেন, তা আসলে চ্যাম্পিয়নেরই কাজের উত্তরাধিকার হিসেবে শুরু হয়। প্রজেক্ট টাইগারের প্রথম পরিচালক এবং কিংবদন্তী সংরক্ষণকর্মী কৈলাশ শঙ্খলা একবার বলেছিলেন, বাঘদের যদি ভোট দিতে দেওয়া হতো, তাহলে করবেট জাতীয় উদ্যানের নাম চ্যাম্পিয়নের নামে রাখা হতো।

More Articles