সিবিআই-এর হাতে ময়নাতদন্তের আগের ছবি, র্যাডারে যুক্ত চিকিৎসকরা
RG Kar Post Mortem: ময়না তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান চিকিৎসক অপূর্ব বিশ্বাস ৯ অগস্ট সন্দীপ ঘোষের ঘরে বার বার কেন গিয়েছিলেন, সেই প্রশ্নেরও উত্তর সিবিআই খুঁজছে। সে জন্য তাঁকে বার বার তলব করা হচ্ছে।
আরজি কর কাণ্ডের ফরেন্সিক তদন্ত নিয়ে আগেই প্রশ্নের মুখে পড়েছিল রাজ্য। এমনকী ক্রাইম স্পট ভালো করে সিল করা হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছিল। সেখানে যাতায়াত করেছে অসংখ্য মানুষ। যার ফলে নমুনা-তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রখর। বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টেও প্রশ্ন তুলেছিল সিবিআই। এবার প্রশ্ন উঠে গেল আরজি কর কাণ্ডে মৃতার তদন্ত রিপোর্ট নিয়েও। আরজি কর কাণ্ডের ময়নাতদন্তে গাফিলতি নিয়ে প্রথম থেকেই উঠেছে একাধিক প্রশ্ন।
ইতিমধ্যেই আরজি করের ঘটনায় ময়না তদন্তকারী তিন চিকিৎসকের থেকে আলাদা করে ব্যাখ্যা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করেছে সিবিআই। তবে আগে হওয়া ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বিশেষ ভরসা রাখতে পারছে না তারা। সেই কারণেই চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত রিপোর্টের পাশাপাশি তরুণী চিকিৎসকদের শরীর থেকে সংগৃহিত বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টও পাঠানো হয়েছে বিশেষজ্ঞদের কাছে।
এরই মধ্যে সিবিআইয়ের হাতে এসেছে মৃতার শরীরের বেশ কয়েকটি ছবি। জানা গিয়েছে, এক চিকিৎসক ময়নাতদন্তের সময় সন্দেহের বশে খুব কাছ থেকে সেই ছবিগুলি তুলে রেখেছিলেন। তরুণীর বিভিন্ন ক্ষতের চিত্র ধরা রয়েছে সেই পনেরোটি ছবিতে। আর সেই ছবিগুলিই নাকি তদন্তে সিবিআইয়ের বিশেষ ভরসা হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই দিল্লিতে ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
এর আগেও ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়া নিয়ে বারবার সওয়াল তুলেছে সিবিআই। জানা গিয়েছে, ময়নাতদন্তকারী দুই চিকিৎসক ও ডোমেদের বয়ানে সেই সন্দেহ আরও বেড়েছে। ময়নাতদন্তের সময় যে ভিডিওগ্রাফি করে রাখার রীতি, সেই ভিডিও থেকে স্পষ্ট ভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কার্যত সেই ভিডিওগ্রাফির সময়েও যথেষ্ট অবহেলার প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। দিল্লি এবং কল্যাণী এইমসের বিশেষজ্ঞদের ইতিমধ্যেই এই ভিডিও দেখানো হয়েছে। তবে তেমন কোনও তথ্য বেরিয়ে আসেনি সেই ভিডিও থেকে।
আরও পড়ুন: ওঁর দু’চোখ জোড়া স্বপ্ন রক্ত হয়ে ঝরতে দেখেছি: আরজি কর কাণ্ডে মৃতার মা-বাবা
উঠেছে ময়নাতদন্ত নিয়ে গাফিলতির অভিযোগও। সিবিআই তদন্তকারীরা জানতে পারেন, গত ৯ অগস্ট মোট আটটি দেহের ময়নাতদন্ত হয়। তার মধ্যে সাতটি দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে সূর্যাস্তের আগেই। আরজি করের নিহত চিকিৎসকেরটাই শুধু হয় সূর্যাস্তের পর। সিবিআই জানতে পেরেছে, মৃতার ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছিল সন্ধে ৬টা নাগাদ। প্রায় ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ধরে চলে কাজ। সন্ধে ৭.১০ নাগাদ শেষ হয় তা। সেই সময় মর্গে উপস্থিত ছিলেন মোট তিন জন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ও দু'জন ডোম। তাঁরা ময়নাতদন্ত করা থেকে শুরু করে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুরো কাজটি করেন। সবথেকে কম সময়ে নিহত চিকিৎসকের ময়নাতদন্ত সেরে ফেলা হয়েছিল। কেন দ্রুত পোস্টমর্টেম সেরে ফেলা হল সেই বিষয়টিও খুঁটিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
এ সব নিয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই ওই দুই ডোম ও চিকিৎসকদের কয়েক জনকে ডেকে পাঠায় সিবিআই। সূত্রের খবর, জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন ডোম জানিয়েছেন, তিনি ময়নাতদন্তে তাড়াহুড়ো করার ক্ষেত্রে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু আপত্তিতে কান দেননি চিকিৎসকরা। এমনকি, সন্ধের সময় ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেই বিষয়েও জানতে চেয়েছিলেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। কিন্তু সেক্ষেত্রে কোনও জবাব দিতে পারেননি ডোম বা চিকিৎসকরা।
সূত্রের খবর, তরুণী চিকিৎসকের শরীরের বাইরে ও ভিতরের আঘাত সম্পর্কে যে দিকগুলি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রত্যেক চিকিৎসকের আলাদা ব্যাখ্যা নথিভুক্ত করা হয়। ময়না তদন্তের দু’দিন পরে সংগৃহীত নমুনাগুলি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তার কয়েকটির রিপোর্ট তদন্তকারীদের হাতে এসেছে। সেই রিপোর্ট এবং ময়না তদন্তের রিপোর্টের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিল্লি এমসে পাঠানো হয়েছে ইতিমধ্যেই। ওই চিকিৎসকের মোবাইলবন্দি ১৫টি ছবিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তাঁরা। ইতিমধ্যেই ছবিগুলির ডিজিটাল ফরেন্সিক করিয়ে সিবিআই নিশ্চিত হয়েছে, সেগুলি কোনওভাবেই বিকৃত করে তৈরি করা নয়। সূত্রের খবর, সবকটি ছবি দেহের যথেষ্ট কাছ থেকে তোলা হয়েছিল। তাতে স্পষ্ট রয়েছে শরীরের বিভিন্ন আঘাত, যৌনাঙ্গের ক্ষত, দেহ থেকে সংগ্রহ করা নমুনা, এমনকি ব্যবচ্ছেদের পরে দেহের ভিতরের আঘাতও।
এখানেই শেষ নয়। ময়নাতদন্ত নিয়ে রয়েছে আরও রহস্য। ময়না তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান চিকিৎসক অপূর্ব বিশ্বাস ৯ অগস্ট সন্দীপ ঘোষের ঘরে বার বার কেন গিয়েছিলেন, সেই প্রশ্নেরও উত্তর সিবিআই খুঁজছে। সে জন্য তাঁকে বার বার তলব করা হচ্ছে। সূত্রের খবর, ময়না তদন্ত শুরুর আগে প্রায় এক ঘণ্টা সন্দীপের ঘরে বসেছিলেন অপূর্ব। সন্ধে বেলা ময়না তদন্ত শেষ হতেই ফের তিনি যান ওই ঘরে। আধ ঘণ্টা পরে ফিরে এসে ময়না তদন্তের রিপোর্ট তৈরি করেন। এর পরে ফের সন্দীপের ঘরে গিয়ে ঘণ্টা দেড়েক বসে ছিলেন অপূর্ব। কেন? এক্ষেত্রে ময়নাতদন্তকারীদের উপর কি আদৌ কোনও প্রভাব তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন সন্দীপ? উঠেছে সেই প্রশ্নও।
আরও পড়ুন:আরজি কর: খুনের রাতে সল্টলেকের হোটেলে গা ঢাকা? আশিস পাণ্ডেকে কেন খুঁজছে সিবিআই?
জানা গিয়েছে, তরুণী চিকিৎসকের শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলি দু’দিন ধরে মর্গেই রাখা ছিল। যদিও নিয়মানুযায়ী ময়না তদন্তের রিপোর্টের সঙ্গেই পুলিশ নমুনাও নিয়ে যায় পরীক্ষায় পাঠানোর জন্য। আরজি করের ক্ষেত্রে তা হয়নি। সূত্রের খবর, ৯ অগস্ট রাতে ময়না তদন্তের রিপোর্ট তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং রাত ১০টা নাগাদ পোর্টালে আপলোডও হয়ে গিয়েছিল। তার পরেও কেন দু’দিন পর্যন্ত ফেলে রাখা হল নমুনাগুলি? এখানেই শেষ নয়, দু’দিন পরে মর্গ থেকে নমুনাগুলি পুলিশকে হস্তান্তর করেছিলেন অপূর্ব একাই। প্রত্যেক নমুনার উপরে যে সিল করা হয়েছে, তাতে একমাত্র সইও রয়েছে অপূর্বেরই। কেন ময়না তদন্তে থাকা বাকি দুই ডাক্তারের সেখানে সই নেই? উঠেছে সেই অনিয়ম নিয়েও প্রশ্ন।
সামনেই সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার পরবর্তী শুনানি। এবং তদন্ত সংক্রান্ত নতুন স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দিতে হবে সিবিআইকে সেখানে। আরজি কর কাণ্ডের ময়নাতদন্ত সংক্রান্ত এই সব অনিয়ম ও গাফিলতির প্রশ্নগুলি যে সেক্ষেত্রে সিবিআইয়ের বড় হাতিয়ার হতে চলেছে, তা একরকম আঁচ করাই যায়।