নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করেও রেহাই! ১০০০ কোটির বন্ড কিনেছে কোন কোন ওষুধ কোম্পানি?

Pharmaceutical Firms Electoral Bond Donation: টরেন্ট ফার্মা ২০১৯ সালের মে মাস থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৭.৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে

কে ইলেক্টোরাল বন্ডে কত টাকা দিল নির্বাচন কমিশন ১৪ মার্চ সেই তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের ৩৫টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এর মধ্যে ৭ টি কোম্পানি যখন বন্ড কিনছে তখন এদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কীসের অভিযোগের তদন্ত? নিম্নমানের ওষুধ তৈরি এবং বিক্রির ভয়াবহ অভিযোগ! ফার্মাসিউটিক্যাল নির্মাতাদের নিয়ন্ত্রণ করে ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০। এই অ্যাক্টের ফলে ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন উত্পাদনের স্থান পরিদর্শনের পাশাপাশি বাজারে বিক্রি হওয়া ওষুধের গুণমান পরীক্ষা করতে পারে।

যে কোনও রাজ্যের ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যে কোনও সংস্থাকে নোটিশ পাঠাতে পারে যদি সেই সংস্থার ওষুধ গুণমানের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়। কিন্তু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যেমন উত্পাদন স্থগিত করা বা লাইসেন্স বাতিল করার মতো পদক্ষেপ কেবল সেই রাজ্য সরকারই নিতে পারে যেখানে কোম্পানির কারখানা অবস্থিত।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো যেভাবে বিশাল অঙ্কের রাজনৈতিক অনুদান দিচ্ছে এই বিষয়টি চিন্তার। কোনও সংস্থাই এত বিপুল টাকা গণতন্ত্রের সেবা, নির্বাচনের স্বচ্ছতা বা ভালোবেসে অন্তত রাজনৈতিক দলকে দান করে না। তা স্পষ্ট প্রমাণও করেছে সাতটি কোম্পানি। রাজ্যের ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যখন এই সংস্থাগুলিকে নোটিশ দিয়েছে সেই বছরই তারা বন্ড কিনে নিয়েছে৷

Hetero Labs এবং Hetero Healthcare ২০২২ সালের এপ্রিলে ৩৯ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল। এই সময়ের আগের ১০ মাস ধরে মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হায়দরাবাদের এই কোম্পানিকে নিম্নমানের ওষুধের জন্য ছয়টি নোটিশ জারি করেছিল।

আরও পড়ুন- গোমাংস রপ্তানিকারকদের থেকেও ইলেক্টোরাল বন্ডে কোটি কোটি টাকা! কে নিল?

এর মধ্যে অন্তত ৩ টি নোটিশ রেমডেসিভির সম্পর্কিত। রেমডেসিভির হচ্ছে একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ যা কোভিড ১৯-এর চিকিত্সার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। করোনা মহামারী চলাকালীন হেটেরোর ব্যবসা বেড়েছিল ব্যাপক। মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরীক্ষায় দেখা গেছে, রেমডেসিভির নমুনায় পরিষ্কার তরলের পরিবর্তে হলুদ রঙের তরল ছিল। এই সংক্রান্ত একটি নোটিশ ২০২১ সালের জুলাই মাসে Hetero-কে জারি করা হয়েছিল৷ দ্বিতীয় নমুনায় ওষুধের মাপ প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে কম ছিল এবং সেই বছরের অক্টোবরে একটি নোটিশ জারি করা হয়৷ রেমডেসিভিরের তৃতীয় নমুনায় দেখা যায়, ওষুধটির গুণমান খুবই খারাপ। তাই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আরেকটি নোটিশ জারি করা হয়েছিল।

মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন যুগ্ম ড্রাগস কমিশনার ওমপ্রকাশ সাধওয়ানি জানান, এই ধরনের অবস্থায় একটি কোম্পানির লাইসেন্স স্থগিত করাও যেতে পারে কিন্তু তেলঙ্গানার রেগুলেটর হেটেরোর বিরুদ্ধে কাজ করেনি। সংস্থাটি মহারাষ্ট্রের ওই নিম্নমানের ওষুধের ব্যাচটি তুলে নেয় মাত্র।

২০২১ সালে হেটেরোর আরও দু'টি নিম্নমানের পণ্য পাওয়া গেছে: একটি অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ ইটবর ক্যাপসুল এবং মনোসেফ যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়।

২০২২ সালে কেনা ৩৯ কোটি টাকার বন্ড ছাড়াও, এই সংস্থা ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ১০ কোটি টাকার বন্ড এবং ওই বছরই অক্টোবরে ১১ কোটি টাকার বন্ড কিনেছিল – মোট ৬০ কোটি টাকার বন্ড।

টরেন্ট ফার্মা ২০১৯ সালের মে মাস থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৭.৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। গুজরাতের এই কোম্পানির অ্যান্টিপ্লেটলেট ওষুধ ডিপ্লাট-১৫০ স্যালিসিলিক অ্যাসিড পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল এবং ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একে নিম্নমানের ঘোষণা করে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বারবার গুণমান-সম্পর্কিত এমন ব্যর্থতার জন্য সংস্থাকে সতর্কও করে। তবে গুজরাত সরকার ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে Torrent Pharma-র ওষুধ লোসার এইচ যা রক্তচাপ কমাতে ব্যবহৃত হয় সেটিকে গুজরাত ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিম্নমানের বলে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, এর আরেকটি ওষুধ নিকোরান এলভি যা হৃদরোগের চিকিত্সার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেটিও মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত লোপামাইড ওষুধটিও পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় এবং একে নিম্নমানের ঘোষণা করা হয়।

এই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ২০১৯ সালের মে এবং অক্টোবর মাসে ১২.৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ৭.৫০ কোটি টাকার বন্ড, ২০২২ সালের জানুয়ারি এবং অক্টোবরে ২৫ কোটি টাকা, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ৭ কোটি টাকা এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ২৫.৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে।

Zydus Healthcare ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৯ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। ২০২১ সালে বিহারের ওষুধ নিয়ন্ত্রক গুজরাতের এই কোম্পানির তৈরি রেমডেসিভির ওষুধের একটি ব্যাচকে নিম্নমানের ঘোষণা করে। ওই ওষুধের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া এন্ডোটক্সিনের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। অনেক রোগীর মধ্যে এই ওষুধের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বলেও জানা গেছিল। কিন্তু গুজরাতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক আরও পরীক্ষার জন্য এই ব্যাচগুলির নমুনা সংগ্রহ করেনি এবং জাইডাসের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপও করেনি।

আরও পড়ুন- ইলেক্টোরাল বন্ডে সবচেয়ে বেশি টাকা অনুদান! কে এই লক্ষ্মী মিত্তল?

Glenmark ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নিম্নমানের ওষুধের জন্য পাঁচটি নোটিশ পেয়েছিল৷ এর মধ্যে চারটি মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জারি করেছিল। গ্লেনমার্কের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ টেলমাকে নিম্নমানের হিসাবে চিহ্নিত রা হয়৷ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গ্লেনমার্ক ২০২২ সালের নভেম্বরে ৯.৭৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে।

Cipla ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তার ওষুধের জন্য চারটি শো-কজ নোটিশ পেয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে এটি ৩৯.২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে।

২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে সিপলার RC কাশির সিরাপের গুণমান খারাপ ধরা পড়ে। পরের বছর ১৪ কোটি টাকার বন্ড কেনে সিপলা। ২০২১ সালের জুলাই মাসে সিপলা রেমডেসিভির ওষুধ, সিপ্রেমির জন্য দু'বার নোটিশ পেয়েছে। হেটেরোর মতো, সিপ্রেমিতেও প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে কম রেমডেসিভির পাওয়া গেছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে ২৫.২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছিল সিপলা।

IPCA ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর অবধি ১৩.৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এর অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ লারিয়াগোতে প্রয়োজনীয় ক্লোরোকুইন ফসফেট নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম ছিল এবং ওষুধটিও নিম্নমানের বলে চিহ্নিত করা হয়।

Intas ফার্মাসিউটিক্যাল ২০২২ সালের অক্টোবরে ২০ কোটির বন্ড কিনেছিল। ২০২০ সালে এই কোম্পানির Enapril-5 ট্যাবলেট গুণমানের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, দেশের এই ফার্মাসিউটিক্যাল ক্ষেত্র বিভিন্ন দেশেই সমালোচনার মুখে পড়েছে। ভারতীয় কাশির সিরাপ এবং চোখের মলম ব্যবহার করে মৃত্যু এবং সংক্রমণের ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা সতর্কতা জারি করেছে তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ ব্যবস্থা নেয়নি। ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে টাকা দিচ্ছে তাতে এটি স্পষ্ট যে মানুষের জীবন নিয়ে উচ্চপর্যায়ে দেনা পাওনার খেলা চলছে মাত্র।

More Articles