গণ অভ্যুত্থানের গর্ভে আছে দুর্নীতি আর কর্মহীনতা নিয়ে ক্ষোভ
Bangladesh Quota Protest: প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার থাকে, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে চালিকাশক্তিগুলোকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তার নীচেও লুকিয়ে রয়েছে অনন্ত দুর্নীতি, চূড়ান্ত শ্রমিকশোষণ আর অব্যবস্থার ছবি।
ব্রুকলিনে নিজের পড়ার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন ষাটোর্ধ্ব এক প্রবাসী বাঙালি। টিভির পর্দায় চোখ রাখতেই ফুটে ওঠে শরণার্থীদের মুখ। দক্ষিণ ইউরোপের বিপদসঙ্কুল সমুদ্র এবং পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বিপদসঙ্কুল জঙ্গল উপত্যকা বেয়ে এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য কিংবা আফ্রিকা থেকে উঠে আসছে যুদ্ধ-খরা, মন্বন্তরক্লিষ্ট শরণার্থীদের ভিড়। যা দেখতে দেখতে খানিক খটকাতেই পড়ে যান ভদ্রলোক। যে মুখগুলোকে তিনি টিভির পর্দায় দেখছেন, সেই শরণার্থীদের অনেককেই ঠিক মধ্যপ্রাচ্যের বা আফ্রিকান বলে মনে হচ্ছে না। আরও একটু ভালো করে দেখতেই, আস্তে আস্তে তিনি বোঝেন, এই শরণার্থীদের অনেকেই আসলে দেখতে তাঁর দেশীয় বন্ধুবান্ধব বা তাঁদের স্বজন-পরিজনদের মতো। এই ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোকের নাম ধরা যাক অমিতাভ ঘোষ। আর এই দৃশ্যটি তাঁর 'The Nutmeg's Curse' বইয়ের একটি অংশ।
অমিতাভ ঘোষ যে দৃশ্যটি টিভিতে দেখে চমকে উঠেছিলেন, হাজার হাজার শরণার্থীদের ভিড়ে যেভাবে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের বাংলাদেশি ভাই-বোনেদের, সেই খবর পড়ে চমকে উঠি আমিও। কিন্তু আর একটু খোঁজ করলেই জানা যায়, গত বেশ কিছু বছর ধরে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় যে দেশ থেকে মানুষ কাগজহীন হয়ে বেআইনি শরণার্থী বা নাগরিক হিসেবে ঠাঁই পাওয়ার চেষ্টা করেছে, তাঁরা বাংলাদেশের মানুষ। ২০২১ সালে এই সংখ্যাটা ছিল সাড়ে ৪ লক্ষের কাছাকাছি। পরবর্তী বছরগুলোয় আরও বেড়েছে সেই সংখ্যাটা। শাহরুখ খানের 'ডানকি' ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো সেই ছবির সঙ্গে এই দৃশ্যের মিল খুঁজে পাবেন। আসলে 'ডানকি' বা এই বাংলাদেশি 'ডানকি' ভারত-বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থারই প্রতিফলন। বর্তমানে বাংলাদেশের ছাত্র-যুব এবং আপামর জনসাধারণের যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বা আন্দোলন আমরা দেখছি, তার পুরোটাই জড়িয়ে এই অর্থনীতির সঙ্গে। উপমহাদেশের মধ্যে জিডিপি-র ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সবথেকে এগিয়ে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির তিন-চারটি বিশেষ দিক রয়েছে। কী সেগুলো? গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের পরিকাঠামোর বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে। রাস্তা থেকে শুরু করে সেতু, বিমানবন্দর, বন্দর ইত্যাদিতে অভাবনীয় ভাবে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। এই পরিকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দেখেছি একটা বড় অংশের ভারী শিল্প সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত বস্ত্রশিল্প, যেখানে বিশাল বিনিয়োগ এবং উৎপাদন চোখে পড়েছে। সারা পৃথিবী থেকে ফার্স্ট ফ্যাশনের যে ব্র্যান্ডগুলি, তাদের মুনাফা তৈরির নতুন নতুন পথ বা পদ্ধতি সামনে এসেছে।
আরও পড়ুন: অগণিত মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস! শাসক-বিরোধী সংঘর্ষে কতটা ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে?
আর একটা ব্যাপার যেটা ভেবে দেখার মতো, তা হল বাংলাদেশে একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষিত অথচ বেকার এই শ্রেণির ছাত্র-যুবকের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমাজে। সরকারি হিসেব বলছে, প্রতিবছর অন্তত ৩ থেকে ৫ লক্ষ যুবক-যুবতী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। অথচ কর্মসংস্থানের সুযোগ তাঁদের সামনে নেই। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, তা হল অর্থনৈতিক বৈষম্যের এক করুণ চালচিত্র। আর সেই বৈষম্যের একদিকে যেমন রয়েছে বড় বড় শিল্পপতি-পুঁজিপতিরা, তেমনই রয়েছে বর্তমান সরকার এবং সরকার প্রোষিত আমলাদের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি থেকে সঞ্চিত অর্থের বিপুল ভাণ্ডার। বর্তমানে সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে ছাত্রযুব সমাজের ক্ষোভের বিস্ফোরণ আমরা দেখেছি। কিন্তু সমস্যা এতটা সরল বা একমুখী কোনওটাই নয়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদে জন্য সংরক্ষিত ছিল এতদিন ৩০ শতাংশ। সামাজিক শ্রেণির ভিত্তিতে সংরক্ষিত ছিল আরও ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি চাকরির প্রায় ৫৬ শতাংশ আসনের উপর কোনও অধিকার ছিল না সাধারণ মেধাবী যুব সম্প্রদায়ের। সরকার বলছে ৫ লক্ষ চাকরি তাঁরা দিতে প্রস্তুত, অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে পদখালি রয়েছে মাত্র ৫ লক্ষ। যদি সেই হিসেবে নিয়োগ হয়, সেক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবমা মাত্র দেড় লক্ষ যুবকযুবতীর। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে চাকরি করতে সক্ষম এবং যথাযথ ভাবে প্রশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা কম করে হলেও কয়েক কোটি।
দেশের জিডিপি উর্ধ্বমুখী হলে কী হবে, বাংলাদেশে খুব দ্রুত গতিতে বেড়ে চলা মুদ্রাস্ফিতি কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই একটা উদ্বেগের কারণ। গত সাত-আট বছরে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফিতির পরিমাণ প্রায় ৮-১০ শতাংশের কাছাকাছি। যার ফলে বাজার আগুন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে ঠেকছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিত্য়প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা বা ব্যবহারের পরিস্থিতি ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে।
'সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা' বাংলাদেশ কৃষিনির্ভরতা কাটিয়ে বর্তমানে হয়ে উঠেছে শিল্পনির্ভর। মূলত গারমেন্ট ব্যবসার দিক থেকে বাংলাদেশের যে সুদিনের কথা আমরা বইয়ের পাতায় পড়ি বা সে দেশের সরকার অহরহ তুলে ধরার চেষ্টা করে, কিংবা ধরুন মহম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাঙ্কের যে সাফল্যের খতিয়ান দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা চলে, তার অনেকটাই হয়তো বিজ্ঞাপন এবং প্রচারমাধ্যমের ভাঁওতা। প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার থাকে, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে চালিকাশক্তিগুলোকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তার নীচেও লুকিয়ে রয়েছে অনন্ত দুর্নীতি, চূড়ান্ত শ্রমিকশোষণ আর অব্যবস্থার ছবি। আমরা তো দেখেছি কীভাবে শ্রমিক নিরাপত্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যান খেটে খাওয়া মানুষেরা, আচমকা ধ্বসে পড়ে কারখানা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে প্রদীপের তলাতেই যে শুধু অন্ধকার, তা নয়। সেই প্রদীপের চারপাশ জুড়েও ঘোর অন্ধকার ঘাপটি মেরে রয়েছে।
সারা পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলির মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। উদার অর্থনীতির প্রেক্ষিতে জনবহুল যে কোনও দেশেই সরকারের পক্ষ থেকে যদি অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে মানবিক সম্পদকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে ভারত বা বাংলাদেশের মতো দেশ কিংবা পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে অর্থনীতির যে অবক্ষয় আমরা দেখে চলেছি, সেই ধারাই অব্যাহত থাকবে। যেখানে ফুলে ফেঁপে উঠবেন পুঁজিপতি ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলারা, আর দেশের সাধারণ মানুষ, শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কর্মহীনতা বা বেকারত্বসমস্যার কোনও সুরাহা বা সমাধানের পথ দেখা যাবে না দূরদূরান্ত পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: স্বৈরাচারী এরশাদকেও গদি ছাড়তে হয়! বাংলাদেশে গণআন্দোলন কি আর সেই ক্ষমতা রাখে?
বাংলাদেশের সরকারের অনৈতিক দমনপীড়ন ইত্য়াদির রাজনৈতিক প্রেক্ষিত যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, এই দুর্নীতি এবং কর্মহীনতাও আসলে এই গণআন্দোলনের অন্যতম একটি কারণ। তবে যে বিষয়টা সবথেকে ভয়ের, তা হল— সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুসারে দেশে সংরক্ষণ কমানো হলেও, সরকার নতজানু হয়ে বিক্ষোভকারীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেও, এমনকী পুলিশ-আমলা যাঁরা নিরীহ ছাত্র-যুবকদের ঢাকা-রাজশাহীর রাস্তায় খুন করল, তাদের বিচার হলেও, দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ কোটি বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের কোনও সুরাহা দেখা গেল না। আর সেখানেই বোধহয় লুকিয়ে থাকবে পরবর্তী আন্দোলনের বীজ। আন্দোলন-প্রতিআন্দোলন, সরকারের উৎপীড়ন, পুঁজিপতির ধন একত্রিকরণ, সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এ এক মাৎস্যন্য়ায়ের সময়। শুধু বাংলাদেশ নয়, ২০২৪ পরবর্তী উপমহাদেশের রাজনীতির সম্ভবত এটাই ভবিষ্যৎ।