একদিনের শিশু, ৩০০০ ভ্রুণকে হত্যা ইজরায়েলের! গাজায় আর শিশুদিবস আসবে?

Gaza Children Death Toll: জাতিসংঘের শিশু সংস্থার মতে, প্রায় ১.৯ মিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ গাজার জনসংখ্যার ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই বাস্তুচ্যুত এবং তাঁদের অর্ধেকই হচ্ছে শিশু।

মাথার উপরে ছাদ আছে, উইকেন্ডে স্পেশাল খাবার আছে। স্কুলে রকমরকম টিফিনের বায়না আছে, একসঙ্গে কোথাও পুকুরে স্নান আছে, জন্মদিনে রিটার্ন গিফট আছে, একসঙ্গে মেলা ঘুরতে যাওয়াও আছে। শিশুদের জীবন কোথাও নিরাপদ, আর কোথাও চরম সঙ্কটে। গাজাতে গণহত্যা চলছে, একবছরের বেশি হয়ে গেল। টিফিন শব্দটির মানে ভুলতে বসেছে বাচ্চারা, মাথার উপর অভিভাবক নেই, কারও হয়তো হাত-পা নেই, চোখ নেই। কিচ্ছু নেই, নেই নেই! ক্যালেন্ডারে শিশুদিবস আসে, অথচ তাঁদের স্পর্শ করে না। গাজায় মাটিতে পা দিলে, গাজার বাতাসে শ্বাস নিলে ১৪০০০ শিশুর গোঙানি ভেসে আসে। একবছরে গাজায় মেরে ফেলা হয়েছে ১৪ হাজারের কাছাকাছি শিশুকে! এখানেই শেষ না। ইজরায়েলি বাহিনী গাজার বৃহত্তম ফার্টিলিটি ক্লিনিকে সংরক্ষিত ৩,০০০ ভ্রূণও হত্যা করেছে। ক্যালেন্ডারে ১৪ নভেম্বর এসেছে তবু, নিজস্ব নিয়মে।

কয়েক মাস আগে গাজার একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। ১০ বছরের তালা আবু আজওয়ার। শরীর একটি সাদা কাফনে মোড়ানো, পড়ে রয়েছে তাঁর গোলাপি রঙের রোলার স্কেট। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাজার হাজার শিশুর প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই ছবি। গাজার শিশুরা বাঁচতে চেয়েছিল। স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিল। মৃত্যুর খুব কাছে দাঁড়িয়ে ভয়াবহ বাস্তবতা পালাতে চেয়েছিল। একটা ইচ্ছেও পূরণ হয়নি। ইজরায়েল খুন করেছে শিশুদের। আধো-আধো কথা বলা, পুতুল খেলা, লুকোচুরি খেলা, দুধের শিশুদের খুন করেছে নেতানিয়াহুর দেশ। বদলা নিয়েছে দেশ। হাজারো হাজারো লাশের ভিড়ে নিজের সন্তানকে চিনতে হাতে পায়ে শিশুর নাম লিখে দিতে হয়েছে মা-বাবাদের! কোন শব্দেই বা এই তীব্র যন্ত্রণা লেখা সম্ভব?

আরও পড়ুন- মেরুদণ্ড টুকরো টুকরো করে দিয়েছে ইজরায়েলি বোমা! যেভাবে অথর্ব হচ্ছে গাজার শিশুরা

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরলস যুদ্ধের মুখোমুখি গাজা। নিশানায় সাধারণ মানুষ। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অনুমান, গাজায় কমপক্ষে ১৪,০০০ শিশু নিহত হয়েছে। আরও হাজার হাজার শিশু গুরুতর আহত হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থার মতে, প্রায় ১.৯ মিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ গাজার জনসংখ্যার ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই বাস্তুচ্যুত এবং তাঁদের অর্ধেকই হচ্ছে শিশু। হাজার হাজার শিশু অনাথ, তাদের জীবন চিরতরে বদলে গেছে। যুদ্ধ এখন গাজার গণ্ডি ছাপিয়ে লেবাননে। অর্থাৎ আরও ধ্বংস, আরও মৃত্যু, আরও ছোট ছোট লাশ। গাজাকে প্রায় শেষ করে দেওয়া হছে মানচিত্র থেকে। আশঙ্কা, গাজার মতো ধ্বংস হয়ে যাবে লেবাননও। গত সপ্তাহ পর্যন্ত, লেবাননের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রক হিসেব দিয়েছে যে, সেই দেশে ১৯২ জন শিশু নিহত হয়েছে এবং কমপক্ষে ১,২৫৫ জন আহত হয়েছে।

ক্রমাগত বোমাবর্ষণের পাশাপাশি খাবার, পানীয় জল, নিকাশী এবং বিদ্যুতের মতো মৌলিক বিষয়গুলির তীব্র ঘাটতিতে বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। যারা কোনওক্রমে বেঁচে যাচ্ছেন, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ইউএন হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস একটি প্রতিবেদনে বলছে, গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধের প্রথম ছয় মাসে নিহত ৩৪,৫০০ জনেরও বেশি মানুষের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি ছিল নারী আর শিশুই। সবচেয়ে ছোট শিশুর বয়স ছিল মাত্র একদিন।

আরও পড়ুন- মৃত্যু উপত্যকা গাজা | এত লাশ রাখব কোথায়?

সামগ্রিকভাবে দেখা গিয়েছে, এই যুদ্ধের শিকারদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ শিশু ছিল। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রেণির বয়স পাঁচ থেকে নয় বছরের মধ্যে। তারপরে রয়েছে ১০-১৪ বছর বয়সি এবং তারপরে ৪ বছর বয়সি। সবচেয়ে কনিষ্ঠ শিকার একদিনের এক পুত্রসন্তান এবং সবচেয়ে বয়স্ক ৯৭ বছর বয়সি একজন মহিলা৷ তথ্য বলছে, ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রে, একই আক্রমণে পাঁচ বা তার বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। শুধু ইজরায়েলি হামলা নয়, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির ভুল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ফলেও কিছু মৃত্যু ঘটেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রক বলছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা-ইজরায়েলের যুদ্ধে কমপক্ষে ৪৩,৪৬৯ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১০২,৫৬১ জন আহত হয়েছে।

শিশুর টুকরো দেহ কবর দিয়েছেন বাবা-মা। স্কুলে-হাসপাতালে, শরণার্থী শিবিরে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। যুদ্ধের কোনও নিয়ম মানেনি। গত ২৬ মে রাতে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ইজরায়েলকে দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে সামরিক অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মাত্র দুই দিন পর, ইজরায়েল বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয়স্থলে অস্থায়ী তাঁবুতে প্রায় আটটি ক্ষেপণাস্ত্র ফেলেছিল। এমনটা ইজরায়েল বারেবারেই করেছে। সবকিছুই তো 'ফেয়ার ইন ওয়ার'। তবু প্রশ্ন ওঠে, ইজরায়েলের এই যুদ্ধ আসলে কার বিরুদ্ধে? এত হাজারে হাজারে শিশুর লাশ দিয়ে কোন যুদ্ধ জিততে চাইছে ইজরায়েল?

More Articles