দূরদর্শনে মোদির স্তুতিতে তথ্যচিত্র! ঐতিহ্যের নামে বাদ পড়ল ভারতে প্রকৃত ইতিহাসই?

Doordarshan New India Documentary: ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বাদ পড়ে গিয়েছে দ্রাবিড়, আদিবাসী বা মুসলিমদের প্রভাব।

সম্প্রতি ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষা ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কেন্দ্র সরকার (পড়ুন মোদি সরকার) কতখানি সচেষ্ট তা নিয়ে একখানি তথ্যচিত্র সম্প্রচার করেছে ডিডি নিউজ। সরকারের সম্প্রচার উদ্যোগে সরকারের কীর্তি দেখানো হবে এই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কী দেখানো হবে তা যদি খুব উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক নীতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়, সেক্ষেত্রে কতখানি তা আর ভারতীয় ঐতিহ্য থাকে? প্রশ্ন ওঠেই। এই তথ্যচিত্রটির নাম, 'ধরোহর ভারত কি পুনরুথান কি কাহানি’। ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনরুত্থানের গল্প, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশিষ্ট স্থানগুলিকেই তুলে ধরা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। এই তথ্যচিত্রটি গত সপ্তাহে ৩১ মিনিটের দু'টি পর্বে সম্প্রচারিত হয়েছিল। সিরিজটির সঞ্চালিকা কাম্যা জানি এটিকে 'নতুন ভারতের' সফর হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন যা আখেরে 'ভারতীয় সংস্কৃতির পুনর্গঠনের' সাক্ষী।

কাম্যার কথানুযায়ী, এই তথ্যচিত্রটি বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেবে, আমাদের পূর্বপুরুষ কারা ছিলেন? আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উৎপত্তি কী? স্বাধীনতার হারিয়ে যাওয়া এবং সত্যিকারের নায়ক কারা ছিলেন? দেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি আমাদের গর্ব কীভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে? সত্যিই তো, কীভাবে করা হচ্ছে? কীভাবে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার ঐতিহ্যকে পুনর্গঠিত করছে দেখা যাক।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে আবর্তিত করা হয়েছে। তথ্যচিত্রের প্রথম অংশ চারটি যুগ (বা হিন্দু গ্রন্থে উল্লিখিত যুগ) এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত বর্তমান সময়ের সেই স্থানগুলির গর্ব ও ঐতিহ্য প্রচার করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত ঐতিহাসিক স্থানের সংস্কার বা উন্নয়ন ঘটিয়েছে মোদি সরকার। মূলত গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডেই এই স্থানগুলি রয়েছে।

ভৌগলিক এবং সমাজতাত্ত্বিক পরিধিতে বিশ্লেষণ করতে গিয়েও ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বাদ পড়ে গিয়েছে দ্রাবিড়, আদিবাসী বা মুসলিমদের প্রভাব। সামান্য কিছু উল্লেখ ছাড়া তেমনভাবে আলোচিতই নয় ভারতের দ্রাবিড় সংস্কৃতি, আদিবাসীদের প্রভাব বা মুসলিমদের চর্চা। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে গুজরাতের কচ্ছ জেলার ধোলাভিরা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত এবং ভারতের ৪০ তম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে স্বীকৃত।

আরও পড়ুন- হারাচ্ছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য! ভারতের শেষ গোলাপ জল নির্মাতার কাছে কেন কৃতজ্ঞ থাকবে দেশ?

ধোলাভিরার ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সঞ্চালিকা নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করেন কচ্ছ অঞ্চলকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। বিশেষ করে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদি এই অঞ্চলের জন্য ঠিক কী কী করেছেন তার বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন কাম্যা। সঞ্চালিকা বলছেন, "মানুষজন এই জায়গাটি সম্পর্কে জানত না, তবে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদি কচ্ছ এবং ধোলাভিরার চেহারা পরিবর্তন করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি এটিকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন।”

দ্বিতীয়টি ছিল, করতারপুর সাহিব করিডোর। এই করিডোর দিয়েই তীর্থযাত্রীরা পাকিস্তানে প্রবেশ করে সেই স্থানটি দর্শন করতে পারেন যেখানে গুরু নানক তাঁর জীবনের শেষ ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন এবং গুরু গ্রন্থ সাহেবের কিছু অধ্যায় লিখেছিলেন। কাম্যা জানাচ্ছেন, শিখ সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এই করিডোর খুলে দেওয়ার, বিগত কয়েক দশক ধরে এই দাবি উপেক্ষা করা হয়েছিল।

তথ্যচিত্রটির প্রথম অংশে গুজরাতের সোমনাথ ও পাভাগড় মন্দিরে, মধ্যপ্রদেশের মহাকাল মন্দির, উত্তর প্রদেশের কাশী বিশ্বনাথ ও অযোধ্যা মন্দির এবং উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ মন্দিরে সরকারের সংস্কারের 'মহান' এবং 'বিশ্বমানের' উদ্যোগের পর কী কী সুযোগ সুবিধা মিলেছে তা ফলাও করে বলা হয়েছে। নতুন দিল্লির পুরনো কেল্লার প্রাঙ্গণে জাদুঘরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধার করা মূর্তি এবং প্রত্নবস্তু রাখা রয়েছে।

তথ্যচিত্রে নরেন্দ্র মোদির একটি বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে মোদি বলছেন, "আজ, সরকারি কোষাগার ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য নয়, বরং সুযোগ-সুবিধা এবং উন্নয়নের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে, যাতে ভারতের নাগরিকরা সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন, যা তাদের অধিকার।” অধিকার তো অনেক কিছুই, ঐতিহ্যের প্রসঙ্গে বিশেষ বিশেষ অংশ বাদ পড়ে যাওয়ার (বাদ দিয়ে দেওয়ার বলা যায়) জায়গাতেই বা ভারতীয়দের একাংশ এলেন কীভাবে?

উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথে ২০১৩ সালের বন্যায় ৬,০০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। কাম্যা জানি এই তথ্যচিত্রে বলছেন, "মানুষজন এমনও বলেছিলেন যে এই মন্দির দ্বিতীয়বার আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তবে কেদারনাথ মন্দির বন্যায় অক্ষত থেকে যায়।" সঞ্চালিকা বলছেন, কেদারনাথ মন্দির পুনরুদ্ধারের দাবিগুলি ২০১৩ সালে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং মোদি ক্ষমতায় আসার পরেই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বিজেপির এই দাবি বারবার কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ কংগ্রেস বলে, তৎকালীন ইউপিএ সরকার কেদারনাথের পুনর্নির্মাণের জন্য ৮,০০০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছিল।

আরও পড়ুন- ২০২৪ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম কে? এখন থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় বিজেপি বিরোধীরা

তথ্যচিত্রের দ্বিতীয় অংশে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে যুক্ত স্থানগুলিকে দেখানো হয়েছে। অজ্ঞাত বিপ্লবীদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে তথ্যচিত্রটি। তবে সংগ্রামীদের তালিকায় আছেন মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, সর্দার প্যাটেল, বিআর আম্বেদকর এবং সাভারকারের মতো কয়েকজনই। মহিলারা কেউ নেই, মহিলাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনও ভূমিকাই নেই!

“ইন বলিদানো মে সবসে উপর নাম হ্যায় বীর সাভারকর কা,” আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেল বা কালা পানিতে হাঁটার সময় সঞ্চালিকা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, হিন্দুত্বের রাজনৈতিক মতাদর্শের নেপথ্যে থাকা বিনায়ক দামোদর সাভারকারই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামী। তথ্যচিত্র নির্মাতারা সাভারকার এবং গান্ধীকে সমান্তরাল হিসাবেই দেখেছেন।

তথ্যচিত্রটিতে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ, গুজরাতের সবরমতী আশ্রম এবং স্ট্যাচু অব ইউনিটি, লাল কেল্লার ক্রান্তি মন্দির, জাতীয় যুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, জাতীয় পুলিশ মেমোরিয়াল এবং নয়াদিল্লির সেন্ট্রাল ভিস্তার তাৎপর্যও তুলে ধরা হয়েছে। আদৌ কি ভারতের পুনরুত্থানের কাহিনিই বলছে এই তথ্যচিত্র, না কি স্পষ্টতই দেশে নরেন্দ্র মোদি সরকারের হাত ধরে এক নয়া বিজেপির উত্থানের কাহিনিকে প্রোথিত করা হচ্ছে জনমানসে? সরকারের কীর্তি প্রচারের লক্ষ্যে সিলেবাসে মুঘল পর্ব বাদের মতোই কি বাদ পড়ে যাচ্ছে না 'অন্ত্যজ' উত্থানের কাহিনি, আঞ্চলিক বিদ্রোহ, নারীদের ভূমিকার কাহিনি? প্রশ্ন করার অভ্যাস এখনও তৈরি না হলে, ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে, একপাক্ষিক ইতিহাস অথবা একপাক্ষিক পুনরুত্থান।

More Articles