‘ব্রিফকেস’ অথবা ‘বহিখাতা’ পেরিয়ে অতঃপর ট্যাবলেট, যেভাবে ‘ডিজিটাল’ হয়ে উঠল ভারতীয় বাজেট
Budget 2023 : ডিজিটাল দুনিয়ার তালে তাল মিলিয়ে ভারতীয় বাজেটেও এখন ইলেকট্রনিক্সই দস্তুর। ভারতীয় বাজেটের সব নথি এখন থাকছে একটি ট্যাবলেটে
ব্রিফকেসের ছুটি হয়েছে আগেই, এমনকী লাল বহিখাতার ব্যবহারও বছর দুই হল অতীত, ডিজিটাল দুনিয়ার তালে তাল মিলিয়ে ভারতীয় বাজেটেও এখন ইলেকট্রনিক্সই দস্তুর। ভারতীয় বাজেটের সব নথি এখন থাকছে একটি ট্যাবলেটে। আধুনিকতা এসেছে ঠিকই তবে বাইরের মোড়কে বজায় আছে অতীতের অস্তিত্ব। লাল বহিখাতার ছুটি হয়েছে, তবে আধুনিক ট্যাবলেটটিও মুড়ে আনা হয় লাল শালুতে। জানা গিয়েছে, সেই শালু আবার সিদ্ধি বিনায়ক এবং মহালক্ষ্মী মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছেন খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। এ যেন ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই কেন্দ্র সরকারের আধ্যাত্মিক তোষণের নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া। অতীতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়াস বললেও ভুল হয় না।
ঔপনিবেশিক ভারত থেকে স্বাধীন ভারত হয়ে আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায়, এই যে এতদিনের পথ চলা তাতে পরিবর্তন এসেছে অনেক। ভারতীয় বাজেটেও সেই বদলের ধারা চুঁইয়ে পড়েছে। এই বাজেট পেশের পরম্পরা চালু হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। সে সময় ব্রিফকেস বন্দী বাজেটের নথি নিয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করতেন ব্রিটিশ সরকার। ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ঔপনিবেশিক ভারতে প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন। তাঁর হাতে ছিল একটি গ্ল্যাডস্টোন বক্স। সাহেবরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও এদেশে সাহেবদের লেজ ধরে থাকার অভ্যাস চিরন্তন। তার ব্যতিক্রম নয় বাজেট পেশের নিয়মও। ইংরেজদের হাত ধরে ব্রিফকেস সঙ্গে করে বাজেট পেশের রীতি ঢুকে পড়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে।
আরও পড়ুন - বিরাট ঘোষণা নির্মলার! এবার থেকে আর কোনও আয়কর দিতে হবে না মধ্যবিত্তদের!
ঔপনিবেশিক ভারত হয়ে স্বাধীন ভারত, রীতিতে বদল আসেনি। ১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের প্রথম কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আর.কে. শনমুখম চেট্টি৷ তাঁর হাতে তখন ছিল চামড়ার পোর্টফোলিও ব্যাগ। এরপর ইন্দিরা গান্ধির আমল থেকে মোদি আমলের অরুণ জেটলি পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল সেই ধারা। অতঃপর নির্মলা সীতারমন-এর হতে এসে বদল এল সেই ধারায়। ২০১৯ সালের বাজেটে প্রথম মুক্তি পড়ল ব্রিফকেস প্রথা। সেই জায়গায় এল লাল রঙের বহিখাতা।
প্রথমদিকে ছবি অথবা মিডিয়ার চল না থাকলেও আজকের দিনে যেকোনও বিষয় ছবি তোলাই দস্তুর। ২০১৯ সালে প্রথমবার এই দায়িত্ব হতে পেয়ে ছবি তোলার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ব্রিফকেসের বদলে ক্যামেরার সামনে তুলে ধরলেন বহিখাতা। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা ব্যবসার হিসেব নিকেশ করার খেরোর খাতার মতোই। যদিও এ হিসেব কোনও মামুলি হিসেব নয়, এর মধ্যেই রয়েছে একটা গোটা দেশের আগামী এক বছরের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত। এর আগে যখন ব্রিফকেস ব্যবহার করা হতো তখন তার অবয়বে বিশেষ বদল হয়নি কোনও দিনই, তবে রঙে বদল হয়েছে। কখনও লাল, কখনও কালো, কখনও আবার খয়েরী রঙের ব্রিফকেস ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
যাই হোক, আসা যাক লাল বহিখাতায়। লাল রঙের শালুতে মোড়া একটি হিসেবের খাতা। ওপরে একটি অশোক স্তম্ভের ছাপ। এখানেই শেষ নয়, ব্যবসার ধর্মীয় রীতি মেনে তার ওপর আঁকা হতো স্বস্তিক চিহ্ন। ১ টাকার কয়েনে লাল সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়া হতো অশোক স্তম্ভের ছাপ। সেই ঐতিহ্যকেই যেন সরকারি সীলমোহর দিলেন নির্মলা। লাল শালুতে মুড়ে ২০১৯ সালে প্রথম বাজেটের নথি আনলেন তিনি। হঠাৎ করে এতদিনের ব্রিফকেস বদলে ফেলে নয়া ধারা আনা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনকে। যদিও তিনি আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন এই পরিস্থিতির জন্য। এই বদলের পিছনে তিনি যে কারণটা দেখিয়েছিলেন তা হল, “২০১৯ সালে বাজেটের জন্য স্যুটকেস আনিনি। আমরা স্যুটকেস বহনকারী সরকার নই। একটি স্যুটকেস অন্য কিছুকেও বোঝায়, 'স্যুটকেস নেওয়া, স্যুটকেস দেওয়া। মোদীজির সরকার স্যুটকেস সরকার না।” সূক্ষ হলেও একটা গভীর রাজনৈতিক খোঁচা ছিল এর মধ্যে।
আরও পড়ুন - ভারতীয় বাজেটে কেন ব্যবহার করা হতো লাল বহিখাতা?
মোট কথা পরিবর্তিত হল এতদিনের প্রথায়। যদিও সেই খাতাও বেশিদিন জায়গা বজায় রাখতে পারল না। বছর দুই পরেই ছুটি হল বহিখাতার। বর্তমান অর্থমন্ত্রী অবশ্য বারবার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েই এগিয়ে নিয়ে গেছেন বাজেট পেশের প্রথাকে। সেই ধারাতেই এসেছে আজকের ট্যাবলেট। প্রযুক্তির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ডিজিটাল দুনিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ভারতীয় অর্থনীতি। তাই সেই ছাপ বজায় রাখতে বাজেট পেশ করা হয় ট্যাবলেটে। যদিও তার সঙ্গে রয়েছে অতীতের মেলবন্ধন। ট্যাবলেটটি লাল শালুতে মুড়ে আনা হয়। তাছাড়া পেপারলেস যুগে দাঁড়িয়ে এই অজস্র নথির আলাদা আলাদা কাগজের ব্যবহারকে বাদ দিতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। ট্যাবলেটে আঙুলের ডগায় সেভ করে রাখা যায় সমস্ত হিসেব। তার ওপর করোনা পরবর্তী নিউ নর্মাল, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সে বার লোকসভায় ২০২১ সালে প্রথম ট্যাবলেট থেকে বাজেট পেশ করেন নির্মলা।
এখানেই শেষ নয়, ট্যাবলেট আনার পাশাপাশি ‘ইউনিয়ন বাজেট মোবাইল অ্যাপ’ চালু হয়েছিল সেই বারই। যাতে মন্ত্রী সাংসদদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও বাজেটের যাবতীয় নথি এক ক্লিকেই পেয়ে যেতেন ঘরে বসেই, সেই ভাবনা মাথায় রেখেই এই প্রয়াস। যদিও অনেকেই এই ডিজিটাল নথির পরিবর্তে কাগজের নথির দাবি তুলেছিলেন অনেকেই কিন্তু ডিজিটাল দুনিয়ায় সবসময় নিজেকে এগিয়ে রাখা মোদি সরকার অবশ্য ভ্রুক্ষেপ করেনি এতে। এমনকী বাজেটের আগে ‘বিজনেস অ্যাডভাইসরি কমিটি’-র বৈঠকেও প্রতিলিপির ‘হার্ড কপি’ সাংসদদের সরবরাহ করার দাবি উঠলে তা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্লোগানই যে মোদি সরকারের জন্য দস্তুর। তাই ব্রিফকেস কিংবা বহিখাতার পরিবর্তে ট্যাবলেটে বাজেট পেশ প্রকৃত অর্থেই ‘ডিজিটাল’। আবার সময়োপযোগীও বটে।