আরজি কর ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদ কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহিলা ভোট কমিয়ে দেবে?
Mamata Banerjee RG Kar: আগে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেছেন এমন মহিলারাও কিন্তু বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের ভোট আর পাবেন না।
বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতায় টিকে থাকার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে মহিলা ভোটারদের। পরিসংখ্যানও তাই-ই বলে। মহিলাদের উন্নয়নের জন্য বিবিধ প্রকল্প ও ভাতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই মস্তিষ্কপ্রসূত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা জনপ্রিয়তা আছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এর আগেও রাজ্যে যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পার্কস্ট্রিট থেকে শুরু করে কামদুনি, হাঁসখালি। বিভিন্ন সময়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্ষণ ও ধর্ষিতা প্রসঙ্গে নানা অসংবেদনশীল মন্তব্য করেছেন। তখনও একটিই কথা হাওয়াতে ভেসে বেড়িয়েছে। 'একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কীভাবে এমন বলতে পারেন'। কিন্তু অতটুকুই সার। বিভিন্ন ধর্ষণ নিয়ে আঞ্চলিক প্রতিবাদ, সাময়িক প্রতিবাদ-নিন্দা এসব হয়েছে কিন্তু আরজি কর কাণ্ড নিয়ে এমন ব্যাপক আন্দোলন এই বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই আন্দোলনের নেতৃত্বের পুরোভাগে মহিলারাই। আর আন্দোলনের উল্টোপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তা দমনের বিবিধ চেষ্টা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনেকেই বলছেন, এই আন্দোলন শহুরে। অথচ আমরা না দেখেও দেখছি না কীভাবে প্রতি ঘরে, অফিস ফেরতা মানুষ টোটোতে, মেট্রোতে, বন্ধু মহলে, শ্রমিকরা অন্যের বাড়ি কাজ সেরে ফিরতে ফিরতেও কথা বলছেন এই নিয়েও। সেই মানুষরা এই বিক্ষোভগুলিকে বলছেন। এই মানুষরাও বলছেন, "মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে ঘটনাটি পরিচালনা করেছেন তাতে মনে হচ্ছে তিনি কাউকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন।"
শুধু শহর নয়, গ্রামীণ অঞ্চলেও মহিলাদের মধ্যে এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে। সারা বাংলার গ্রামও দেখছে ধর্ষণের বিচার চেয়ে মুখরিত মানুষ। গ্রামের মহিলারা অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবিড় ভোটব্যাঙ্ক, বলছেন, 'দিদি'-কে তারা ভালোবাসেন ঠিকই। তবে এবার যে ধরনের কথাবার্তা বলে তিনি বিষয়টি থেকে মানুষকে 'উৎসবে' ফেরাতে চাইছেন তা দৃষ্টিকটু। মহিলাদের সাধারণ প্রশ্ন, "নিজের মেয়ে থাকত, তাহলে দিদি কি এমনটা করতে দিত?” গ্রামের মহিলাদের অনেকেই বহু দূর শহরে ট্রেনে, বাসে, নদী পার করে কাজ করতে যান। সরকারি হাসপাতালের সেমিনার রুমে কর্তব্যরত অবস্থাতে যদি কোনও চিকিৎসকের প্রাণ যেতে পারে তাহলে এই গদিব মানুষের নিরাপত্তা যে একেবারেই নেই তা ধীরে ধীরে বুঝছেন সকলে।
আরও পড়ুন- ‘মিথ্যা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী’! টাকা দিয়ে চুপ করানো প্রসঙ্গে কী বললেন তিলোত্তমার মা?
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি নয়, এই মহিলাদের আনুগত্য কিন্তু মূলত মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিই। বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই বলেছেন, রাজ্যের শহুরে, শিক্ষিত মহিলাদের এই আনুগত্য কম। শ্রমজীবী মহিলারা, সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা পান সবচেয়ে বেশি, তাঁরাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবিড় ভোটার। আর এই মহিলা ভোটব্যাঙ্কের সাহায্য না থাকলে ক্ষমতা ধরে রাখা দুষ্কর। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী থেকে শুরু করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার- বিরোধীরা বারেবারেই অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী ভাতা-রাজনীতি করেই ভোট কিনে নিয়েছেন বাংলায়।
আরজি করে ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে শহরজুড়ে যে বিক্ষোভ চলছে, তার একমাস পেরিয়ে গিয়েছে। আঁচ কমেনি এতটুকুও। এই বিক্ষোভ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদিরক্ষার পরিপন্থী বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে ২০২৬ সালে আগামী বিধানসভা নির্বাচন, এই অসন্তোষ অতদিন পরে নির্বাচনী ফলাফলে বিরূপ প্রভাব ফেলবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। খুব সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা, যারা রাজনীতিতে যুক্ত নন, বিশেষ খোঁজ রাখেন না, তারাও টিভি ও মোবাইলের দৌলতে একটি প্রশ্ন তুলছেন, সন্দীপ ঘোষকে কেন বাঁচানোর চেষ্টা হলো! তারা মনে করছেন, অভিযুক্তদের রক্ষায় সরকারের হাত রয়েছে। সকলেই প্রায় বলছেন, এই ঘটনায় একজন ব্যক্তি জড়িত নয়। বড় কোনও লোক জড়িত বলেই তাদের ধরা হচ্ছে না
আগে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেছেন এমন মহিলারাও কিন্তু বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের ভোট আর পাবেন না। হত্যার পেছনে যে ষড়যন্ত্র রয়েছে এবং সরকারি মদতে যে সেটিকে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে এই বিষয়টি তারা সোচ্চারে বলছেন। বলছেন, "আমরা টিভি ও ফেসবুকে দেখেছি। লাখ লাখ মানুষ মমতাকে দোষারোপ করছে। সবাই কি মিথ্যা বলবে?"
তবে এও ঠিক যে অনেক মহিলাই এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই অনুপ্রেরণা ভাবছেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মহিলারা অনেক বেশি ক্ষমতাবান এবং নিরাপদ৷ কোনও একজন ব্যক্তি কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে মমতা তার জন্য দায়ী নন।
আরও পড়ুন- সুপ্রিম কোর্টের কাজের ফেরার নির্দেশকে মানছেন না জুনিয়র ডাক্তাররা! কী দাবি তাঁদের?
২০০৭ সালে কলকাতায় শেষবার এমন ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী। নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সেই ঘটনাই সিপিএমের আসন টলিয়ে দেয়। কিন্তু নিজে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। এই প্রথম, ১৩ বছরে এই প্রথম স্লোগান উঠছে, দফা এক, দাবি এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ! মমতা একইসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রীও। এই দুই বিভাগে দুর্নীতি ও দোষীদের আড়াল করার অভিযোগ উঠেছে। তার উপর মুখ্যমন্ত্রী একমাসের মাথায় নির্দেশ দিয়েছেন, 'অনেক আন্দোলন হলো এবার উৎসবে ফিরুন'। হাজার হাজার মানুষের এমন বিক্ষোভকে দমিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টাকে মোটেই ভালোভাবে নিচ্ছে না আমজনতা।
মনে রাখতে হবে, সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানসহ তৃণমূল কংগ্রেসেরই বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মহিলারা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছিলেন। ভোটের বাজারে সেই ইস্যু সন্দেশখালি ছাড়িয়ে সারা ভারতে ছাপ ফেলতে পারেনি অবশ্য। কিন্তু আরজি করের ঘটনা প্রভাব ফেলেছে সারা বিশ্বে। আরজি করের ঘটনাস্থলে ভাংচুর, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেই দুর্নীতিতে যুক্ত, প্রমাণ লোপাটে অভিযুক্তদের সরকারের আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা প্রমাণ করেছে এই ঘটনার শিকড় বহুদূর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের মধ্যে বর্তমান শাসকের প্রতি একটা ক্ষোভ ছিলই। দীর্ঘদিন ধরে এই রাজ্যে দুর্নীতি চলছে শিক্ষাক্ষেত্রে, রেশন ব্যবস্থায়। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের অবস্থা এতদিনে প্রকাশ হচ্ছে। আরজি করে ওই চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যা মানুষের মধ্যেকার অসন্তোষের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে। মানুষ বুঝতে পারছে, স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিটি ক্ষেত্রে দালালচক্র রয়েছে আর তাতে যুক্ত তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডারাই, যারা খুব শক্তিশালী। আর এদের মাথাদের বাঁচাতে মরিয়া সরকার। নাহলে এত অভিযোগ অসন্তোষের পরেও কেন হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে বদলি করা হলো? মহিলাদের নিরাপত্তার বদলে অপরাজিতা বিলে তৃণমূল সরকার নাইট ডিউটি কম করার কথা বলছে। এত মানুষের ক্ষোভকে তুড়িতে উড়িয়ে উৎসবের হাওয়ায় মাতানোর কথা বলে আসলে নেত্রী সেই জনগণকে অপমান করে চলেছেন যাদের একটি বড় অংশই মহিলা। যাদের একটি বড় অংশই নেত্রীকে সমর্থন করে ভোট দিয়েছেন। নিরাপত্তা আর সম্মান যখন তলানিতে ঠেকে, সমর্থন কি তখন আর সহায় হয়?