গারদের অন্ধকারে চূড়ান্ত নৃশংসতা, ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে ভারতে বন্দিমৃত্যুর খতিয়ান

গরাদের অন্ধকারের পিছনে মৃত্যুমিছিলের খতিয়ান পেশ করল সরকার। কারণ জেল হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, এবং তার পরেই পশ্চিমবঙ্গ।

 


তামিল সিনেমা 'জয় ভীম’-এর পর্দায় অত্যাচারের দৃশ্যগুলো প্রশ্ন তুলে দেয়, মানুষের প্রতি মানুষের এহেন নৃশংসতা আদৌ সম্ভব? চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ইরুলা জনজাতিভুক্ত রাজাকান্নু নামে এক ব্যক্তিকে। পুলিশ হেফাজতে নানা অত্যাচারের পর নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। রূঢ় বাস্তবের সাহসী আয়না 'জয় ভীম’। আজ এই ছবির কথা বেশি করে মনে হওয়া স্বাভাবিক, কারণ গারদের অন্ধকারের পিছনে মৃত্যুমিছিলের খতিয়ান পেশ করল সরকার। অপশাসনকেই নির্দেশ করছে না যোগী ও মমতার গড়? কারণ জেল হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, এবং তার পরেই পশ্চিমবঙ্গ।

সম্প্রতি লোকসভায় দেশে জেলবন্দির মৃত্যু নিয়ে তথ্য দিল কেন্দ্র। জানানো হয়েছে, গত দু’বছরে ভারতে ৪,৪৮৬ জেলবন্দির মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি জেলবন্দির মৃত্যু হয়েছে যোগীর গড়ে। এরপরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। পরপর ২ বছর শীর্ষে যোগীর রাজ্য।

দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়ছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্বর রাজ্যগুলিতে জেলবন্দির মৃত্যুর সংখ্যা তুলনায় অনেকটাই কম। ২৬ জুলাই জেলবন্দির মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ভারতীয় মুসলিম লিগের সাংসদ আবদুসসামাদ সামাদানি। উত্তরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই জেলবন্দির মৃত্যু নিয়ে লিখিত প্রতিক্রিয়া দেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানান, গত ২ বছরে গোটা দেশে ৪,৪৮৬ জন জেলবন্দির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ২০২০ সালে ৪৫১ জন। এবং ২০২১ সালে ৫০১ জন মারা গিয়েছেন। এরপরেই বাংলা। এখানে ২ বছরে জেলবন্দির মৃত্যুর সংখ্যা ৪৪২। ২০২০ সালে ১৮৫ এবং ২০২১ সালে ২৫৭ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: আজও বাঘের চোখে চোখ রেখে জঙ্গলে পা ফেলেন সুন্দরবনের ‘বাঘ বিধবা’-রা

এরপরেই রয়েছে বিহার। নীতীশ কুমারের রাজ্যে ২০২০ সালে ১৫৯ জন এবং ২০২১ সালে ২৩৭ জন জেলবন্দির মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে জেলবন্দির মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তামিলনাড়ুতে ২০২০ সালে যেখানে ৬৩ জন জেলবন্দির মৃত্যু হয়, ২০২১ সালে তা বেড়ে হয় ১০৯। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে জেলবন্দির মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটা কম। মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা এবং অরুণাচল প্রদেশে ১০-এর কম বন্দিমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গোয়া এবং কর্নাটকেও জেলবন্দির মৃত্যুর সংখ্যা ১০-এর কম।

কেন শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ?

মানবাধিকার কর্মী কিরীটী রায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, "জেলবন্দির মৃত্যু নিয়ে ২০০৫ সালে ভারতে নির্দিষ্ট আইন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জেল হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে বিচারবিভাগীয় ম‍্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে তদন্ত করাতে হবে।‘’ কিরীটি জানাচ্ছেন, দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দিনের পর দিন এই আইন অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। ফলে এই দুই রাজ্যে যে এমন ঘটনা ঘটবে, তা আর বিচিত্র কী!

তবে কারণ শুধু একটাই নয়। উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বন্দিমৃত্যুর আরও অনেক কারণ আছে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। ভেলেকে আরও বলেন, "জেলের পরিকাঠামো ভয়ংকর। যে জায়গায় ১০০ জন বন্দি রাখা উচিত, সেখানে ১০০০ জনকে রাখা হচ্ছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা ঠিকভাবে হয় না।"

মানবাধিকার সংগঠন পিইউডিআরের সঙ্গে যুক্ত প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত জানিয়েছেন, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে জেলের ক্ষেত্রে একটা অভিযোগ খুব বেশি করে আসে, সেটি হলো জেলরক্ষী ও শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীরা নতুন আসা বন্দিদের ওপর প্রবল অত্যাচার করেন। মারধর করেন। পয়সা দিলে সেখানে যাবতীয় সুবিধে পাওয়া যায়। পয়সা না দিলে নির্যাতন ভোগ করতে হয়। তাদের মারা হয়। নানারকম অত্যাচার করা হয়। তিনি আরও বলেন, অন্য রাজ্যে এই প্রবণতা কম। তবে এইরকম ঘটনা বেশি ঘটে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী এমন এক কাহিনি শুনিয়েছেন, যা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। কাহিনিটা তাঁকে বলেছেন তাঁর মক্কেল। সেই মক্কেল মামলায় হেরে যায়, তার সাজা হয়। প্রথমেই তাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাকে বলা হয় নির্দিষ্ট টাকা দিলে সে রাজার হালে থাকবে। না হলে মুশকিল। এরপরই তাকে প্রবল জোরে থাপ্পড় মারা হয়। সেই মক্কেল বলে, টাকা দিতে রাজি হওয়ার পর কেন তাকে মারা হচ্ছে। জবাব আসে, ছোট ট্রেলার দেখানো হলো মাত্র। আশিস জানিয়েছেন, এই ধরনের ঘটনা বিভিন্ন জেলে ঘটে থাকে। তার ওপর জেলের ভেতরের অবস্থা খুব অস্বাস্থ্যকর। ফলে সেখানে বন্দির শরীর খারাপ হওয়া এবং মৃত্যুর হাতছানি অবাক হওয়ার বিষয় নয়।

আইন কমিশনের পর্যবেক্ষণ, জেলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মূলত দুর্বল ও দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রেই। ১৯৮০ সালে সাংবাদিক (পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) অরুণ শৌরী সাতটি রাজ্যে হাজতে মৃত্যুর ৪৫টি ঘটনার তদন্ত করেছিলেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল- নিহতরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল। অনেকের ক্ষেত্রে সেই অর্থে কোনও অভিযোগ ছিল না, থাকলেও তা মামুলি। কিছু ক্ষেত্রে অরুণ দেখেন, নিগ্রহের মাত্রা এতই বেশি যে পুলিশি সাফাইয়ের জায়গাটুকু নেই। মৃত্যুর যে কারণ দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে আছে সাপের ছোবল, হৃদরোগ বা আচমকা অসুস্থতা। কারও ক্ষেত্র রহস্যময় মৃত্যু বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। আত্মহত্যার ধরন? লুঙ্গি, বেল্ট বা পরনের কাপড়ের ফাঁস। বহুতল থেকে ঝাঁপ। এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

লোকসভায় কেন্দ্র গলার শির ফুলিয়ে জানান দিচ্ছে গারদের অন্ধকারে বন্দিমৃত্যু বাড়ছে। এই পরিসংখ্যান কাগজে ঠাঁই পেয়েছি, এর নিরাময়ের ওষুধ কি নেই সরকারের হাতে? সরকার হাত গুটিয়ে না থেকে বাড়াতে পারে মডেল থানার সংখ্যা, যেখানে পুলিশের পুনঃপ্রশিক্ষণ হওয়ার দরকার। আইনের রক্ষকরা যে আইনের ঊর্ধ্বে নন, তা বোঝার জন্য প্রয়োজনবোধ, আর গারদের পিছনে থাকা মানুষগুলোর জন্য প্রয়োজন বিবেক। জেলে যে পথে টাকার চোরা স্রোত বইছে, তা কি আইনরক্ষকদের লজ্জায় ফেলবে না?

More Articles