কৃষক-ক্ষোভের আঁচ! যে যে ভুলে ৩৮টি আসন খোয়াতে হল বিজেপিকে?
Farmer's Protest: কৃষক আন্দোলন যথেষ্ট জনসমর্থনও পেয়েছে। ২৫০টিরও বেশি সংগঠন এই আন্দোলনে সামিল হয়। রাস্তা অবরোধ করে, রেললাইনে শুয়ে পড়ে , ধর্না-মিছিলের মাধ্যমে নানাভাবে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কৃষকরা।
ভারতীয় সংবিধানে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বা ‘রিপাবলিক’ বলে একটি শব্দের উল্লেখ রয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই যেটির কথা সম্ভবত ভুলে যায় মোদি সরকার। ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথার মূল অর্থ - জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার জনগণের স্বার্থে কাজ করতে বাধ্য থাকবে । ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, প্রতিদিন ২ হাজার কৃষক চাষবাসের কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। ১৪ কোটি কৃষক পরিবারের মধ্যে ৮৭% চাষীর মাসিক আয় ১০ হাজার টাকারও কম। ২০১৭ সাল নাগাদ কৃষিবিমা শুরু হয়। কিন্তু বিমার সুবিধে পান মাত্র ১০% কৃষক। ভালো ফসল হলেও কৃষকের আয় বাড়ে না। উৎপাদিত ফসলের বাজার পাইকারি বাজারেও বড় ব্যবসায়ীদের হাতেই থাকে। সার-কীটনাশক, ভর্তুকি, কৃষক অনুদান, সরকারের কোনও সহায়তাই কৃষকদের দুর্দশা মেটাতে পারেনি। এই সকল হতাশা থেকেই কৃষকরা দাবি তোলেন, ভারতের মুখ্য ২৩টি ফসলে নূন্যতম সহায়ক মূল্য বাধ্যতামূলক করার আইন আনা হোক। এর আগে বিরোধীদের বক্তব্যের সুযোগ না দিয়েই বিতর্কিত তিনটি কৃষি বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। যার অর্থ দাঁড়ায়, আইনগুলি নিয়ে সংসদ ভবনে আলোচনাই করা হয়নি। কৃষক সংগঠনগুলির দাবি ছিল, এই বিল কৃষক স্বার্থ বিরোধী। কেন্দ্র সরকার কর্পোরেট সংস্থা ও বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধে পাইয়ে দিতেই এই বিল এনেছিল। সরকারের যুক্তি ছিল কৃষকদের বাজারে সর্বোচ্চ মূল্য পাইয়ে দিতেই নাকি এই আইন। বিজেপি সরকারের প্রভাবে দেশে 'গ্রাম বনাম শহর' ধাঁচের রাজনীতি শুরু হয়েছে। তা বিজেপির জন্য বরং সমস্যা ডেকে এনেছে । দল যে তা বোঝেনি, তা হয়তো নয়। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি করতে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান করেনি বিজেপি সরকার। ২০২৪- র লোকসভা নির্বাচনে তাই কৃষকরা নিজেদের পরিচয়রক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। মোদি সরকারের এই ব্যর্থতার চুল-চেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
এ বার লোকসভা ভোটে গ্রামীণ অঞ্চলে বিজেপির ৪.৫% ভোট কমেছে এবং শহরে ৬.৫% ভোট বেড়েছে। দেশ জুড়ে আসন সংখ্যা ৩০৩ থেকে নেমেছে ২৪০-এ। কৃষক আন্দোলনে যোগদানকারীদের অঞ্চল মিলিয়ে মোট ৩৮টি আসনে হেরেছে বিজেপি। তালিকায় রয়েছে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের একাধিক পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অঞ্চল। ২০১৯ সালে হরিয়ানাতে কৃষক সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ১০টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। ২০২৪ সালে ওই অঞ্চলেরই ৫টি আসন কমে গেছে। পঞ্জাবেরও এমন দুটি আসনে বিজেপি হেরেছে। রাজস্থানে ২০১৯ সালে ২৫টির মধ্যে ২৪টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। এ বার সেখানেই শুধুমাত্র ১৪টি আসনে জয় পায়। মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অঞ্চলে মোট ১৩টি লোকসভা কেন্দ্র ছিল, তার মধ্য ১২টি আসনেই হেরে গিয়েছে বিজেপি। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, যেসব গণআন্দোলন সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে তার মধ্যে একটি কৃষক আন্দোলন। তবুও প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলি রাম মন্দির উদ্বোধনের প্রচারে ঠিক যতটা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল, ঠিক ততটাই কম সচেতনতা দেখিয়েছিল দেশের কৃষক আন্দোলনে।
আরও পড়ুন: কৃষককে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার সময়, নৈতিকতা কোথায় যায়?
দেশে যথেষ্ট খাদ্যশস্য উৎপন্ন হলেও, কৃষিকাজ করে চাষিরা পর্যাপ্ত আয় করতে পারে না। দেশের খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে কৃষিকে অপরিহার্য ক্ষেত্র হিসেবে মান্যতা দেওয়ার পাশাপাশি কৃষকদের পর্যাপ্ত আয়ের রাস্তা খুলে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু সেই পর্যাপ্ত আয়ের রাস্তাই যেন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। এই সকল ব্যর্থতা যে শুধু কৃষকদের নয় তা বুঝিয়ে দিল দেশবাসী। কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে মোদি সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। দেশব্যাপী আন্দোলনের সংগঠন যে মামুলি কথা নয় তা নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর হয়তো বুঝে গিয়েছে বিজেপি। কৃষকদের বঞ্চনার অবসান করতে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পরিমন্ডল। যেই গণতন্ত্র দেশবাসীর চাওয়া-পাওয়ার কথা বলে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ইচ্ছে মত চলছিল। বেশিদিন গণতন্ত্রে ভাগ বসাতে দিল না দেশবাসী। বিতর্কিত তিনটি আইনের মধ্যে একটি আইন - " দ্য এসেনশিয়াল কমোডিটিজ বিল" । কৃষকরা সংগঠনের নেতৃত্বরা বলেছিলেন, এই বিল অনুযায়ী, চাল, ডাল, গম, ভোজ্য তেল, তৈলবীজের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রীর মূল্যনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ঘুরপথে ব্যবসায়ীদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। আরেকটি বিল " দ্য ফার্মার্স এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল" বাস্তবায়িত হলে কৃষকরা নিজেদের জমিতেও ক্রীতদাস হয়ে যাবে বলে দাবি করে তাদের সংগঠন। অন্য আরেকটি বিল "দ্য এসেনশিয়াল কমোডিটিজ বিল" নিয়ে কৃষক সংগঠনগুলির যুক্তি ছিল, উৎপাদিত ফসলের কেনার দায় আর সরকার নিতে চাইছে না। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর কেন্দ্র সরকার শেষ পর্যন্ত আইনগুলি বাতিল করেছিল।
কৃষক আন্দোলন যথেষ্ট জনসমর্থনও পেয়েছে। ২৫০টিরও বেশি সংগঠন এই আন্দোলনে সামিল হয়। রাস্তা অবরোধ করে, রেললাইনে শুয়ে পড়ে , ধর্না-মিছিলের মাধ্যমে নানাভাবে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কৃষকরা। তাঁরা দাবি জানায়, নূন্যতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চিত করতে হবে। কিছু পর্যবেক্ষকের মন্তব্য ছিল, কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি সরকার পূরণ করতে গেলে ফতুর হয়ে যাবে। অন্য দিকে, কিছু পর্যবেক্ষক যুক্তি দিয়েছেন— ক্রাইসিল সংস্থা ষোলোটি শস্যের হিসেব করে দেখেছে, ২১ হাজার কোটি টাকার খরচ হবে। যা কেন্দ্রীয় বাজেটের ০.০৫% ভাগ। ধরা যাক, আরও কিছু খরচ রয়েছে, যেমন— মান্ডির সংখ্যা দেড়গুণ বাড়ানো, মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিমের বরাদ্দ বাড়ানো ইত্যাদি। তা হলে বেশির বেশি সব মিলে কেন্দ্রীয় বাজেটের ১ শতাংশের একটু বেশি হবে।
কৃষক আন্দোলন নিয়ে ঘরে বাইরে চাপের মুখে পড়েছিল মোদি সরকার। সমালোচনায় নেমেছিল সঙ্ঘ পরিবারের কৃষক সংগঠন - ভারতীয় কিসান সঙ্ঘও। তারা দাবি করেছিল, কৃষকরা শান্তিপূর্ণ ভাবে দিল্লি এসে সমস্যার কথা বলতে চাইলেও, সরকার এই বিষয়কে গুরুত্ব দেয়নি। এ থেকেই যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হিংসার রূপ নেবে সে বিষয় আগেই সাবধান করেছিল সঙ্ঘ পরিবারের কৃষক সংগঠন। জড়ো হওয়া কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করতে বারবার কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার, কৃষক নেতাদের আটক, নিরস্ত্র কৃষকদের ওপর গুলিও চালিয়েছে পুলিশ। একদা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, কৃষকদের নাম করে যেমন হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তেমনই কয়েকজন এই আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দাও তুলছেন। সে সময় সঙ্ঘ পরিবারের কৃষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোহিনী মোহন মিশ্র বলেছিলেন, " সরকারের এই মনোভাব, নিন্দার যোগ্য। এই মন্তব্য হিংসার সম্ভবনা বাড়িয়ে দিল।" পরিস্থিতি সামাল দিতে মোদি সরকার শেষ বাজেট চাষিদের প্রাধান্য দিয়েছিল। তাতেও চিঁড়ে ভেজেনি বিজেপির। কৃষকরা ভরসা করতে না পারার অন্যতম কারণ হল, পূর্ববর্তী শর্ত পূরণ করতে পারেনি বিজেপি সরকার। বাজেটে অস্পষ্টতাও বিভ্রান্তি বাড়িয়েছিল।
আরও পড়ুন:যে চড় ভুলবেন না কোনওদিনও! কঙ্গনাকে থাপ্পড় মারা সিআইএসএফ কনস্টেবল আসলে কে?
উল্লেখ্য, এনসিআরবি-র রির্পোট বলছে, ২০১৪- ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ১,০০,৪৭৪ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। যার গড় হিসেব করলে দাঁড়ায়, প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন কৃষকের আত্মহত্যা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, কৃষক আন্দোলনে ৭৫০ জন কৃষক প্রাণ হারালেও প্রধানমন্ত্রী সেই নিয়ে কিছুই বলেননি, বরঞ্চ তাঁদের 'পরজীবী' বলেছিলেন মোদি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কৃষকদের 'দেশদ্রোহী', ;খলিস্তানি', 'সন্ত্রাসবাদী', 'টুকরে টুকরে গ্যাং' বলেছিলেন। সম্প্রতি, কনস্টেবল কুলবিন্দর কৌর কঙ্গনাকে থাপ্পড় মারার পর কঙ্গনা ভিডিও বার্তায় কৃষকদের আবার 'উগ্রবাদী' ও 'সন্ত্রাসবাদী' বলে ফেলেছেন। দেশবাসীকে 'উগ্রবাদী' ও 'সন্ত্রাসবাদী' বললে তাঁরা সেই দলকে ভোট দেবে না সেটাই স্বাভাবিক। একটা সময় মোদির রাজনীতি কৃষকদের বিপন্ন করেছিল, এখন কৃষকেরা মোদিকে বিপন্ন করছে। কৃষকদের ক্ষোভেই কি ৩৮টি আসন খোয়াতে হল না বিজেপিকে? অভিজ্ঞরা বলে থাকেন, কোনো কিছু ঠিক করতে চাইলে, পূর্বে করে ফেলা ভুলকে আগে মেনে নিতে হয়। নিজের দেশের মানুষকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'দেশদ্রোহী', 'খালিস্তানি', 'সন্ত্রাসবাদী' আখ্যা দিয়ে যে অন্যায় করছিলেন, সেই ভুল মেনে নিয়ে কৃষকদের কাছে ক্ষমা চাওয়াই কি তাহলে বিজেপির কাছে একমাত্র রাস্তা? প্রশ্ন থেকেই যায়।