মানুষের মতো করেই ব্যথা পায় গাছ || যুগান্তকারী আবিষ্কার বাঙালি বিজ্ঞানীদের

"ছেলেবেলা থেকেই চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখাই তার অভ্যেস, নড়ে-চড়ে বেড়ানো নয়। পুবদিকের আকাশে কালো মেঘ স্তরে স্তরে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ায়, ওর সমস্ত মনটাতে ভিজে হাওয়া যেন শ্রাবণ অরণ্যের গন্ধ নিয়ে ঘনিয়ে ওঠে; ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে, ওর সমস্ত গা যেন শুনতে পায় সেই বৃষ্টির শব্দ। ছাদের উপর বিকেল-বেলাকার রোদদুর পড়ে আসে, গা খুলে বেড়ায়; সমস্ত আকাশ থেকে কী যেন একটা সংগ্রহ করে নেয়।"

যদিও রবিঠাকুর একথা লিখেছিলেন তাঁর চরিত্র বলাই সম্পর্কে, গাছ সম্পর্কে নয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে বলাই এবং গাছের অনুভূতিকে এক করে দেখেছিলেন তিনি। তার প্রায় তিন দশক আগে চার্লস ডারউইন, তাঁর লেখা 'পাওয়ার অফ মুভমেন্টস ইন প্ল্যান্টস' বইতে লিখেছিলেন, গাছও আলো, স্পর্শ, আঘাত, কিংবা অন্যান্য বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া দেয়। ডারউইনের বহু পরে ১৯০১ সাল নাগাদ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রথম প্রমাণ করেন, গাছের প্রাণ আছে; শুধু তাই-ই নয়, বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া দেয় তারাও।

জগদীশ বসুর অনেক পরে, ১৯৭০ সালে, চিলির জীববিজ্ঞানী এবং দার্শনিক হামবার্টো ম্যাচ্যুরানা প্রাণী ও উদ্ভিদের চেতনা বা কনশাসনেস সম্পর্কে মত প্রকাশ করে বলেন, বেঁচে থাকার পদ্ধতিতেই প্রাণী ও উদ্ভিদের চেতনা প্রকাশের পদ্ধতি লুকিয়ে রয়েছে। এবং এটি মস্তিষ্কযুক্ত এবং মস্তিষ্কবিহীন জীব, দুইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই চেতনাই কোনও জীবকে তার বাহ্যিক জগৎ- অর্থাৎ আলো, জল, বাতাসের উপস্থিতি, শত্রুর আঘাত থেকে রক্ষা, খাদ্যের উৎস ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন করে। এবং সেই মতো কোনও কোনও জীব তার বেঁচে থাকা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেখায়।

আরও পড়ুন: মানুষের নগ্ন ছবি দেখেই সাড়া দিল ভিনগ্রহীরা? কী বলছে নাসা?

আর যখনই উদ্ভিদের বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে, তখনই সেই অবধারিত প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি দেয়। তাহলে গাছেরও কি ব্যথা লাগে? গাছেরও কি শারীরিক কষ্ট হয়, যখন আমরা তার পাতা ছিঁড়ি বা ডাল কেটে দিই? সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিন বিজ্ঞানী- ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের ড. পবিত্র পাল চৌধুরি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তরা সেনগুপ্ত এবং নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের শুভদীপ চক্রবর্তী। জানালেন, প্রাণীদের মতো উদ্ভিদও ব্যথা অনুভব করে। শারীরিক আঘাতে সাড়া দেয় তারাও। এবং মজার বিষয় হল, এই ব্যথা অনুভূত হওয়ার জন্য উদ্ভিদের মস্তিষ্ক এবং মানুষের মতো স্নায়ুতন্ত্র না থাকলেও, মানুষ ও উদ্ভিদ দুই-ই কিন্তু একই জৈবরাসায়নিক পদ্ধতির সাহায্যে ব্যথা অনুভব করে।

গামা-অ্যামাইনো বিউটারিক অ্যাসিড বা গাবা মানুষ ছাড়াও একাধিক প্রাণীর শরীরে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে। নিউরোট্রান্সমিটারকে সহজে বোঝাতে গেলে বলতে হয়, এরা নিউরোন বা নার্ভকোশ থেকে ক্ষরিত রাসায়নিক। যারা নার্ভের মাধ্যমে পরিবাহিত হলে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক অনুভূতি আমরা টের পাই। গাবা আদতে ব্যথার অনুভূতি কমাতে সাহায্য করে মানুষের শরীরে। এদিকে দেখা গেল, কড়া রোদে যে গাছটি নুয়ে পড়েছে বা পর্যাপ্ত রোদে যে গাছটি ঝলমলিয়ে উঠেছে, কিংবা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে গাছের ডিম্বাণুর দিকে যখন ফুলের রেণু ধাবিত হচ্ছে তাকে নিষিক্ত করবে বলে, সেখানেও গাবার হাত আছে।

এদিকে এই সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারের বহু আগেই গাবা-র পাশাপাশি মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরে বিজ্ঞানীরা সন্ধান দিয়েছিলেন আয়নোট্রপিক গ্লুটামেট রিসেপ্টরের। দেখা গেল, আয়নোট্রপিক গ্লুটামেট রিসেপ্টর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র অর্থাৎ মস্তিষ্ক এবং শিরদাঁড়ার মধ্য দিয়ে উদ্দীপনা পরিবহন করে। শুধু তাই নয়, নতুন কিছু শেখা এবং মনে রাখার নেপথ্যেও এর অবদান অনস্বীকার্য। অন্যদিকে আয়নোট্রপিক গ্লুটামেট রিসেপ্টর উদ্ভিদের শরীরে দেখা না গেলেও, ঠিক একইরকমের রিসেপ্টর আছে তার শরীরেও; যার সাহায্যে সে আলো, ছায়া, তাপ-উত্তাপ, জলের অভাব ইত্যাদি নানান বাহ্যিক উদ্দীপনার প্রতি সাড়া দেয়। একে বলে রিসেপ্টর। অর্থাৎ মেরুদণ্ডীদের দেহের গ্লুটামেটের মতো এই গ্লুটামেটের মতো রিসেপ্টর। রিসেপ্টরকে যদি সহজ ভাষায় বোঝানো যায়, তাহলে বলতে হয়, এটি একটি দরজা, যার সাহায্যে কোশে কোনো রাসায়নিক পদার্থ এবং বিভিন্ন আয়ন কোশে ভেতর ঢোকে এবং কোশ থেকে বেরিয়ে যায়।

পুরোনো গবেষণা থেকে জানা গেছিল, বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাণীদের আয়নোট্রপিক গ্লুটামেট রিসেপ্টর এবং উদ্ভিদের গ্লুটামেট-লাইক রিসেপ্টর আদতে নিকটাত্মীয়। গ্লুটামেট হলো গ্লুটামিক অ্যাসিডের লবণ। অন্যদিকে গ্লুটামিক অ্যাসিড হলো এক প্রকার অ্যামাইনো অ্যাসিড। গ্লুটামিক অ্যাসিডের মতো এরকম আরও উনিশটি অ্যামাইনো অ্যাসিড পাশাপাশি পরস্পরের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে প্রোটিন তৈরি করে। সহজ কথায়, অ্যামাইনো অ্যাসিড আসলে প্রোটিনের গঠনগত একক।

এরকম একাধিক অ্যামাইনো অ্যাসিড নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে উন্নত মস্তিষ্ক-সম্পন্ন প্রাণীদের দেহে। যার মধ্যে গ্লুটামেট একটি। আর ঠিক এখানেই এসে এই তিন গবেষকের মাথায় খেলে যায় নতুন এক প্রশ্ন- তাহলে আয়নোট্রপিক গ্লুটামেট রিসেপ্টর এবং গাবা রিসেপ্টর প্রোটিন যে যে অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি, সেগুলোর মানুষ ও উদ্ভিদের দেহে কতটা সাদৃশ্য আছে? মানুষ ও উদ্ভিদের শরীরে এই দুই রিসেপ্টরে কীভাবেই বা এই অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলি সাজানো আছে?

এই তিন গবেষক দেখলেন, গবেষণায় দেখা গেল, মানুষ ও উদ্ভিদ, দুইয়ের ক্ষেত্রেই কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ প্রোটিন রয়েছে, যারা ব্যথার মতো অনুভূতিতে সাড়া দিতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, আগেও দেখা গিয়েছে প্রাণীদের শরীরে এই জাতীয় রিসেপ্টরকে ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যথার উপশম এবং অ্যানাস্থেশিয়া করা হয়। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে তা হয় কি না, তা যদিও এখনও গবেষণাসাপেক্ষ।

সৃষ্টির আদিকাল থেকে যে ব্যথা অপ্রকাশিত ছিল, যে কান্নার শব্দ নিহিত ছিল গহিন অরণ্যের ভেতর, তা বোধহয় মানবসভ্যতার এত বছর পরে কান পেতে শোনা গেল, বিজ্ঞানের হাত ধরে। এই তিন গবেষকের ধারণা, নতুন এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে উদ্ভিদের এবং প্রাণীর বিভিন্ন শারীরিক পদ্ধতি জানতে সাহায্য করবে, যা এতকাল আমাদের কাছে অধরা ছিল।

 

More Articles