চৈত্র শেষের হেঁশেল || ব্রতকথার মতো ফেলে আসা গ্রামের পথ

চৈত্র মাস শেষ হতে চলল। আর হপ্তাখানেক পেরলেই নতুন বচ্ছর। বাংলা বছর এই গাঁয়ে যায়-আসে নিজের খেয়ালে। তার চেয়ে বরং অনেক জাঁক হয় বচ্ছরকার পালাপার্বণে। মেয়েদের মায়েদের কথা অবশ্যি আলাদা। তাদের যে কত কী পালতে হয়! নয়তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার কি এমনি এমনি টিকে আছে? গোপালের মা এসব মানে বাপু। বউ ঝি-দের কি এসব না মানলে চলে? এই তো আজকেই ধরো না, সকাল সকাল পুজোর জোগাড় সেরে নিয়েছে। এবার গোপালের বাপকে আপিসের ভাত জুগিয়ে দিয়েই পুজোয় বসবে এখন। তা টেরেনের বাঁশি বাজতে এখনও দেরি আছে, সবে তো সকাল সাতটা বাজে। বটি পেতে ডুমো ডুমো করে কুমড়ো কেটে নিচ্ছে গোপালের মা, বৃহস্পতি। আলু, বেগুন, পুঁই দিয়ে একখান মাখো মাখো ঘণ্ট হবে। কালো কলাইয়ের ডাল হবে আর যুকতি ফুল দিয়ে আলু সানা হবে। একজন মানুষের আর কী লাগে!

গোপাল গেছে মামার বাড়ি। ওর মেজমামা এসে ওকে নিয়ে গেছে। বললে, চ গোপলা, কঙ্কালীতলায় মোচ্ছব হবে, বল্লভপুর ডাঙায় গাজন হবে, সেসব দেখবি চ! তা যাক, মামার বাড়ির আদর আর কতটুকুই বা পায়! গোপালের মায়েরও কি ইচ্ছে করে না, কঙ্কালীতলার মেলায় গিয়ে ফুটকড়াই কিনে খেতে? ধুলো ওড়ানো শালপাতার থালায় খিচুড়ি খায় না ও কত দিন! খাবেই বা কী করে, আপিসের ভাত ধরিয়ে দিতে হবে না! লোহার কড়াখানা চাপিয়ে রসুন শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেয় ও। এই গরমে পাতলাপারা না হলে কি কলাই ডাল ভাল লাগে! এদিকে দেখি লোকে আবার আদা-মৌরি বাটা দিয়ে কলাই ডাল রাঁধে। বৃহস্পতির ওই স্বাদ মনে ধরে না। বেশ রসুন-ফোড়নে পাতলা ডাল হবে! তবে না খেয়ে সুখ! গোপালের বাপ বলে, এত পাতলা করো কেন ডাল? একথা-র উত্তর দেয় না গোপালের মা। বলে, খাও তো। খাও। এই যে করে দিচ্ছি এই তোমার ভাগ্যি!

গোপালের বাপ আর কথা বাড়ায় না। আসলে গোপালের বাপ তো জানে না, মেয়েলোকের স্বাদকোরকে একখান বাপের বাড়ি ঘাপটি মেরে বসে থাকে আজম্মকাল। সে সময়ে সময়ে বলে ওঠে, এমন চৈতের দিনে লালতে শাকের ঝোল রাঁধ, খেরো দে মাছের ডিম রাঁধ। তা বললি আর শুনছে কে! এখানে খেরো আর কই! লোকে বলে, কী? খিরা? বেস্পতি আর বুঝিয়ে উঠতেই পারে না, খেরোটা যে কী! মেজদাকে তাই বলেছে আসছে বছর খেরোর বীজ এনে দিতে। এই তো বেড়ার ধারে একফালি লাগাবে এখন।


ডাল নামিয়ে নিতে নিতে ব্যস্ত হাতে যুকতি ফুল অল্প তেলে শুকনো লঙ্কা-ফোড়ন দিয়ে নেড়েচেড়ে নেয় ও। এসব জিনিস বাপের জম্মে খায়নি ও। দেখতে যে কী সুন্দর! দেখলেই মনে হয়, পুতুলের বিছানা সাজাই। তা এই বুড়ো বয়েসে আর পুতুলের বিছানা কোথায় বলো! পুতুলের সংসারে পুতুল হয়ে অশোকষষ্ঠীর দিনে বেস্পতি তাই যুকতিফুল রাঁধে মন দিয়ে বা মান না দিয়ে। আজ তো এই একজনের রান্না, বেস্পতি তো আর ভাত খাবে না! ষষ্ঠীর দিনে কি মায়ের ভাত খেতে আছে? গোপালের বাপ বেরিয়ে গেলে চান-টান সেরে বেস্পতি পুজো সেরে নেবে। ব্রতকথা পড়া হলে কাঁঠালি কলায় গেঁথে অশোকফুল গিলে খাবে, মুগকলাই খাবে। এমন সব চৈত্রদিনের আচারে ডুবে যেতে যেতে মনে মনে কেবলই বলবে ও, আমার গোপালকে ভাল রেখো মা, স্বামী-স্তিরিতে সদ্ভাব রেখো। গোপালের বাপের পুরনো আশনাই মনে পড়ে গেলে, আরও খানিক গড় হয়ে নমো করে ও। মাথা ঠুকে ঠুকে গড় করে। ইস্‌, বেস্পতির ফেলে আসা জীবনে, সেই সরকারডাঙায় কত যে অশোক গাছ ছিল! এমন বাজারে কিনে ফুল খেতে হয় সেখানে কেউ ভাবতেও পারে না। অমন থোকা থোকা ফুলের তলায় ওরা কত কত দিন খেলনাবাটি সাজিয়েছে! সেই বিন্তিদের সঙ্গে খেলার দিনগুলো বড় মনে পড়ে আজ। এই সংসারের কলে পড়ে কতদিন যে অমন ফুলের দিকে চেয়েই দেখেনি ও! সেই ব্রতকথার গপ্পের মতো ও–ও যদি অশোকের বীজ ছড়াতে ছড়াতে আসত, তবে বেশ হত। সেই বীজ থেকে সার সার গাছ হলে, এমন দিনে তারা কেমন ফুলে ভরে থাকত! বেস্পতি ঠিক সে পথ ধরে ফিরে যেত সরকারডাঙায়।

আচ্ছা, অশোক কি সত্যিই মানুষের শোক-তাপ ভুলিয়ে দেয়? হবেও বা। অমন ফুলের দিকে চাইলে মনের তলাখান অবধি রঙিন হয়ে যায় মানুষের, পশুপক্ষীর। সেসব ভুলে এখন খালি দশকর্ম্মার দোকান থেকে অশোকফুল কিনে খাও। সে খেয়েও বা শান্তি কোথায় বলো! গোপালের বাপে যে মিলের মেয়েছেলেদের সঙ্গে আশনাই করবে না, তাই বা কে বলতে পারে! ওরে বিশ্বাস নেই।

চৈতি দিনের হাওয়ার মতো এসব ভাবনা ওর বুকে একখানা জ্বালা ধরিয়ে দেয়। বুকখানা তখন অমন থোকা থোকা অশোকফুল হয়ে ওঠে। সেই ফুলের গোছা বুকের মধ্যে নিয়ে গোপালের মা, কাঁঠালিকলা দিয়ে সাবু মাখে, চিনি ছড়িয়ে মুগ ভেজানো খায়। সেসব সারা হলে, পাটি পেতে শুয়ে পড়ে সটান। এই একটুখানিই বিশ্রাম। আরেকটু পরেই পাশের পাড়ায় ইফতারির পসরা নিয়ে লোকে লোকাকার হয়ে উঠবে। আলুর চপ, বেঙনি, ডাল ফুলুরি- কী নেই। এই বড় বড় তরমুজ কেটে কেটে বিক্কিরি করবে ফেরিওয়ালারা। এসব দেখতে ওর কিন্তু ভারি ভাল লাগে।

আহা! সরকারডাঙার মতো চপ এদিকে ভাজতে পারে না গো! অমন আলুর পুর এদিকে কই? একগাদা সোডা দিয়ে খালি বেসনের গোলা করে। ও চপ খেলে চোরা অম্ল হয়, বুক চিন চিন করে। সরকারডাঙায় চপ খাও দেখি, না হবে অম্ল, না হবে কিছু। কুসুম বীজ ছড়িয়ে সে চপ কেমন মুচমুচে! আহা! এসব মনে পড়লে ষষ্ঠীর দিনেও বেস্পতির মুখে জল এসে পড়ে। পুতুলের সংসার ফেলে, মিলের মেয়েছেলেদের ভয় ফেলে তখন ওর ইচ্ছে করে অশোকফুলের পথ ধরে ওর ফেলে আসা গাঁও-ঘরে ফিরে যেতে।

ইস্‌, যাঁরা এমন ব্রতকথা লিখেছিলেন, তাঁরাও বুঝি জানতেন, মেয়েরা ফিরে যেতে চায় সরকারডাঙায়, সময়ে-অসময়ে, সেই যেখানে থোকা থোকা অশোকফুলে ঢেকে আছে পথ!

সেইখানে। সেইখানে।

More Articles