কল্যাণকে হারিয়ে শ্রীরামপুরের মুশকিল আসান হয়ে উঠবেন দীপ্সিতা?
Kalyan Banerjee vs Dipsita Dhar: ভোটপ্রচারের সময় দীপ্সিতাকে 'মিস ইউনিভার্স' বলে খোঁচা দিয়েছেন কল্যাণ। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও 'মিস্টার ইন্ডিয়া' বলেছেন দীপ্সিতা কারণ নিজের লোকসভা কেন্দ্রে সময়ই দেন না সাংসদ।
বহু মানুষের কাছেই তাঁর ব্যক্তি 'ইমেজ' খুব সুন্দর নয়, অনেকেই তীব্র অপছন্দ করেন। তবু, মানুষের ভোটেই ২০০৯ সাল থেকে শ্রীরামপুর আসন নিজের দখলে রেখেছেন তৃণমূলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি 'কুকথায় পঞ্চমুখ' বলেন অনেকেই। শালীনতার গণ্ডি তিনি ছাড়িয়ে যান হামেশাই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে দীপ্সিতা ধর, তাঁর আক্রমণের তালিকা থেকে বাদ যান না কেউই। সেই কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এবার লড়ছেন বামেদের তরুণ নেত্রী দীপ্সিতা। ভোটপ্রচারের সময় দীপ্সিতাকে 'মিস ইউনিভার্স' বলে খোঁচা দিয়েছেন কল্যাণ। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও 'মিস্টার ইন্ডিয়া' বলেছেন দীপ্সিতা কারণ নিজের লোকসভা কেন্দ্রে সময়ই দেন না সাংসদ। তবে অস্বীকার করা যায় না, এই কেন্দ্রে লড়াই তৃণমূল বনাম বিজেপির নয়। এখানে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কঠিন লড়াই দিতে চলেছেন দীপ্সিতা।
২০০৯ থেকে শ্রীরামপুর আসনে জিতছেন কল্যাণ। ২০০৯ সালে তিনি পান ৬,৩৭,৭০৭ ভোট। মোট ভোটের ৪৫.৫০% পান তিনি। তাঁর কাছে হারেন বিজেপির দেবজিত সরকার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কল্যাণ পান ৫,১৪,৯৩৩ টি ভোট, ৩৯.৯০%। সেবার দ্বিতীয় হয়েছিলেন বামপ্রার্থী তীর্থঙ্কর রায়। ২০০৯ সালেও বামপ্রার্থী শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে ৫৩.৪৮%ভোট পেয়ে জেতেন কল্যাণ।
জগৎবল্লভপুর, ডোমজুড়, উত্তরপাড়া, শ্রীরামপুর, চাঁপদানি, চণ্ডিতলা আর জঙ্গিপাড়া বিধানসভা নিয়ে তৈরি শ্রীরামপুর আসন। শ্রীরামপুরে বরাবর কখনও কংগ্রেস কখনও কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীই জয়ী হয়েছে। ১৯৫১ থেকে শুরু হওয়া নির্বাচনে এখনও অবধি বামেরা শ্রীরামপুর জিতেছে ৬ বার। কংগ্রেস ৪ বার আর তৃণমূলও ৪ বার। কখনই বিজেপি এই আসনে খাতা খুলতে পারেনি। সমস্ত বিধানসভা আসনই রয়েছে তৃণমূলের দখলে। বামেদের এককালীন গড় শ্রীরামপুরে বিজেপির হয়ে লড়ছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরই প্রাক্তন জামাই কবীরশঙ্কর বসু।
২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বালি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের ড. রানা চট্টোপাধ্যায় এবং ভারতীয় জনতা পার্টির বৈশালী ডালমিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দীপ্সিতা ধর। বারেবারেই আম্বেদকরের আদর্শকে প্রচারের অংশ করেছেন এই তরুণ বামনেত্রী। বলেছেন, হিন্দু, মুসলমানরা সবাই খিদের জায়গায় একই অবস্থানে আছে। বাবাসাহেব আম্বেদকর সংবিধান রচনার সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন শিক্ষা সমস্ত মানুষের বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। এবারও হকের লড়াইকেই সামনে রেখেছেন দীপ্সিতা। বলেছেন যুব সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানের কথা। দীপ্সিতা সেই নির্বাচনে হেরে গেলেও লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। তৃতীয় হয়েছিলেন তিনি। ১৭ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেয়েছিলেন। এবার লড়াই আরও কঠিন।
এককালে জুটশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এই অঞ্চল। বর্তমানে জুটমিলগুলির ভগ্নপ্রায় অবস্থা। জুটমিলের শ্রমিকদের লড়াই বামেদের এই অঞ্চলে নিজেদের লড়াই জারি রাখতে সাহায্য করেছিল। ১৯৫২ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিআই-এর পক্ষ থেকে তুষারকান্তি চট্টোপাধ্যায় জয়ী হন এই কেন্দ্রে। ১৯৫৭ সালে জেতেন জাতীয় কংগ্রেসের জিতেন্দ্রনাথ লাহিড়ি। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে বিমলকান্তি ঘোষ জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়ী হন। ১৯৭১ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এই কেন্দ্রে জয়ী হন। বিমলকান্তি ঘোষ সাংসদ ফের নির্বাচিত হন ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালে। তারপর সিপিআইএমের সুদর্শন রায় চৌধুরী এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। বাম জমানাতেও ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে আকবর আলি খন্দকার, প্রদীপ ভট্টাচার্য তৃণমূল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেস পক্ষ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএমের প্রার্থী শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায় জেতেন। তারপর ২০০৯ সাল থেকে তৃণমূলের দখলে শ্রীরামপুর।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জগৎবল্লভপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সীতানাথ ঘোষ জেতেন। ডোমজুড় বিধানসভা কেন্দ্রে কল্যাণ ঘোষ তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে জেতেন। উত্তরপাড়ায় কাঞ্চন মল্লিক এবং শ্রীরামপুরে ডঃ সুদীপ্ত রায় জেতেন তৃণমূলের হয়ে। চণ্ডীতলা কেন্দ্রে প্রয়াত তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আকবর আলি খন্দকারের স্ত্রী স্বাতী খন্দকার জেতেন। সমস্ত আসনই শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস নিজের হাতে রাখে৷
তৃণমূলের এই দুর্গে ফাটল ধরাতে পারবেন দীপ্সিতা? তিনবারের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ইমেজ' নিজে জনমানসে তো বটেই, স্থানীয় রাজনৈতিক স্তরেও অসন্তোষ রয়েছে। সম্প্রতি প্রচারে গিয়ে নিজেরই দলের বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিককে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন কল্যাণ। বিষয়টি ভালো চোখে নেয়নি তৃণমূলেরই অনেকে। অন্যদিকে প্রচারে জান লড়িয়ে দিয়েছেন দীপ্সিতা। খুব ভালো সাড়া পেয়েছেন। লতুন মুখের উপর আস্থা রাখছেন প্রবীণ মানুষরাও। কর্মসংস্থান, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বলছেন দীপ্সিতা। বলছেন এলাকার বাস্তব সমস্যাগুলির কথা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, বামেদের ভোট এবার দীপ্সিতার হাত ধরে কিছুটা ফিরতে পারে আবার। হাওয়া অল্প হলেও যে ঘুরতে পারে সম্ভাবনা রয়েছে তেমন। বাকি উত্তর ৪ জুন।