শুয়োরের অঙ্গ প্রতিস্থাপিত হবে মানুষের দেহে! কতখানি নিরাপদ এই পদ্ধতি?
Pig Organ Transplant in Human: অনেক বিজ্ঞানীই মনে করছেন, এই মুহূর্তে শুয়োরই মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য আদর্শ অঙ্গদাতা। কিন্তু শুয়োরের অঙ্গ মানুষের দেহে গেলে মানুষের দেহ এই অঙ্গগুলি গ্রহণ করবে তো?
এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১,০০,০০০-এরও বেশি মানুষের নাম রয়েছে 'ওয়েটিং লিস্টে'। কীসের অপেক্ষা? নতুন হার্ট, কিডনি বা অন্য কোনও অঙ্গের জন্য অপেক্ষা করছেন এই মানুষরা। কোনও দাতা পেলে, যাঁর সঙ্গে অন্য নানা জরুরি মাপকাঠি মিলে যাবে, তবেই অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্ভব। অপেক্ষা করতে করতেই অনেকেই মারা যাবেন, একথা তিক্ত সত্য। এখানেই আশার আলো দেখাচ্ছে শুয়োররা। বিজ্ঞানীরা শুয়োরের দেহ থেকে মানবদেহে কাজ করে এমন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখছেন। এই ধরনের এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির দেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে বলা হয় জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন। সবসময়ই জীবিত বা মস্তিষ্ক-মৃত দাতাদের সংখ্যার চেয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রত্যাশায় বসে থাকা মানুষের সংখ্যা বেশি। ফলে সঠিক সময়ে, সঠিক অঙ্গ পাওয়া যায় না। তালিকা বাড়তে থাকে কেবল। শুয়োরের অঙ্গ মানুষের দেহে বসানো এক্ষেত্রে এমন বিপুল চাহিদার কিছুটা সমাধান ঘটাতে পারে।
বিগত কয়েক বছরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ শুয়োরের বিশেষভাবে সংশোধিত কিডনি, হৃদপিণ্ড এবং লিভার পেয়েছেন। কিন্তু শুয়োরের অঙ্গগুলিকে একজন মানুষের মধ্যে নিরাপদে কাজ করতে দেওয়া এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের প্রথম ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে এখন। বহু গবেষকেরই বিশ্বাস, ধীরে ধীরে শুয়োরের থেকে মানুষের দেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠতে পারে। তবু, প্রশ্ন তো থেকেই যায়। শুয়োরের অঙ্গ মানুষের দেহে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াবে না তো? বেশ কিছু নৈতিকতার প্রশ্নও এখানে উঠে আসে।
আরও পড়ুন- ‘ওগো আমার শুয়োর’! ফরাসিদের বিচিত্র ডাকনামের আজব কিসসা
কেন শুয়োরই ভরসা?
প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে দীর্ঘকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, বিজ্ঞানীরা শুয়োর বা মিনিপিগের উপর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য ভরসা করতে পেরেছেন। শুয়োররা প্রজনন করে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তাদের অঙ্গগুলিও প্রায় সঠিক আকারের এবং রোগজীবাণুও এমন বেশি নেই যা শুয়োর এবং মানুষ দু'জনকেই সংক্রামিত করে। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করছেন, এই মুহূর্তে শুয়োরই মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য আদর্শ অঙ্গদাতা। কিন্তু শুয়োরের অঙ্গ মানুষের দেহে গেলে মানুষের দেহ এই অঙ্গগুলি তাকে গ্রহণ করবে তো? উল্টে আক্রমণ করে বসবে না তো? মানুষের অ্যান্টিবডি শুয়োরের অঙ্গের রক্তনালীতে তিনটি চিনির অণুকে 'ফরেন বডি' মনে করে আক্রমণ করে বসতে পারে। অ্যান্টিবডিগুলি কোষের সঙ্গে লেগে থাকে এবং রক্তের প্রবাহকে বাধা দিয়ে রক্ত জমাট বাঁধায়। সেক্ষেত্রে ১০ মিনিটের মধ্যে, অঙ্গটি গোলাপী থেকে কালো হয়ে যাবে, অর্থাৎ অঙ্গটি মৃত হয়ে যাবে।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য, ইজেনেসিস এবং ইউনাইটেড থেরাপিউটিকসের মতো কোম্পানিগুলি শুয়োরের ডিএনএ পরিবর্তন করতে CRISPR/Cas-ভিত্তিক জিন এডিটিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইজেনেসিস শুয়োরের শর্করার সমস্যাগুলির জন্য দায়ী তিনটি জিনকে ধ্বংস করেছে। কিন্তু মানুষের রোগ প্রতিরোধ সিস্টেমের এখনও 'ফরেন বডি' চিনতে এবং প্রত্যাখ্যান করতে পারে। মানুষের থেকে অন্য মানুষের দেহে প্রতিস্থাপনের জন্য ইমিউনোসপ্রেসেন্ট ওষুধ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেই ওষুধ জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের সমস্যাকে পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারে না।
ইজেনেসিস এবং ইউনাইটেড থেরাপিউটিকস পরবর্তী পর্যায়ের এই সমস্যা মোকাবিলায় সাহায্যের জন্য, শুয়োরের কোষগুলিতে বেশ কয়েকটি মানুষের জিন যুক্ত করেছে। এই জিনগুলি প্রোটিন তৈরি করে যা কোষের দেওয়ালে বসে যায়। যার ফলে শুয়োরের কোষগুলিকে মানুষের মতোই মনে হতে থাকে। ২০২৩ সালে ইজেনেসিস জানায়, শুয়োরের থেকে কিডনি প্রতিস্থাপিত হওয়া ১৫টি সাইনোমলগাস বানরের মধ্যে পাঁচটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে ছিল। পাঁচটি বেবুনের দেহে প্রতিস্থাপিত শুয়োরের হৃৎপিণ্ড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, এই চিকিত্সার ফলে প্রতিস্থাপিত হৃৎপিণ্ড আড়াই বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারে। গবেষকদের আশা, প্রতিস্থাপিত টিস্যুগুলিকে উপেক্ষা করার জন্য অঙ্গ প্রাপকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করা যেতে পারে যাতে দীর্ঘমেয়াদে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।
আরও পড়ুন-কেন পুরুষের চেয়ে বেশি অঙ্গদান করেন মহিলারা? চমকে দেবে এই তথ্য
নৈতিকতার প্রশ্ন
মানুষের মধ্যে, এখন পর্যন্তও বেশ অনেকগুলিই শুয়োরের অঙ্গ প্রতিস্থাপন ঘটেছে। প্রথমদিকে মস্তিষ্ক-মৃত রোগীদের ক্ষেত্রেই অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়, তাই মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও ঝুঁকি ছিল না। এই মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষেত্রে গবেষকরা দেখেছেন, জিন-এডিটেড শুয়োরের হৃৎপিণ্ড ধকধক করতে পারে, লিভার পিত্ত তৈরি করতে পারে এবং কিডনিও কাজ করতে সক্ষম হয়, প্রস্রাব তৈরি হয়। সেখান থেকেই চিকিৎসকরা জীবিত মানুষের দেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দিকে নজর দেন।
নীতিগত ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে এই মানব রোগীদের নির্বাচন করা হবে যাদের দেহে শুয়োরের অঙ্গ প্রতিস্থাপিত হবে? এই পরীক্ষামূলক পদ্ধতির ঝুঁকি সম্পর্কে রোগীদের কীভাবে সচেতন করা হবে? শুয়োরের কিডনি বা হৃদপিণ্ড গ্রহণকারী প্রথম চারজন কয়েক সপ্তাহ বা এক মাসের মধ্যে মারাও গিয়েছিলেন। ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা সেই মৃত্যু থেকেই বুঝতে পারেন প্রতিস্থাপনের আগে ইমিউনোসপ্রেশন শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই আবার প্রশ্ন উঠেছে, মানুষের জীবন ঝুঁকিতে রেখে এমন পরীক্ষা কি করা যায় আদৌ?
শুয়োরের দেহে থাকা ভাইরাস নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। যে মানুষের দেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হবে, সেই অঙ্গপ্রাপকদের এই ভাইরাস সংক্রামিত করতে পারে। এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্বেগের হচ্ছে পোরসিন এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস যা শুয়োরের জিনোমে লুকিয়ে থাকে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পেতে শুয়োরকে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে রাখার কথা ভাবা হয়েছে, তবে শুয়োরের মতো প্রাণীর ক্ষেত্রে বিষয়টা অত সোজাও না। ফলে শুয়োরের অঙ্গ মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সাড়া জাগানো দিশা দেখালেও, তা নিরাপদ করতে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন। তবেই মৃত্যু পথযাত্রী রোগী, নিরাপদে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর অঙ্গের উপর ভরসা করতে পারবেন।