থামল 'অন্ধ স্কুলের ঘণ্টা', প্রয়াত কবি দেবারতি মিত্র
Debarati Mitra: সমকালীন বাকি কবিদের তুলনায় দেবারতি অবলীলায় গড়ে তুলেছিলেন এক অন্যতর কাব্যভুবন। যা প্রবল ভাবে নারীবাদী অথচ তার মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য এক স্নেহলতা। যা জড়িয়ে ছিল তাঁর কবিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে।
কোনও এক শীতের সকালে থেমে গেল সেই অন্ধ স্কুলের ঘণ্টা। পড়ালেখার পালা কি শেষ হল তবে! নাকি নতুন করে শুরু হল তাঁকে পড়ার, জানার।
"কবিতা নিয়ে আমি কিছু করতে পারি না, করতে চাই না, শুধু পৌঁছতে চাই সেই সমুদ্রের কিনারায় যার একদিকে জীবন ও শিল্প, অন্য দিকে শূন্যতা যেখানে কল্পনা মুহুর্মুহু অবিরাম নিজেকে সৃষ্টি করে চলে। ঘটনাচক্রে আমার জীবনে কবিতার বিকল্প আর কিছু নেই, ওই একটিমাত্রই আমার পথ ও পাথেয়।"
— আর সেই পথকে পাথেয় করেই গোটা জীবনে বেঁচেছেন দেবারতি মিত্র। একদিন সেই কবিতার ডিঙিনৌকার পালে বুক বেঁধেই সংসার সমুদ্রেও পাড়ি জমিয়েছিলেন দুই সহযাত্রী। নৌকার এক নাবিক দাঁড় টানা বন্ধ করেছেন আগেই। এবার থামল অন্যটিও। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে প্রয়াত হলেন কবি দেবারতি মিত্র। বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। বার্ধক্যজনীত অসুস্থতায় ভুগছিলেন অনেক দিন থেকেই।
বাংলা কবিতার ভুবন এমন কবিজুটি আর পেয়েছে কিনা বলা কঠিন। তবু মনীন্দ্র গুপ্তের কথা বলতে গেলেই কীভাবে যেন এসে পড়ত দেবারতির কথা। একই ভাবে দেবারতির কথায় মনীন্দ্র আসবেন না, এমনটা যেন হয় না। তবু কবি হিসেবে তাঁরা বরাবরই স্বতন্ত্র। সমকালীন বাকি কবিদের তুলনায় দেবারতি অবলীলায় গড়ে তুলেছিলেন এক অন্যতর কাব্যভুবন। যা প্রবল ভাবে নারীবাদী অথচ তার মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য এক স্নেহলতা। যা জড়িয়ে ছিল তাঁর কবিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে।
সেইখানে দেখি তুমি অসম্ভব গাঢ় মমতায়
মেদুর লাবণ্যঘন মাটি;
জলপাই গাছটির সূচিকন চুলের মতন
অসংখ্য শিকড় একা বুকে করে শুয়ে আছ।
মাঝে মাঝে এ রকম এক একটি সকালে
মনে হয় বেঁচে আছি, খুব ভালো লাগে।(মাঝে মাঝে সকাল হয়)
এক আশ্চর্য মায়াবী পৃথিবী রচনার খেলা চলতে থাকে দেবারতির খাতা জুড়ে। দেবারতির জন্ম ১৯৪৬ সালের ১২ এপ্রিল কলকাতায়। বাবা অজিত কুমার মিত্র এবং মা গীতা মিত্র। যোগমায়া দেবী কলেজে পড়াশোনার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন তিনি। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর করেন। বালিকা বয়স থেকেই কবিতাচর্চা শুরু হলেও প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধস্কুলে ঘণ্টা বাজে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। সেই প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিয়েই যেন নিজেকে চিনিয়ে দিলেন দেবারতি। তিনি আলাদা। সত্তর দশকের বাকি কবিদের থেকে আলাদা ভাষা। সত্তর দশক রাজনৈতিক ভাবে উত্তাল। নকশাল আন্দোলন থেকে রাষ্ট্রপতি শাসনের ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলি, সবই সময়ের উপরে রেখে যেতে চলেছে তীব্র ছাপ। তার উপর বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ছাপও এ দেশের সাহিত্যের উপর স্পষ্ট। সেসময় দেবারতি বেছে নিয়েছেন এক অন্যতর ভাষা। এক অন্যতর উপলব্ধীর কাছে পাঠককে পৌঁছে দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: থামল মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর
নারীবাদের ভাষা মানেই উচ্চকিত, তীব্র আশ্লেষবোধ কিংবা প্রতিবাদ ঝঙ্কৃত হবে তাতে প্রতিমুহূর্তে, তার বাইরেও যে রচনা করা যায় অন্য এক কবিতার বলয়, গোড়াতেই বুঝিয়ে দিলেন দেবারতি।
প্রিয়তম পুরুষটি এক পা একটুখানি উঁচু করে
বিছানায় ভেসে আছে দেবদূত
সুকুমার ডৌলভরা মাংসল ব্রনজের ঊরু
অবিশ্বাস্য নিখুঁত সহজ গ্রীক ভাস্করতা
হঠাৎ সচল হয়ে ডাকে তরুণীকে।
দু হাতে জড়ানো নারী
তার ঊর্ধশরীরের গভীর সৌকর্য ফেলে রেখে
গা শিরশিরে লোভে
দু পায়ের ফাঁকে এসে মুখ গুঁজে দেয়গ্রীষ্মের ঠিক আগে মাইল মাইল ব্যাপী সরলবর্গীয় বনে ঝড়
একটানা আতশবাজির তীব্র রঙচঙে চক্কর স্তনান্তরে ঢেউ লাগে,
অসম্ভব অনুরক্তা শিশুসুলভতা নিয়ে
অচেনা আশ্চর্য এক লালচে কিসমিসরঙা
ফুলের কোরক মুখে টপ করে পোরে,
মাতৃদুগ্ধের মতো স্বাদু রস টানে।(পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী তারা দুজন)
নারীমনের প্রতিটি গোচর-অগোচরকে এভাবেই ধরে রাখেন তিনি তাঁর লেখায়। মোট ৯টি কাব্যগ্রন্থে সাজানো তাঁর সাহিত্যজীবন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'যুবকের স্নান', 'আমার পুতুল', 'ভূতেরা ও খুকি', 'তুন্নুর কম্পিউটার', 'থঙহোয়া ফুল সাদা','খোঁপা ভরে আছে তারার ধুলোয়'। তাঁর প্রথম প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা পরবর্তীকালে ইংরেজিতে অনুদিত হয়। ইন দেয়ার ওউন ভয়েস: দ্য পেঙ্গুইন অ্যান্থোলজি অফ কনটেমপোরারি ইন্ডিয়ান ওমেন পোয়েটস্ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৩ সালে। দ্বিতীয়টি ম্যাজেস্টিক নাইটস:লাভ পোয়েমস্ অফ বেঙ্গলি ওমেন, ২০০৮ সালে সেটি প্রকাশিত হয় হোয়াইট পাইন প্রেস থেকে। বই দু'টির অনুবাদ করেন ক্যারোলিন রাইট এবং পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও বেশ কিছু গদ্য ও প্রবন্ধের বই রয়েছে দেবারতির। ১৯৯৫ সাল নাগাদ আনন্দ পুরস্কার পান দেবারতি। কৃত্তিবাস ছাড়াও পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার তথা রবীন্দ্র পুরস্কারও। ২০০৩ সাল নাগাদ জাতীয় কবি নির্বাচিত হন দেবারতি।
তাঁর জীবন বা কবিতা, কোনওটাই দেশ-কাল,পরিবেশ বাদ দিয়ে নয়। দেবারতি বারবার বলতেন, নির্জন দ্বীপে বলে কবিতা চর্চা করতে পারবেন না তিনি। সংসারের যে রক্তমাংসের মানুষটি আর কবিতার যে মানবী, সেই দুজন কি এক। তিনি জানিয়েছেন, সংসারের নিয়মিত কাজকর্ম, ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসের কাজ বা সামাজিক দায়িত্বের মধ্যেই কিন্তু কী করে যেনকবিতার আবছা বিচ্ছুরণ,আড়মোড়া ভাঙা, নানারকম ছেড়াখোঁড়া হাসি ও বেদনার স্পন্দন চলতে থাকে। তাই কি জন্ম দেয় তাঁর ভিতরে কবিতার বীজ?
বেলা হল, রাত্তিরে ভেজানো বিছানার চাদর
ঝটপট কেচে দিই, বারান্দায় মেলি।
মাঠের কোণে বাঁকা রোদ, কাজলবউ টিউবেল পাম্প করছে,
একটা ছাগল আনমনে ঘাস ছিঁড়ছে,
কাকের ডাক, অটো রিকশার হর্ন একঘেয়ে মন্থর,
মেঘলা শিকড়হীন অবসাদ, না-প্রতীক্ষার প্রহর।সংসার হিজিবিজি নিষ্ঠুর বই -
একটি অক্ষরও পড়ে দেখতে সাধ হল না।(সকালের গার্হস্থ্য)
এই নিরাসক্তিই কি তাঁর কাব্যভুবনের বাঁশ-দড়ির কাঠামোটি! যেখান থেকে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর নিটোল কাব্যপ্রতিমাটিকে। যার শরীরে লেগে থাকে দেশ, কাল, সময়ের কাদাধুলোটি, আবার তার উপরেই জড়িয়ে ওঠে স্নেহকল্পলতাটি, যা দেবারতির পাঠককে পৌঁছে দিয়েছে, দেবে এক অন্যতর দুনিয়ায়।
ব্যর্থতা একটি মৌচাক।
আমি সেখানে নানা প্রায়শ্চিত্ত থেকে এনে
অশ্রু ভরি।
ভিজে বিদ্যুতের মতো তার ভিতরটা,
বাইরে মৃত করবীর বন।(ব্যর্থতা একটি মৌচাক)
আরও পড়ুন: মেহেফিল পড়ে রইল, পড়ে রইল অসম্পূর্ণ বন্দিশ! চলে গেলেন উস্তাদ রাশিদ খান
সেই মায়াবী কলম থেমে গেল শীতকালের এক সকালে। ২০১৮ সালে মনীন্দ্র গুপ্ত প্রয়াত হন। এবার চলে গেলেন দেবারতিও। যে ব্যতিক্রমী কবিতা-সংসারের জন্ম দিয়েছিলেন এই কবিদম্পতি, সেই আলোটি ফুরিয়ে গেল শেষমেশ। তবে রয়ে গেল তাঁর কবিতারা। এক অনুচ্চকিত মানবীস্বর, যা পৃথিবীর আলো-জল-মাটি-ঘাস ছুঁয়েও নিবিড়, মায়াময়, স্বতন্ত্র।