বাসাহারা ময়ূরদের তীব্র কান্না! পরিবেশ শেষ করে তেলঙ্গানায় ৪০০ একর জমিতে বুলডোজার কেন?
Hyderabad University Land Auction: এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বনভূমিতে অজস্র পাখির প্রজাতির বাস। সরীসৃপ, ঔষধি গাছ এবং বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী সহ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল এই বনভূমি।
হায়দরাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের কাছে যে ৪০০ একর জমি নিলাম হচ্ছে, সেই জমি থেকে ভেসে আসছে ময়ূরদের কান্না। অজস্র পশু পাখির বাসা হারানোর আর্ত চিৎকার। জমি খালি করার আদেশের পর কাঞ্চা গাছিবোলির জমিতে চলছে ভারী বুলডোজার। উপড়ে যাচ্ছে নিরীহ পশুপাখিদের আবাস। জমি বাঁচাতে মরিয়া প্রতিবাদ করছেন পড়ুয়ারা, শিক্ষকরা। তবে সরকার বলেছে জমি নিলাম হবেই। ৪৫০টিরও বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসের চেয়ে কর্পোরেট মুনাফা অনেক বেশি গুরুত্বের! হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ একর জমির নিলাম এখন তেলঙ্গানার সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যু। তবে এই বিতর্কের শিকড় প্রাচীন। ১৯৭০-এর দশকে তেলঙ্গানা আন্দোলন যখন শীর্ষে, রাজ্যের অধিকার এবং তেলঙ্গানার স্বার্থ রক্ষার লড়াইয়ে শয়ে শয়ে পড়ুয়া নিজেদের প্রাণ দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে খাম্মাম থেকে শুরু হয় এই আন্দোলন। আর অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়ে। তেলঙ্গানার অধিকার রক্ষার জন্য ১৯৫৬ সালের জেন্টলমেনস এগ্রিমেন্টের বাস্তবায়ন ছিল এই আন্দোলনের মূল দাবি।
সমান্তরালভাবে তখন জয় অন্ধ্র আন্দোলন চলছিল। সেই সময় রাজ্য এবং কেন্দ্র দুই সরকারেই ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। আন্দোলন তীব্র হতে দেখেই, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য একাধিকবার হায়দরাবাদ সফর করেন। অবশেষে ১৯৭৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ছয়-দফা সূত্রকে আপস হিসাবে ঘোষণা করেন। এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য, সংবিধানে ৩২তম সংশোধনী হয়। তাতেই ৩৭১(ডি) এবং ৩৭১(ই) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৮ অক্টোবর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ একটি রাষ্ট্রপতি আদেশ জারি করেন। এই আদেশটি অন্ধ্রপ্রদেশ পাবলিক এমপ্লয়মেন্ট (স্থানীয় ক্যাডারের সংগঠন এবং সরাসরি নিয়োগের নিয়মিতকরণ) আদেশ, ১৯৭৫ নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন- প্রান্তিক মানুষকে উচ্ছেদ করেই কেন বাস্তবায়নের মুখে দেশের প্রথম নদী সংযোগ প্রকল্প?
ছয়-দফা সূত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান ছিল তেলঙ্গানায় একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, যা পরবর্তীকালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার, ওই সূত্রের প্রতিশ্রুতি হিসেবেই, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২,৩০০ একর জমি বরাদ্দের প্রশাসনিক আদেশ জারি করে। তবে এই জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি। তেলঙ্গানার প্রতি ইন্দিরা গান্ধির আস্থাতেই সেই সময় অন্ধ্রপ্রদেশ জুড়ে রাখা যায়।
২০২৫ সালে তেলঙ্গানা সরকারের অধীনস্থ তেলঙ্গানা স্টেট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার কর্পোরেশন (TGIIC), আইটি এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির জন্য হাব তৈরির উদ্দেশে কাঞ্চা গাছিবোলিতে ৪০০ একর জমি নিলামের প্রস্তাব দিয়েছে৷ এই পদক্ষেপকে চরম সমর্থন জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তথা মন্ত্রী শ্রীধর বাবু এবং কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি।
ইতিমধ্যেই মূল বরাদ্দকৃত ২,৩০০ একর জমির এক বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। TSRTC, মিউনিসিপ্যাল কার্যালয়, বালযোগী স্টেডিয়াম, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যানিমেল বায়োটেকনোলজি সহ বিভিন্ন সংস্থার কাজে এই জমি ব্যবহৃত হয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি রক্ষা করার পরিবর্তে, তেলঙ্গানা সরকার তার দাবির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে আইনের ফাঁকফোকর এবং নথির অভাবকে কাজে লাগিয়ে জমি নিলামে তুলছে বলে অভিযোগ।
Heartbreaking video of peacocks crying for help as Telangana govt is clearing 400 acres of green space near the University of Hyderabad for an IT park.
— Megh Updates 🚨™ (@MeghUpdates) April 2, 2025
Students are protesting, citing its rich biodiversity with 455+ species of flora & fauna.
All environment, 5 star activists &… pic.twitter.com/7H1Qo78Wio
যদি ৪০০ একর জমি নিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে পুরো ক্যাম্পাস দখল করতে সরকারের আর কোনও বাধাই তেমন থাকে না। ইতিহাস বলছে, বিভিন্ন রাজ্য সরকার বিভিন্ন অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি দখল করেছে। ২০০৪ সালে, মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর আমলে, খেলাধুলোর সুবিধার জন্য পাঁচ বছরের সমঝোতা স্মারকের অধীনে ৪০০ একর জমি বরাদ্দ করা হয় আইএমজি ভারতকে। ২০০৫ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে আবিষ্কার করে যে আইএমজি ভারত আদতে একটি ভুয়ো সংস্থা। তা সত্ত্বেও এই জমি হস্তান্তরের অনিয়মের বিষয়ে কেন্দ্রীয়স্তরে কোনও সরকারই কোনও তদন্ত শুরু করেনি। রেবন্ত রেড্ডি তখন বিধানসভায় এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় যদি বৈধভাবে জমির মালিক না হয়, তাহলে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদ ২০০৩ সালে ক্রীড়া আকাদেমির জন্য জমি বরাদ্দের প্রস্তাব পাস করেছিল? ২০২১ সালের একটি রায়ে, তেলঙ্গানা হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি রক্ষা করার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ওই জমি আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই তেলঙ্গানা সরকার আবারও জমি দখলের দিকেই এগোচ্ছে।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় তেলঙ্গানা আন্দোলনের প্রতীক তো বটেই, এই রাজ্যের আত্মসম্মানের চিহ্নও। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঐতিহ্যকে নষ্ট না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা বৃদ্ধিরকাজ করা উচিত ছিল সরকারের। উচিত ছিল, তেলঙ্গানার পড়ুয়াদের বিশেষ সংরক্ষণের পক্ষে কথা বলা।
আরও পড়ুন- গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জিয়নকাঠি! যেভাবে পরিবেশের সর্বনাশ করছে কার্বন ডাই অক্সাইড
শুধু আন্দোলন বা রাজনৈতিক গুরুত্বের নয়, কাঞ্চা গাছিবাউলি জমি হায়দরাবাদের প্রাণও। যে কিঞ্চিৎ বনভূমি বেঁচে আছে, সবুজ অবশিষ্ট আছে, তারই অন্যতম এই জমি। সুপ্রিম কোর্টের একটি বিচারে এই জমি বনভূমি হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করেছে। উল্লেখ্য, বনভূমির সীমানা নির্ধারণ এবং রাজস্ব বিষয়ক সমীক্ষার আগে, রাজ্য সরকার এই জমিটিকে অনুর্বর দেখানর মিথ্যা চেষ্টায় অনেক গাছ কেটে ফেলার চেষ্টাও করেছিল। তেলঙ্গানা হাইকোর্টে দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলার পরে, বনাঞ্চল চিহ্নিত করতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, জনগণের নির্বাচিত সরকার কি তবে জনকল্যাণের চেয়ে কর্পোরেট স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে? যে কংগ্রেস সরকার অন্যত্র বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে কথা বলে, সেই কংগ্রেসেরই ক্ষমতায় থেকে এমন আচরণ স্ববিরোধিতা নয়?
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বনভূমিতে অজস্র পাখির প্রজাতির বাস। সরীসৃপ, ঔষধি গাছ এবং বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী সহ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল এই বনভূমি। মাশরুম শিলার মতো প্রাচীন শিলা রয়েছে এই অঞ্চলে, আছে চারটি হ্রদ যা স্থানীয় বন্যপ্রাণীদের ভরসা। আশ্চর্যের বিষয়, কোনও পরিবেশগত সমীক্ষা বা পরিবেশের উপর এর প্রভাবের মূল্যায়ন না করেই, মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি জমি নিলামকে সমর্থন করছেন। বিধানসভায়, কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি বলেছিলেন, "কোনও সিংহ বা বাঘ নয়, কেবল 'ধূর্ত শিয়াল'-রাই উন্নয়নে বাধা দেয়।" কাদের 'ধূর্ত শিয়াল' বলছেন মুখ্যমন্ত্রী? তাঁর নিশানায় আছেন প্রতিবাদী ছাত্র, শিক্ষকরা, পরিবেশবিদরা এবং সুশীল সমাজের সদস্যরা।
একজন মুখ্যমন্ত্রী যদি পরিবেশকে শেষ করে দিতে বদ্ধ পরিকর হন, তাহলে দেশের জীববৈচিত্র্য, বা পরিবেশ রক্ষার বিপুল কর্মকাণ্ডের কাছে তা এক অশনি সংকেত বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কংগ্রেস সরকারের এমন পদক্ষেপ দলের অস্তিত্বের উপর জোড়া আক্রমণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কংগ্রেসের অবশ্যই তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব, ইন্দিরা গান্ধির উত্তরাধিকার এবং তেলঙ্গানার স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুতিকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। তবে এই বিষয়ে কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতাদেরই নীরবতা ভাঙতে হবে। উচ্চ শিক্ষা এবং পরিবেশের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি বিক্রি না ঠেকাতে পারলে, এই দেশে রাজনৈতিক জমি হারিয়ে শূন্য হয়ে যেতে পারে প্রধান এই বিরোধী দল।