পাওয়া গেল বিরল গ্যাসের ভান্ডার, কতটা উপকার হবে মানবসভ্যতার?
ট্রিটিয়াম দিয়ে তৈরি পরমাণু বোমাকে (Atomic Bomb) পরীক্ষা করে দেখার সময়, যথেচ্ছ পরিমাণে হিলিয়াম-৩ তৈরি হয়ে বাতাসে মেশে।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান ডিয়েগোর ভূবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন বার্নার (Benjamin Birner) পৃথিবীতে হিলিয়াম-৩ (Helium-3) নামের বিরল এক গ্যাসের বিপুল সম্ভারের সন্ধান পেয়েছেন খুব সম্প্রতি। এতদিন পৃথিবীতে এই গ্যাসের সার্বিক পরিমাণ যতটা হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, তার থেকে দশগুণ বেশি পরিমাণে এর সন্ধান পাওয়া গেছে। নেচার জিওসায়েন্স (Nature Geoscience) নামের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সেই গবেষণা।
কিন্তু এই বহুল পরিমাণ হিলিয়াম-৩-এর উৎস কী, তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও অজানা। সভ্যতাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও শক্তির ভান্ডার ক্রমশ ফুরোচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে দেখতে গেলে কয়লা, পেট্রোলিয়ামের মতো অ-পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির (Non-renewable Energy) ভান্ডার তলানিতে ঠেকেছে। হিলিয়াম-৩-কে কিন্তু জ্বালানি ও শক্তির অবিরাম ভান্ডার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বিরল গ্যাসকে ব্যবহার করা যেতে পারে মানবসভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে।
শুধু তাই নয়, বিশ্ব উষ্ণায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, যখন পৃথিবী ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে, তখন কিন্তু দূষণহীন শক্তির উৎস হিসেবে আশা দেখায় হিলিয়াম-৩। কারণ হিলিয়াম-৩-কে জ্বালানি বা শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করলেও, এই গ্যাস থেকে কোনওভাবেই কার্বন বা কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রিন হাউস গ্যাস তৈরি হয় না।
আরও পড়ুন: চাঁদের মাটিতে গাছ, সম্ভব চাষবাসও? অসম্ভবকে সম্ভব করলেন বিজ্ঞানীরা
কিন্তু এযাবৎ হিলিয়াম -৩ আমাদের কাছে প্রায় অধরাই ছিল। কারণ এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল, কেবল মহাজগতে, বিশেষ করে চাঁদে পাওয়া যায় হিলিয়াম-৩। একথা সত্যি যে, মহাকাশে বিপুল পরিমাণে হিলিয়াম-৩-এর মতো দূষণবিহীন শক্তির (Clean Energy) উৎস আছে, কিন্তু তা তো আর সহজে জোগাড় করা সম্ভব নয় মহাকাশ থেকে।
হিলিয়াম-৩, হিলিয়াম গ্যাসেরই একটি আইসোটোপ (Isotope)। দু'টি পরমাণুতে যখন সমান সংখ্যক প্রোটন (Proton) থাকে, কিন্তু তাদের নিউট্রনের (Neutron) সংখ্যা আলাদা হয়, তখন তাদেরকে পরস্পরের আইসোটোপ বলে। কোনও কোনও পরমাণুর মধ্যে প্রাথমিক তিন প্রকার কণা থাকে। আর এই তিনটি কণা হল, প্রোটন (Proton), ইলেকট্রন (Electron), এবং নিউট্রন (Neutron)। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস (Nucleus); আর এখানেই থাকে প্রোটন আর নিউট্রন। ইউরেনিয়াম-৩-এর নিউক্লিয়াস দু'টির মিলন ঘটালে সীমাহীন শক্তির উৎপত্তি হয়। আর সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এতে উপজাত দ্রব্য বা বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ক্ষতিকর নিউট্রনও তৈরি হয় না।
পৃথিবীর প্রতিটি পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র, শক্তি উৎপাদনের জন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিক্রিয়া (Nuclear Reaction) ঘটায়। বর্তমান পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রগুলিতে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে, ইউরেনিয়াম-৩ পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলা হয়, যার ফলে বিপুল পরিমাণে শক্তি তৈরি হয়।নিউক্লিয়াস ভেঙে ফেলার এই পদ্ধতিকে বলে নিউক্লিয়ার ফিশন (Nuclear Fission)। কিন্তু এর ফলে বিপুল শক্তি তৈরি হলেও, সঙ্গে অন্যান্য দূষিত (Radioactive) তেজষ্ক্রিয় পদার্থ তৈরি হয়।
বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে মিলিত করে শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা করেছেন। নিউক্লিয়াসকে মিলিত করার এই পদ্ধতিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন (Nuclear Fusion)। এর ফলে বিপুল পরিমাণ শক্তি তৈরি হলেও কিন্তু দূষিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ তৈরি হয় না। তাই বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস মিলিত করে, শক্তি উৎপাদনের দিকে নজর দিচ্ছেন।
বার্নার এবং তাঁর সহকর্মীরা কিন্তু প্রায় আকস্মিকভাবেই হিলিয়াম-৩-এর সন্ধান পেয়েছেন। হিলিয়াম-৩ খোঁজার কোনও পূর্ব পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। বরং তাঁরা নেমেছিলেন একটি অন্য সমস্যার সমাধানে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বায়ুমণ্ডলে সার্বিকভাবে কতটা হিলিয়াম গ্যাস বেড়েছে, তা পরিমাপ করা। বায়ুমণ্ডলে হিলিয়ামের পরিমাণ সাধারণত বাড়ে ফসিল ফ্যুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির দহনের ফলে।
বার্নার এবং তাঁর গবেষক-সহকর্মীরা সর্বপ্রথম একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন; যেখানে হিলিয়ামের আরেকটি আইসোটোপ, হিলিয়াম-৪-কে (Helium-4) পরীক্ষা করে, মানুষের কার্যকলাপের ফলে বায়ুমণ্ডলে হিলিয়াম গ্যাস কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সম্পর্কে ধারণা করা যাবে। আর এই সেখান থেকেই তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, পৃথিবীতে হিলিয়াম-৩-এর একটি অজানা উৎস রয়েছে।
তবে হিলিয়াম-৩ দূষণমুক্ত শক্তির অসীম উৎস হলেও, তা আদতে পারমাণবিক শক্তি। আদৌ তা বছরের পর বছর ব্যবহার করা যাবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলের বিজ্ঞানীরা সন্দিহান।
সবথেকে বেশি হালকা গ্যাস হল হাইড্রোজেন (Hydrogen), বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন গ্যাস থাকেও সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। আর ওজনের দিক থেকে দ্বিতীয় হালকা গ্যাস হিলিয়াম এবং বায়ুমণ্ডলে মোট পরিমাণের নিরিখে দেখলেও হাইড্রোজেন গ্যাসের পরেই এর অবস্থান।
হিলিয়ামকে বলা হয় নোবেল গ্যাস (Noble Gas), কারণ এরা চট করে অন্য কোনও গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না। তাই এরা দূষক গ্যাস হলেও, ক্ষতিকর বলা যায় না এদের। বায়ুমণ্ডলে যে কোনও পদার্থ স্বাভাবিকের থেকে বেশি পরিমাণে থাকলেই, তাদেরকে দূষক-পদার্থ হিসেবে ধরা হয়। তবে বাতাসে হিলিয়াম গ্যাসের পরিমাণ বলে দেয়, ঠিক কী পরিমানে অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হচ্ছে। আর সেই জন্যই বার্নার ও তাঁর সঙ্গীরা বাতাসে হিলিয়ামের পরিমাণ পরীক্ষা করতে শুরু করেন।
বার্নার বাতাসে এই পরিমাণ হিলিয়াম-৩-এর সন্ধান পেয়ে, এর উৎস নিয়ে সন্দিহান থাকলেও, তিনি জানাচ্ছেন, ট্রিটিয়ামের (Tritium) মতো তেজষ্ক্রিয় পরমাণু থেকে হিলিয়াম-৩ তৈরি হলেও হতে পারে। এবং ট্রিটিয়াম দিয়ে তৈরি পরমাণু বোমাকে (Atomic Bomb) পরীক্ষা করে দেখার সময়, যথেচ্ছ পরিমাণে হিলিয়াম-৩ তৈরি হয়ে বাতাসে মেশে। পাশাপাশি নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রগুলি থেকে হিলিয়াম-৩ তৈরি হয়েও বায়ুমণ্ডলে মিশতে পারে বলে বার্নার আন্দাজ করছেন।