বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনে পৃথিবীকে বাঁচাবেন? জানেন, কীভাবে উপজাতি নিধন করে চলছে ব্যবসা?

Electric Vehicle Car Battery Hazard: “যদি আর জঙ্গল না থাকে, তাহলে আর হঙ্গানা মানিয়াওয়াও থাকবে না,” সারভাইভালকে জানিয়েছেন উপজাতির একজন ব্যক্তি।

ছোট্ট এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে ঘন জঙ্গল। সেখানে বাস ৩০০ থেকে ৫০০ মানুষের। যেহেতু বিচ্ছিন্ন, তাই সভ্যতার বৃহৎ যজ্ঞে, বা শ্রাদ্ধে এই মানুষদের সরাসরি যোগ নেই। যোগ নেই বলেই বিয়োগ করে ফেলা সহজ। ঠিক সেই পথেই ইন্দোনেশিয়ার এক বিচ্ছিন্ন উপজাতি মুছে যাওয়ার মুখে। এক বিশাল খনি প্রকল্পের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে উপজাতির মানুষরা। আর এই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ফলে সভ্যতার বৃহদংশে কী প্রভাব পড়বে? মানুষ আরও বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ি চড়বে। পরিবেশে কম কার্বন বেরোবে। নবজাতকের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবীর অঙ্গীকার রক্ষার কর্তব্য সমাধা হবে। পরিবেশ বাঁচাতে গিয়ে যদি পরিবেশরই নিবিড় অংশকে মুছে দিতে হয়, ক্ষতি কী? সভ্যতা তো এগোবে! বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরির কাঁচামালের জন্য এই উপজাতির মানুষদের জমি থেকে ধাতু সংগ্রহ চলছে, জানিয়েছে উপজাতীয় অধিকার গোষ্ঠী 'সারভাইভাল'। খনি সংস্থা এবং সরকারকে দোষারোপ করার পাশাপাশি আঙুল উঠছে এলন মাস্কের টেসলার মতো বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থার দিকেও।

বহুজাতিক মাইনিং সংস্থাগুলি ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ হালমাহেরাতে ছিপ ফেলছে, এই দ্বীপ খনিজে ঠাসা। মানুষের সংখ্যা কম। দ্বীপের জঙ্গলে হঙ্গানা মানিয়াওয়া নামে বিচ্ছিন্ন উপজাতির মানুষদের বাস। তাঁদের নিজস্ব ভাষায় হঙ্গানা মানিয়াওয়ার অর্থ 'বনের মানুষ'। ইন্দোনেশিয়ার শেষ যাযাবর শিকারী-সংগ্রাহক উপজাতিদের মধ্যে একটি এই হঙ্গানা মানিয়াওয়া। এই উপজাতিদের মধ্যে কিছু মানুষ বহির্বিশ্বের সঙ্গে কথা বললেও, হঙ্গানা মানিয়াওয়াদের বেশিরভাগ মানুষই যোগাযোগহীন।

আরও পড়ুন- চার চাকার সাইকেল! বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা এই ইলেকট্রিক যান মন কাড়ছে গাড়িপ্রেমীদের

ইন্দোনেশিয়ার এই অংশটিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ নিকেল আকরিকের ভাণ্ডার। বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা এখন তুঙ্গে, আগামী বছরগুলিতে এই চাহিদা আরও বিপুল বাড়বে বলেই আশা করা হচ্ছে। ফলে হালমাহেরাতে খনির কাজ আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে হঙ্গানা মানিয়াওয়া উপজাতির অস্তিত্বটাই বিপদের মুখে পড়বে। “যদি আর জঙ্গল না থাকে, তাহলে আর হঙ্গানা মানিয়াওয়াও থাকবে না,” সারভাইভালকে জানিয়েছেন উপজাতির একজন ব্যক্তি। হঙ্গানা মানিয়াওয়া গোষ্ঠীর এক মহিলা জানিয়েছেন, "আমি ওদের জঙ্গলে হাত দেওয়ার সম্মতি দিচ্ছি না... ওদের বলুন যে আমরা আমাদের জঙ্গল দিতে চাই না।”

ফরাসি খনি সংস্থা ইরামেটের মালিকানাধীন একটি কোম্পানি ওয়েডা বে নিকেল ২০১৯ সালে এই দ্বীপে খননকাজ শুরু করেছিল। তবে এই সময় চাহিদা বাড়ায় খনির প্রচেষ্টা অদূর ভবিষ্যতে বাড়বে বলেই আশা এবং আশঙ্কাও। সারভাইভাল জানিয়েছে, জার্মান রাসায়নিক সংস্থা BASF হলমাহেরাতে একটি শোধনাগার নির্মাণের জন্য ইরামেটের সঙ্গে অংশীদারিত্বের পরিকল্পনা করছে। ফলে হঙ্গানা মানিয়াওয়া অঞ্চলে এই সব সংস্থার অনুপ্রবেশের ফলাফল কী দাঁড়াবে তা অনুমেয় সহজেই৷

জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর মরিয়া প্রচেষ্টায় গত এক দশকে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়েছে। পরিবেশ বাঁচাতে গিয়ে এই সমস্ত 'চটকদার' পণ্যগুলি নিজস্ব পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই সমস্যাগুলির মধ্যেই অন্যতম হচ্ছে, এইসব গাড়ির ব্যাটারি তৈরি করতে ব্যবহৃত ধাতুগুলি, যেমন নিকেল, কোবাল্ট এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে লিথিয়ামের খনন। যেহেতু এই খনিজগুলি পৃথিবীর পৃষ্ঠের নীচে প্রচুর পরিমাণে জমা হয়, সেগুলি খনন করে উদ্ধার করতে গিয়ে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয় এবং হামেশাই আদিবাসীদের জমি দখল করে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- ন্যানোর থেকেও আকারে ছোট, স্বপ্নপূরণ করতে বাজারে আসছে নয়া ইলেকট্রিক গাড়ি, দেখতে কেমন?

আন্তর্জাতিক খনি সংস্থাগুলির পাশাপাশি, বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতারাও এই সমস্যায় জড়িত৷ সারভাইভাল বলছে, টেসলা অর্থাৎ এলন মাস্কের মালিকানাধীন বিশ্বের বৃহত্তম বৈদ্যুতিক যানবাহন সংস্থা, তাদের ব্যাটারির জন্য ইন্দোনেশিয়ার নিকেল এবং কোবাল্ট কেনার লক্ষ্যে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

টেসলার একটি নীতি রয়েছে যে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে সমস্ত উপাদান নিষ্কাশন করা হবে 'আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈধ প্রতিনিধি এবং অবহিত সম্মতির অধিকার অন্তর্ভুক্ত' করেই। সে, বলে তো মানুষ অনেক কিছুই! করে আর কতজন? সারভাইভাল জানাচ্ছে, এই নীতি মেনে চলেনি টেসলা। তারা চিনের কোম্পানি হুয়াইউ কোবাল্ট এবং সিএনজিআর অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালের সঙ্গে চুক্তি করেছে যেগুলির সঙ্গে হালমাহেরাতে নিকেল খনির যোগ রয়েছে৷ হালমাহেরাতে খনন কার্য আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ বলে গণ্য করা যেতে পারে কারণ বিচ্ছিন্ন উপজাতিরা তাদের জমি দখলে বা জমি শোষণে সম্পূর্ণ সম্মতি দিতে পারে না।

বৈদ্যুতিক গাড়ি সংস্থাগুলি গ্রাহকদের পরিবেশ রক্ষার বাণী শোনালেও নেপথ্যে চলবে এই অত্যাচার। গ্রাহকরা জানবেন না, গ্রাহকরা পৃথিবীকে বাঁচানোর দায় সারতে গিয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনেই খুশির ঢেঁকুর তুলবেন।

More Articles