আছে অথচ নেই! বাংলার রহস্যময় এই অঞ্চলের কথা পাওয়া যাবে না ইতিহাসেও
চন্দ্রকেতুগড়ের রহস্য আরও বাড়িয়ে তোলে প্রায় দুই থেকে আড়াইহাজার বছর পুরনো গ্রিক এবং রোমান পণ্ডিতদের কিছু লেখা। এই সকল লেখার একটা বৈশিষ্ট্য হলো যে, এগুলিতে এমন একটা রাজ্য, তার অবস্থান এবং সেই রাজ্যের মানুষের ব্যাপারে লে...
প্রাচীন বাংলার শাসকদের নাম উঠলে আমাদের মনে আসে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, পাল, সেনবংশের রাজা, সুলতানি শাসন, এবং নবাবদের কথা। সকলের ব্যাপারেই কম-বেশি ইতিহাস বই থেকে জানা যায়। তাদের সাম্রাজ্যের বহু নিদর্শন বাংলার আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই বাংলারই একটা রহস্যে ঘেরা অধ্যায় সবার চোখের সামনে লুকিয়ে আছে। রহস্যের কুয়াশা সরিয়ে সে মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। সেই এক রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার, পরিব্রাজক এবং ইন্ডিকা-র লেখক মেগাস্থিনিস, প্লিনি, টলেমি, প্রাচীন ভারতবর্ষর রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিক্রমাদিত্যর নবরত্ন সভার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহির, বাংলার প্রায় সকলেরই জানা খনার বচন-খ্যাত খনা এবং সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কর্তা প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। ইতিহাসের বইতে স্থান না পাওয়া সেই রহস্য আমাদের কাছে চন্দ্রকেতুগড় নামেই পরিচিত।
উত্তর চব্বিশ পরগনার বেঁড়াচাপার কাছে বিদ্যাধরী নদীর তীরে অবস্থিত চন্দ্রকেতুগড়ের ব্যাপারে বর্তমানে কারও খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। তাই অল্প কিছু জনশ্রুতি, ছোট্ট একটা জাদুঘর, যাকে সংগ্রহশালা বলা যায়, গুগলের খুঁজে আনা অল্প কিছু তথ্য এবং প্রচুর অনুমানের ফলে তৈরি হওয়া রহস্যের বেড়াজাল চন্দ্রকেতুগড়কে ঘিরে রেখেছে। বিভিন্ন তথ্য এবং জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, ডাক্তার তারকনাথ ঘোষের অনুরোধে ১৯০৭ সালে প্রথম আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তরফ থেকে এ. এইচ. লংহার্স্ট এই এলাকা পরিদর্শন করে চন্দ্রকেতুগড়কে 'গুরুত্বহীন' আখ্যা দেন। ১৯০৯ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই এলাকা পরিদর্শন করেন এবং এই এলাকার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। ১৯২০ সালে 'বসুমতী' নামে এক মাসিক পত্রিকায় চন্দ্রকেতুগড়-সংক্রান্ত তাঁর প্রাথমিক গবেষণা প্রকাশিত হয়। তখনও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় তুলতে পারেননি, কারণ এই ঘটনার এক বছর পরে সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার হয়। সিন্ধু সভ্যতা আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গে সকলেই চন্দ্রকেতুগড়ের কথা ভুলে যায়।
স্বাধীনতার পরে ১৯৫৫-'৫৭ সালের কিছু পরে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তরফে প্রথম খননকার্য শুরু হয়। সেই সময়ে প্রাক-মৌর্য যুগ থেকে শূঙ্গ, কুষাণ এবং গুপ্ত-পরবর্তী যুগের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার হয়। ঐতিহাসিকরা এই সকল নিদর্শন দেখে জানান যে, চন্দ্রকেতুগড়ের বয়স প্রায় ২৩০০-২৫০০ বছর, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যে কোনও এক সময়ে চন্দ্রকেতুগড়ের পত্তন হয়। এই খননকার্য বাঙালির পরিচিত খনার বচন-খ্যাত খনাকেও প্রথম বাস্তবের চরিত্র হিসাবে প্রমাণ করে। চন্দ্রকেতুগড়ের একটি উঁচু ঢিবি স্থানীয় মানুষের কাছে খনামিহিরের ঢিবি নামে পরিচিত। খননকার্যের ফলে প্রমাণ হয় যে, খনামিহিরের ঢিবির খনা এবং মিহির আসলে দু'জন আলাদা মানুষের নাম এবং দু'জনেই সাধারণ মানুষের কাছে খুব পরিচিত। বিভিন্ন সূত্র এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী খনা নবরত্নের মধ্যে একজন বরাহমিহিরের ছেলেকে বিয়ে করেন। পরবর্তীকালে বারংবার নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করার ফলে বরাহমিহিরের প্রায় সমতুল খ্যাতি অর্জন করে খনা স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির বিরাগভাজন হয়ে গঞ্জনা সহ্য করেন। শেষে বরাহমিহির, তাঁর ছেলে, উভয়ের প্রেরিত কোনও আততায়ী, অথবা সাংসারিক অশান্তি সহ্য না করতে পেরে তিনি নিজেই তাঁর জিভ কেটে ফেলেন।
আরও পড়ুন: জাহাজে লুকোনো রত্ন পেয়ে ভাগ্য ফিরেছিল গৌরী সেনের! বাংলা প্রবাদগুলিতে লুকিয়ে যে ইতিহাস
এই শতকের শুরুতেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তরফে চন্দ্রকেতুগড়ে দ্বিতীয়বার খননকার্য চালানো হয় যদিও তার বেশিরভাগ নথি কোথাও প্রকাশ করা হয় নি। ২০১৭ সালের পর সরকারি সাহায্য পেয়ে একটি ছোট জাদুঘর তৈরি করা হয়, যাকে সংগ্রহশালা বললে বেশি মানানসই লাগে। এই দুইবারের খননকার্যের ফলে চন্দ্রকেতুগড় থেকে গুপ্ত-পরবর্তী একটি মন্দির, বিভিন্ন যুগের কাঠ, পাথরের স্থাপত্য, বিভিন্ন যুগের সোনা, রূপোর মুদ্রা পাওয়া যায়। দ্বিতীয়বার খননকার্যের সময় দুর্গ অথবা প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদ এবং একটি আয়তাকার কাঠামো আবিষ্কার হয়, যেটাকে বন্দরের অংশ হিসেবে মনে হয়। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, এই বন্দরের মাধ্যমে সেই সময় এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলতো। ভারতের বিভিন্ন নথি এই সকল তথ্য দিলেও এই কথা জানাতে পারে না যে, চন্দ্রকেতুগড়ের প্রথম রাজা আসলে কে ছিলেন? তাঁর নিজের অথবা তাঁর বংশপরিচয়, কিছুই জানা যায় না। তাঁর সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি, তাঁর রাজ্যের অর্থনৈতিক অথবা সামরিক অবস্থা সম্পর্কেও কিছুই জানা যায়নি। এই কারণেই চন্দ্রকেতুগড় রহস্যের চাদরে ঢাকা থাকে।
চন্দ্রকেতুগড়ের রহস্য আরও বাড়িয়ে তোলে প্রায় দুই থেকে আড়াইহাজার বছর পুরনো গ্রিক এবং রোমান পণ্ডিতদের কিছু লেখা। এই সকল লেখার একটা বৈশিষ্ট্য হলো যে, এগুলিতে এমন একটা রাজ্য, তার অবস্থান এবং সেই রাজ্যের মানুষের ব্যাপারে লেখা হয়েছে, যেই রাজ্যের ব্যাপারে আমাদের কোনও ইতিহাস বইতে উল্লেখ নেই। মেগাস্থিনিস, টলেমি, ডিওডিরাস এবং প্লিনি-র লেখায় সেই রাজ্যের অথবা এলাকার নাম গঙ্গাহৃদি বা গঙ্গাঋদ্ধি, অথবা গঙ্গারিডাই। মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গা নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে এই গঙ্গারিডাই অথবা গঙ্গাহৃদি রাজ্যের পূর্ব সীমানায় সমুদ্রে মিলিত হয়েছে। প্লিনির বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গা নদীর শেষ অংশ গঙ্গাঋদ্ধি, অথবা গঙ্গারিডাই রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। টলেমির বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গার সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পাঁচটি মুখের আশপাশের সমস্ত এলাকা গঙ্গাঋদ্ধি অথবা গঙ্গারিডাই-বাসীর দখলে ছিল। সেই রাজ্যের রাজধানী ছিল গাঙ্গে। টলেমির বর্ণনা করা অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের হিসেব করলে বোঝা যায় যে, সেই হারিয়ে যাওয়া গঙ্গারিডাই রাজ্যের অস্তিত্ব বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের তমলুক থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মধ্যে কোথাও ছিল।
চন্দ্রকেতুগড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বিদ্যাধরী নদী খ্রিস্টাব্দ সতেরো শতক অবধি গঙ্গার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল এবং নিকটবর্তী একটা এলাকার নাম যে দেগঙ্গা শুধুমাত্র গঙ্গা ছাড়াও অন্য কারণেও হতে পারে, সেই দিকে এই সমস্ত তথ্য ইশারা করে। এই গঙ্গারিডাই অথবা গঙ্গাহৃদিরা ইতিহাসের আরও একটা জায়গায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। ডিওডিরাসের বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে, গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ভারতের পূর্ব প্রান্তে এক সুবিশাল সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছিল। তিনি সেই সেনাবাহিনীকে গঙ্গারিডাই অথবা গঙ্গাহৃদি রাজ্যের সেনাবাহিনী বলেই বর্ণনা করে লিখেছেন যে, এই সুবিশাল সেনা আলেকজান্ডারের মতো বীরকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। এই প্রসঙ্গে আরও একটা নাম গ্রিক এবং রোমান লেখকদের লেখায় উঠে এসেছে, যা হলো স্যানড্রোকোটাস। এই স্যানড্রোকোটাসের সঙ্গে আলেকজান্ডারের দেখা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে স্যানড্রোকোটাস আর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একই মানুষ মনে হলেও, ইতিহাস বলে যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজা হওয়ার আগেই আলেকজান্ডার মারা যান এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর জীবনের বিভিন্ন কাহিনি লেখা কোনও বৌদ্ধ অথবা জৈন শিলালিপিতেও এই ঘটনা পাওয়া যায় না। অন্যদিকে আলেকজান্ডার, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং চন্দ্রকেতুগড়ের পত্তনের সময় খুবই কাছাকাছি হওয়ার কারণে রাজা চন্দ্রকেতুর পরিচয় নিয়ে আরও ধোঁয়াশা তৈরি হয়।
জেমস প্রিন্সেপ যদি ধৌলির শিলালিপির পাঠোদ্ধার না করতেন, তাহলে অশোকস্তম্ভ মানুষের চোখের সামনে বছরের পর বছর একইভাবে থাকা সত্ত্বেও কেউ সম্রাট অশোকের কথা জানতে পারত না। চন্দ্রকেতুগড় হয়তো তার জেমস প্রিন্সেপের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা কি চোখের সামনে থাকা কিছু দেখতে পাচ্ছি না?