ইভিএম নয়, একমাত্র ব্যালটে ভোট হলেই শাসককে হারানো যাবে?

VVPAT Slip Counting: এক একটি ইভিএমে দেখা গেছে, প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ ভোট স্টোর করা বা রাখা সম্ভব। সুতরাং লোকসভায় জিততে গেলে ৩ থেকে ৫ টি ইভিএম মেশিন ম্যানিপুলেট করলেই হবে।

লোকসভা নির্বাচনে ভোট পড়তে আর মাত্র কয়েক দিনই বাকি। নির্বাচন কমিশন শাসকদলের অভিন্ন নির্বাচনী বিধি অলঙ্ঘন দেখেও দেখছে না। তাতে স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধছে, শাসকদল বিজেপি ইভিএম মেশিনকে প্রভাবিত করে আবার ক্ষমতায় আসবে না তো? সাম্প্রতিককালে ভারতের অস্বচ্ছ নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি উন্মোচিত হয়েছে। এই মুহূর্তে অনেকেই তাই বলা শুরু করেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন যাচাই করতে হবে এবং বিচার বিভাগীয় যাচাই-বাছাই করা হোক এই ইভিএম। ২০০৪ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচন পেপারলেস অর্থাৎ ইভিএমে হয়েছে। তবুও, এই যন্ত্রগুলি গভীরভাবে বিতর্কিতই রয়ে গেছে। এই নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা কাগজের স্লিপের সঙ্গে ইলেকট্রনিকভাবে রেকর্ড করা ব্যালটের একশো শতাংশ মিলের দাবিতে আবেদনের শুনানি করেন। বর্তমানে, এই রেকর্ডগুলি সংক্ষিপ্তভাবে একটি কাঁচের পর্দার পিছনে নির্বাচকদের দেখানো হয়; শুধুমাত্র একটি ছোট নমুনা গণনা হয়।

ইভিএমের বিতর্কের ইতিহাস ও কারণ

বিজেপির রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ ডঃ সুব্রমানিয়াম স্বামী ২০১০ সাল থেকে বলে আসছেন যে, ইভিএম বন্ধ করা উচিত কিন্তু তিনিও অস্বচ্ছতা প্রমাণ করতে পারেননি, বা বলা ভালো তাঁর যুক্তিও শোনা হয়নি। আসলে এটা একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যেটা বোঝা খুব জরুরি। এই পদ্ধতি বুঝতে পারলেই কেন ইভিএমের বদলে ব্যালটে ভোট করা উচিত সেই দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করা যাবে। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনকে বেশ কিছু প্রশ্ন করা জরুরি।

যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে, একটি লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় প্রায় ১৭০০ টি অংশ আছে। প্রত্যেকটি অংশে প্রায় গড়ে ৯০০ জন ভোটার আছেন যারা একই ইভিএমে একই বুথে ভোট দেন। এক একটি সংসদীয় কেন্দ্রে যদি গড়ে প্রায় ১৬ লক্ষ ভোটার থাকেন, তাহলে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়ার অর্থ প্রায় ১০ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ ভোট দিয়েছেন। যদি বিগত বেশ কিছু নির্বাচন পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, ৩২ টি আসনে জেতা হারার ব্যবধান ১ শতাংশেরও কম, ৬৯ টি আসনে জেতা হারার ব্যবধান ২ শতাংশের কম আর প্রায় ১০০ টি আসনে ব্যবধান ৩ শতাংশের কম। ১ শতাংশ মানে মোটামুটি ১০০০০ ভোট। এক একটি ইভিএমে দেখা গেছে, প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ ভোট স্টোর করা বা রাখা সম্ভব। সুতরাং যদি লোকসভায় জিততে হয় বা কোনও প্রার্থীকে হারাতে হয় ৩ থেকে ৫ টি ইভিএম মেশিনকে প্রভাবিত বা ম্যানিপুলেট করলেই হবে। বিধানসভার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরও কম হলেও চলবে।

আরও পড়ুন- বাদ নেই সিপিএম নেতাও! প্রথম দফাতেই ৪৫০ জন কোটিপটি প্রার্থী দেশে?

অনেকে হয়তো ভাবছেন, এবারের ভোটে যেহেতু ভিভিপ্যাট থাকবে তাই প্রত্যেক ভোটার বুঝতে পারবেন তিনি কাকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু সত্যি কি তাই হবে? ২০১৯ সালেও ভিভিপ্যাট ছিল। এরকম বহু উদাহরণ শোনা গেছে যেখানে গত লোকসভা নির্বাচনে একজন ভোটার দেখেছেন যে তিনি যাকে ভোট দিয়েছেন সেখানে ভোট পড়েনি কিন্তু অভিযোগ জানাতে পারেননি। কারণ প্রমাণ না করতে পারলে যিনি অভিযোগ করছেন তাঁকেই জেলে যাওয়ার কথা শুনতে হয়েছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় যে, একজন ভোটার দেখতে পেলেন তাঁর ভোট সঠিক জায়গাতেই পড়েছে কিন্তু সেটা যদি নাই গোনা হয় তাহলে সেটার কি মূল্য থাকে? অনেকে বলেন, হাঁড়িতে ফুটতে থাকা একটা ভাত পরীক্ষা করলেই বোঝা যায় সব চাল সেদ্ধ হয়েছে কিনা। তা বোঝা গেলেও এটা কি বোঝা সম্ভব যে হাঁড়িতে কোনও বিষ মেশানো আছে কিনা? গত লোকসভা নির্বাচনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল, প্রতি বিধানসভা ক্ষেত্রের ৫ টি বুথের ভিভিপ্যাট স্লিপ গোনা যথেষ্ট নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য? কিন্তু যদি দেখা যায় ভিভিপ্যাট এবং মেশিনের ভোটের মধ্যে তফাৎ আছে? তাহলে কি করণীয়? তার কোনও উত্তর নির্বাচন কমিশন দেয়নি।

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ২১টি বিরোধী দলের তরফ থেকে অন্তত ৫০ শতাংশ ভিভিপ্যাট গোনার দাবি তোলা হয়। নির্বাচন কমিশন জানায়, এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আরও ৬ দিন লাগবে। যদি দীর্ঘ দু'মাস ধরে নির্বাচন চালানো যায়, তারপর আরও ৬ দিন অতিরিক্ত লাগলে কি খুব অসুবিধা হবে?

২০১৯ সালের মার্চ মাসে নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ আদালতের কাছে একটি রিপোর্ট জমা করে। তাতে বলা হয়, এটি আইএসআই অর্থাৎ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত, যাতে বলা হচ্ছে, ৫০ শতাংশ ভিভিপ্যাট না গুনলেও চলবে। পরে তথ্য জানার অধিকার আইন থেকে জানা যায়, নির্বাচন কমিশন দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে সম্পূর্ণ বিপথে চালনা করেছে এবং ওই রিপোর্টের সঙ্গে আইএসআইয়ের কোনও যোগাযোগই নেই। শুধু তাই নয়, বিরোধীরা দাবি করেছিল, আগে ভিভিপ্যাট গুনতে হবে, তারপর সেটা মিলিয়ে দেখতে হবে ওই ৫টি বুথের ইভিএম প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে। নির্বাচন কমিশন সেই দাবিকেও মান্যতা দেয়নি। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে সর্বোচ্চ আদালত এই ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট সংক্রান্ত কোনও জনস্বার্থ মামলা শুনতে চায়নি। এবার বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে উত্তর জানতে চেয়েছেন, কেন ২৪ লক্ষ ভিভিপ্যাট মেশিন কিনেও তার থেকে প্রাপ্ত স্লিপ এবং ইভিএম থেকে প্রাপ্ত ভোট গুনে দেখা হবে না?

একজন নির্বাচক অনেক কিছু ভেবে একটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর ভোটের মূল্য গণতন্ত্রের পক্ষে অপরিসীম। সাম্প্রতিক যে লোকনীতি সিএসডিএসের সার্ভে করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন ইভিএমকে প্রভাবিত করা সম্ভব। তাহলে যখন নির্বাচন কমিশন কেন 'সব ঠিক আছে' বলে গা বাঁচায়? নরেন্দ্র মোদিও তো বলেন, সব কিছু ঠিক আছে, গণতন্ত্র সুরক্ষিত, কেউ সংবিধান বদল করতে পারবে না! সেই সব বুলি যে ফাঁপা, তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কথার মিল নেই কি? একটি ইভিএমের থেকে প্রাপ্ত ভোট গোনার চেয়ে কি সমস্ত ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনে, ইভিএমের সঙ্গে মিলিয়ে, তারপর ফলাফল ঘোষণা করা অনেক বৈজ্ঞানিক নয়?

নাহলে এই গণতন্ত্রের কীই বা মানে, যেখানে একজন নির্বাচক ভোট দিচ্ছেন অথচ জানতেই পারছেন না তাঁর ভোট গোনা হচ্ছে কিনা? যদি ১০০ শতাংশ ভিভিপ্যাট স্লিপ না গোনা হয়, তাহলে কি বিষয়টা অসাংবিধানিক হয়ে যায় না? তাহলে ভিভিপ্যাটকে এই নির্বাচন প্রক্রিয়াতে প্রবর্তন করার, জনগণের এত পয়সা নষ্টের যুক্তিই বা কী?

আরও পড়ুন- প্রার্থীর সম্পত্তির হিসেব জানার অধিকার নেই ভোটারের! সুপ্রিম কোর্টের যে রায় ঘিরে শোরগোল

নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, সমস্ত ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনতে গেলে ফলাফল প্রকাশ করতে আরও ৬-৭ দিন বেশি সময় লাগবে। এখানে উল্লেখ্য, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের গণনা করতেও কিন্তু ভালো সময় লেগেছিল এবং আমেরিকার নাগরিকেরা তা মেনেও নিয়েছেন। যদি ৭ দফায় প্রায় ৩ মাস ধরে ভোট করানো যায়, তাহলে গোনার ক্ষেত্রে কেন এত অনীহা? কেন সময় বেশির অজুহাত দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন? বেশ কিছু রাজনৈতিক দল বলে থাকে, নির্বাচনের পরে, তাঁদের কর্মীরা ইভিএম বুক দিয়ে আগলে রাখবেন। এটা অনেকটা কম্পিউটারের ভাইরাস ঠেকানোর জন্য দরজা-জানলা বন্ধ রাখার মতো কথা। ইভিএম বুক দিয়ে আগলানোর চেয়ে নির্বাচন কমিশনকে ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনতে বলা কি বেশি রাজনৈতিক পদ্ধতি নয়?

তবে ভিভিপ্যাট নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভিভিপ্যাট নিয়েও বেশ কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা আছে। আগে ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট থাকত না। ফলে কোন ইভিএম কোন বিধানসভায় যাবে, প্রাথমিকভাবে বোঝা যেত না। এখন ভিভিপ্যাটের যে স্লিপ বেরোয় তাতে প্রার্থীর নাম, সিরিয়াল নম্বর এবং তাঁর নির্বাচনী প্রতীক ছাপা থাকে, ফলে ইভিএম আরও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। ভিভিপ্যাট যদি সাধারণ একটি ছাপার যন্ত্র হয় এবং তা যদি আগে থেকে না ঠিক করা থাকে, তাহলে ভিভিপ্যাট কি আপনার হয়ে ভোট দিয়ে দিচ্ছে? কিন্তু সেটা আরও বড় এবং ভিন্নতর বিতর্ক! আপাতত সমস্ত দলেরই উচিত নির্বাচন কমিশনকে সব ভিভিপ্যাট স্লিপ গোনার জন্য বাধ্য করা। আগামীতে যাতে সমস্ত নির্বাচন ব্যালটে করা হয়, সেই বিষয়ে মানুষের মতামতকে সংগঠিত করে বৃহত্তর আন্দোলন না তৈরি করতে পারলে কিন্তু সামনে সমূহ বিপদ। শুধু একজন নির্বাচক কি ভোট দিলেন সেই সন্দেহের নিরসন করার জন্যই তো ভিভিপ্যাট নয়। এই স্লিপ গুনে দেখাই গণতন্ত্রকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে।

More Articles