কখনও পোশাক তো কখনও মুখ্যমন্ত্রীর পিতৃপরিচয়, ঘরেবাইরে যে ভাবে কোনঠাসা হলেন দিলীপ ঘোষ

Dilip Ghosh: সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কুকথা বলার পর ফের উস্কে উঠেছে দিলীপ ঘোষকে নিয়ে বিতর্ক। সে নিয়ে দলের সমর্থন তো মেলেইনি, বরং বিজেপির এই সিনিয়র নেতাকে শোকজও করেছে দল।

ঘরে-বাইরে সর্বোত্র যেন চাপে দিলীপ ঘোষ। একে তো হাতছাড়া হয়েছে মেদিনীপুরের আসন। তার উপর কুকথার জন্য এবার দলের শো-কজ এবং নির্বাচন কমিশনের নোটিসের খাঁড়া এলে ঝুলল বিজেপির এই সিনিয়র নেতার কাঁধে। লোকসভা ভোট সামনেই। এবার নিজের জায়গা ছেড়ে সোজা বর্ধমান-দুর্গাপুরের টিকিট দেওয়া হয়েছে দিলীপ ঘোষকে। অথচ মেদিনীপুরেই জন্ম, বেড়ে ওঠা তাঁর। ২০১৯ লোকসভা ভোটে মেদিনীপুর আসন থেকেই বিজেপির হয়ে জিতে ফিরেছিলেন তিনি। অথচ ২০২৪-এর ভোটে দিলীপে আস্থা রাখতে পারল না দল। সারাবছর ধরে মেদিনীপুরের সব কটি কেন্দ্রে নিয়মিত যাতায়াত, জনসংযোগ, কিন্তু ভোটের আগেই ভেস্তে গিয়েছে সেই হোমওয়ার্ক। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের গড় ছেড়ে দুর্গাপুরের মাটিতে কতটা সুবিধা করতে পারবেন দিলীপ, তা নিয়ে যথেষ্ট চাপ রয়েইছে তাঁর।

তার মধ্যে আলটপকা মন্তব্যের জন্য বরাবরই কোণঠাসা হয়েছেন দিলীপ। গত বার ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীকে কুকথা বলার জন্য চর্চায় ছিলেন দিলীপ ঘোষ। বাদ গেল না এবারেও। এবারও লোকসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীকে ফের কুকথা বলে বসেছেন তিনি। প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃপরিচয় নিয়ে। ভোটের মুখে সেই বক্তব্যই যেন ব্যাক ফায়ার করে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সর্বোপরী একজন মহিলার বিষয়ে এ ধরনের কুমন্তব্য করার জন্য নানা মহলে নিন্দিত হয়েছেন তিনি। এমনকী পাশে দাঁড়ায়নি দলও। চাপের মুখে বাধ্য হয়েই ক্ষমাপ্রার্থনা করেন দিলীপ। এমনকী নিজের দোষ কমাতে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রসঙ্গ তুলে নিজের দিকে ঝোল টানার চেষ্টাও করতে দেখা গিয়েছে বিজেপির এই সিনিয়র নেতাকে।

দিলীপ ঘোষের প্রতাপকে বরাবরই যেন একটু খাটো চোখে দেখে এসেছে বঙ্গবিজেপি। সেই ১৯৮৪ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হয়ে কাজ করে আসছেন তিনি। বিজেপির একনিষ্ঠ পার্টিকর্মী হিসেবেও সুনাম রয়েছে তার। বারবার বিজেপির জন্য জয়ও ছিনিয়ে এনেছেন দিলীপ। তবে বালাই ওই মুখ। অমূলক কথাবার্তা বলে বারংবারই বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি অতীতেও। বিজেপির রাজ্যসভাপতি পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে সুকান্ত মজুমদারকে সেই পদে আনার পর থেকেই দলে একটু হলেও যেন গুরুত্ব কমেছে দিলীপের। তবে সে দিকে পরোয়া না করেই দলের হয়ে কাজ করে গিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন: ‘ভূমিপুত্রে’ আস্থা নেই? মেদিনীপুর থেকে কেন দিলীপ ঘোষকে প্রার্থী করল না বিজেপি?

সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কুকথা বলার পর ফের উস্কে উঠেছে দিলীপ ঘোষকে নিয়ে বিতর্ক। সে নিয়ে দলের সমর্থন তো মেলেইনি, বরং বিজেপির এই সিনিয়র নেতাকে শোকজও করেছে দল। কিছুদিন আগেই দুর্গাপুরের রাজীব গান্ধী স্মারক ময়দানের চা-পে চর্চার মাধ্যমে জনসংযোগ করেন দিলীপ। এরপর সাংবাদিকের সামনে আক্রমণ করে বসেনন মুখ্য়মন্ত্রীকে। বলেন, ' মুখ্যমন্ত্রী গোয়ায় বলেন গোয়ার মেয়ে, ত্রিপুরায় বলেন ত্রিপুরার মেয়ে, আগে বাপ ঠিক করুন! যার তার মেয়ে হওয়া ঠিক নয়'। আর দিলীপের সেই বক্তব্য নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তৃণমূল। দিলীপকে পাল্টা নিশানা করেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। এমনকী নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগে নির্বাচন কমিশনে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও জানায় ঘাসফুল শিবির। তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী বলেন, 'বিজেপি যে মানসিকতায় বিশ্বাস করেন, দিলীপবাবু সেই মানসিকতার প্রতিফল ঘটিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য়কে ধিক্কা জানানোর ভাষা নেই'। ইতিমধ্যেই তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় ইলেকশন কমিশন। আর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে দিলীপবাবুকে নোটিসও পাঠিয়েছে ইলেকশন কমিশন। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে প্রবীণ এই বিজেপি নেতার কাছ থেকে। 

একুশের ভোটের আগে জখম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। মুখ্যমন্ত্রী বারমুডা পরারও পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। সে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তবে সে বার এই সবের মধ্যে দল নিজেকে জড়ায়নি দল। নিশ্চুপ ছিল রাজ্যবিজেপি। তবে এবার আর ঝুঁকি নেয়নি তারা। ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে সিএএ, নানা বিষয় নিয়ে এমনিতেই এ রাজ্যে চাপে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে দিলীপ ঘোষের আলটপকা কথার দায় না নিয়ে সোজা নেতাকেই শোকজ করেছে দল। সেই নির্দেশ এসেছে খোদ জে পি নড্ডার কাছ থেকে।

একে তো দুর্গাপুর তার হোমগ্রাউন্ড নয়। ফলে সেখানে দিলীপের তেমন গ্রহণযোগ্যতা থাকার সুযোগও কম। এরই মধ্যে প্রচারে বেরিয়ে বর্ধমানে ক্ষোভের মুখে পড়তে হল বিজেপি নেতাকে। জানা গিয়েছে, বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির, নীলপুর, বাদামতলা হয়ে বর্ধমানের ছ’নম্বর ওয়ার্ডে রেল আমবাগানে দোল উৎসবে যোগ দিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি। সেখানেই দুর্গামণ্ডপে বসেছিলেন তৃণমূল নেতা শিবশঙ্কর ঘোষ-সহ কয়েক জন। তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন দিলীপ। তবে কথা এগোতে না এগোতেই উঠে পড়ে সেই কুকথার প্রসঙ্গ। এমনকী তৃণমূল কর্মীসদস্যদের থেকে 'গো ব্যাক', 'দূর হঠো' স্লোগানও শুনতে হয় তাঁকে।

BJP Issues Show-Cause Notice To MP Dilip Ghosh Over His Remarks On West Bengal CM Mamata Banerjee

 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ দিন বর্ধমানে কথোপকথনের মাঝে ওই তৃণমূল নেতা দিলীপকে বলেন, “মেদিনীপুর তো আপনার সাজানো বাগান। আপনি চষে এলেন, আর একজন চাষ করবে!” জবাবে দিলীপ হাসতে হাসতে বলেন, “বর্ধমান-মেদিনীপুর তো চাষের জায়গা। আমরা চাষা, আপনারাও চাষা। আমাদের কাজই হল আশায় বাঁচা।” আচমকা এক বিজেপি কর্মী বলে ওঠেন, “দাদা চলে এসেছে, তৃণমূল কাঁপছে।” এর পরেই উত্তেজনা শুরু হয়। শিবশঙ্করের নেতৃত্বে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল। আওয়াজ ওঠে, ‘দিলীপ ঘোষ গো ব্যাক’, ‘দিলীপ ঘোষ দূর হটো’। খবর পেয়ে বর্ধমান থানার পুলিশ, র‍্যাফ গিয়ে দু’পক্ষকে সরিয়ে দেয়। বছর চারেক আগে একই রকম ভাবে মন্তেশ্বরের ভাগরা বাজার এলাকায় এসে 'গো ব্যাক' স্লোগান শুনতে হয়েছিল তাঁকে। তখন অবশ্য তিনি দলের রাজ্যসভাপতি। আর ২০২৪ সালে সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হল যেন।

দলের পাশে না থাকা, শো-কজ নোটিস, তৃণমূলের নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানানো, সব চেয়ে বড় কথা, সামনেই লোকসভা ভোট। ফলে দেরি না করে কুকথার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন দিলীপ ঘোষ। তড়িঘড়ি নিজের মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন মেদিনীপুরের বিদায়ী সংসদ। বুধবার প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে সাংবাদিকদের দিলীপ জানান, "আমার বক্তব্য নিয়ে বির্তক প্রথম বার নয়। যে ভনিতা করে, অন্যায় করে তার সামনে বলি। এবার আমি যা বক্তব্য রেখেছি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যার সমন্ধে আমার ব্যক্তিগত ঝগড়া নেই, কোনও ক্লেশ নেই। কোন দুর্ভাবনা নেই। কিন্তু উনি যে রাজনৈতিক বক্তব্য বার বার দিয়েছেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন, আমি তার বিরুদ্ধে বলেছি এবং প্রশ্ন করেছি, প্রতিবাদ করেছি। আমার ভাষার শব্দ চয়ন নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে, আমার পার্টিরও আপত্তি আছে, অন্যরাও বলেছে। যদি তাই হয় তাহলে আমি দুঃখিত।" তবে ভাঙলেও মচকাবেন না দিলীপ ঘোষ। সঙ্গে সঙ্গেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলা কার্ড খেলার চেষ্টা করে চলেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। একই সঙ্গে রাজ্যের রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে আক্রমণের প্রসঙ্গ তুলে  দিলীপ ঘোষ প্রশ্ন ছুড়েছেন, “কিন্তু আমার প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীরই পার্টির এক নেতা, তাঁরই পরিবারের এক নেতা কাঁথিতে দাঁড়িয়ে আমার দলের বিধায়কের  বাবার নামে এর চেয়েও খারাপ ভাষা প্রয়োগ করেছেন। গালাগাল দিয়েছেন। যিনি একজন বরিষ্ঠ নেতা। তাঁর তাঁর কোনও মানসম্মান নেই? যাঁদের সুবিধা এরা নিয়েছে তাঁকে নিয়ে যা নয় তাই বলছে। তাঁদের কোনও মান-সম্মান নেই? তখন কেন তাঁদের দলের পক্ষ থেকে কোনও কোনও স্টেটমেন্ট দেওয়া হয় না?” দিলীপ এও বলেছেন, “আমি রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছি। শুভেন্দু অধিকারী পুরুষ বলে তাঁর সন্মান নেই? কেন মহিলা বলে তাঁর সম্মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? দলকে চিঠির অফিসিয়াল উত্তর আমি দেব।”

আরও পড়ুন:সন্দেশখালির ‘নির্যাতিতা’, অনভিজ্ঞ রেখা পাত্রই কেন মোদির বাজি বসিরহাটে?

তবে মুখে যা-ই বলুন না কেন দিলীপ, ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই রীতিমতো কোণঠাসা এই মুহূর্তে দিলীপ। একে তো লোকসভা ভোটে বর্ধমান-দুর্গাপুর শিবিরে তিনি কতটা দাঁত ফোটাতে পারেবন, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ। প্রার্থী হয়ে বর্ধমানে পা রেখেই তৃণমূল প্রার্থী কীর্তি সম্পর্কে বিজেপির প্রার্থী দিলীপ প্রশ্ন তুলেছিলেন, "উনি বাংলা জানেন?" দিলীপকে বহিরাগত বলে পাল্টা দেন কীর্তিও। বর্ধমান-দুর্গাপুর যে দিলীপের জায়গা নয়, তা গোড়াতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার তথা তৃণমূলপ্রার্থী। সে কথা যে খুব ভুল বলেননি কীর্তি, তা দিলীপ নিজেও জানেন। যদিও গোড়া থেকেই নিজেকে আত্মবিশ্বাসী দেখানোর প্রাণপন চেষ্টা করে গিয়েছেন তিনি। বলেছেন, 'গোটা বাংলাই তাঁর এলাকা', তিনি যেখানে যাবেন সেখানেই নাকি জিতবেন। তবে চাপ যে আছে, তা বোধহয় ভালোই টের পাচ্ছেন বিজেপি নেতা। তার উপর কুকথার জন্য দিলীপের উপর ক্ষুব্ধ খোদ জেপি নড্ডা। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এ ধরনের বক্তব্য বিজেপির পরম্পরার বিরোধী। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দিলীপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারে বিজেপি। শীর্ষনেতৃত্ব যে দিলীপের উপর তেমন খুশি নন, তা তো প্রার্থীতালিকা দেখেই খানিকটা বুঝতে পারা যায়। তবে এবার সেই বিরূপতা বোধহয় বাড়ল আরওই। খোদ নড্ডা রেগে গিয়েছেন দিলীপের এই কাণ্ডে। তার উপর আবার বর্ধমান-দুর্গাপুরে ঠিক মতো আসর জমাতে পারছেন না বিজেপির এই বঙ্গনেতা। বারবার কোনও না কোনও ঘটনা, প্রতিরোধের মুখে পড়ে যাচ্ছেন বিজেপির এই একনিষ্ঠ নেতা। এবার তার প্রভাব ঠিক কতটা পড়তে চলেছে ২০২৪ নির্বাচনে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। প্রতিবারের মতো নিজের জয়ের ইতিহাস কি এ বারও ধরে রাখতে পারবেন দিলীপ, সেটাই দেখার।

More Articles