চরম দক্ষিণপন্থী 'নব্য নাৎসি'-দের হাতে চলে যাচ্ছে জার্মানির শাসন ক্ষমতা?
2025 Germany elections: ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর নাগরিকদের ভ্রমণ নথিপত্র হারিয়ে গেলে বা যাঁরা ভিসা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁদের যে সহনশীলতা দেখানো হতো, তা বাতিল করার প্রস্তাব করা হয় বিলে।
গত ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ট্রাম্প। অভিষেক অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণেই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করার ঘোষণা করেন তিনি। বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশ বন্ধ করে দেবেন তিনি। অবৈধ অভিবাসীদের ‘অপরাধী’ হিসেবে বর্ণনা করে ট্রাম্প বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এমন লক্ষ অভিবাসীকে ফেরত পাঠানো হবে।ট্রাম্পের ওই ঘোষণার ঠিক দশ দিন পরে সুদূর জার্মানিতে এমনই একটি অভিবাসী বিরোধী উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। জার্মান সংসদ বিরোধীদের প্রস্তাবিত একটি অভিবাসন সীমিত করার বিল খুব কম ভোটের ব্যবধানে প্রত্যাখ্যান করতে সমর্থ হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি সংসদে বিলটি পেশ করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নেতা ফ্রিডরিখ মেরৎজ। চরম দক্ষিণপন্থী অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) এই বিলকে পুরোপুরি সমর্থন করেছিল।মার্কিন ধনকুবের শিল্পপতি এলন মাস্কের সমর্থনপুষ্ট এএফডি দেশটিতে নব্য নাৎসি এবং কট্টর অভিবাসীবিরোধী দল হিসেবে পরিচিত। ভোটাভুটিতে বিলটি খারিজ হয়ে যাওয়ায় আধুনিক জার্মান ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি আইন পাস হওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল, যা চরম দক্ষিণপন্থীদের সমর্থনের মাধ্যমে হতে পারত।
সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে সমঝোতা নিয়ে দীর্ঘ ও ব্যর্থ আলোচনার পর বিলটি ৩৫০-৩৩৮ ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়, ৫ জন ভোটদানে বিরত ছিল। জার্মানিতে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি অকাল নির্বাচন হতে চলেছে, গত বছর চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের জোট ভেঙে যাওয়ার পর। নির্বাচনী প্রচারে বিরোধী দলনেতা ফ্রিডরিশ মেরৎজ অভিবাসন নিয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপের দাবিকে তার প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে সংসদে অভিবাসন বিরোধী বিল পেশ, নির্বাচনী প্রচারের অংশ। মেরৎজের বিল নিয়ে বিতর্কের সময় জার্মানির বিদেশ মন্ত্রী ও গ্রিন দলের সদস্য আন্নালেনা বেয়ারবক বলেছেন, "আপনার নিজের ঘর পুড়িয়ে দিতে হলে ফায়ারওয়াল ভেঙে ফেলার জন্য ধ্বংসাত্মক বল ব্যবহার করার দরকার নেই। এটাই যথেষ্ট যে আপনি ক্রমাগত গর্ত করে চলেছেন।" বিতর্কে অংশ নিয়ে অনেক সংসদ সদস্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বর্বরতার ঘটনাসহ স্বৈরাচারী অ্যাডলফ হিটলারের জাতিবিদ্বেষী রাজনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অনেক সংসদ সদস্য বিতর্ক করতে গিয়ে জার্মানির আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে অভিবাসীবিদ্বেষী রাজনীতিকে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার অভিলাষ হিসেবে বর্ণনা করেন। জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফ্রেজার আগামী দিনে এএফডির সমর্থনে ফ্রিডরিখ মেরৎজকে আবারও এ ধরনের চেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সিডিইউ ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কেন্দ্র ত্যাগ করেছে’। কী ছিল ফ্রিডরিখ মেরৎজের পেশ করা ওই বিলে?
আরও পড়ুন- মন্ত্রীর পরকীয়া ঠেকাতে মাঠে নেমেছিলেন খোদ হিটলার! ‘ফেক নিউজের’ জনক গোয়েবলস…
বিলটিতে, জার্মানির কঠোর অভিবাসন ও শরণার্থী নীতিবিষয়ক প্রস্তাবে ইউরোপের বাইরে থকে আসা, জার্মানিতে তৃতীয় দেশের নাগরিকদের অবৈধ অনুপ্রবেশ সীমিত করার আহ্বান করা হয়েছিল। সেই অনুসারে অভিবাসন ও শরণার্থী নিয়ন্ত্রণ কঠোর করার লক্ষ্যে বেশ কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করার কথা রয়েছে। যেমন, কোনও সুরক্ষাপ্রাপ্ত শরণার্থী বা অভিবাসীর সঙ্গে পারিবারিক পুনর্মিলনের যে সুযোগ ছিল, তা বন্ধ করার প্রস্তাব রয়েছে। নতুন প্রস্তাবে ইউরোপিয় ইউনিয়নবহির্ভূত দেশগুলোর নাগরিকদের ভ্রমণ নথিপত্র হারিয়ে গেলে বা যাঁরা ভিসা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁদের জন্য যে সহনশীলতা দেখানো হতো, তা বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়। জার্মানির সীমান্তগুলোয় ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের কথাও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়। সংসদে বিলটি পেশ করার আগে, ২৯ জানুয়ারি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ), ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) একটি অ-বাধ্যতামূলক প্রস্তাব পাস করে, যা অভিবাসন নিয়ে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানায়। এই প্রস্তাবকেও পূর্ণ সমর্থন জানায় এএফডি। তবে এই পদক্ষেপটি জনসাধারণ ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। তাঁরা বলেছেন যে, এটি মূলধারার দলগুলি চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাকে আঘাত করবে। এমনকী প্রাক্তন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেল, যিনি অবসর গ্রহণের পর থেকে রাজনীতি নিয়ে খুব কমই মন্তব্য করেন, মেরৎজের সিদ্ধান্তকে 'ভুল' বলে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এএফডির মতো দলটির কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে এ ধরনের প্রস্তাব পাসের জন্য নিজের দল সিডিইউ-র বর্তমান নেতা ফ্রিডরিখ মেরৎজের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
সংসদে পাশ করতে না পারলেও ফ্রিডরিখ মেরৎজ যে পিছু হটবেন না, তা তিনি ঘোষণা করেছেন। তাই প্রতিদিনই জার্মানির বিভিন্ন শহরে অভিবাসী বিরোধী পদক্ষেপের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। হাজার হাজার প্রতিবাদী বার্লিনে মেরৎজের সিডিইউ সদর দফতরের বাইরে জড়ো হয়েছেন। জার্মানির উত্তরের কিল শহর থেকে দক্ষিণের ফ্রাইবুর্গ শহর পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। জার্মানির বেশ কয়েকটি রাজ্যের রাজধানীতে সিডিইওর দফতরের সামনে জড়ো হয়ে অনেক মানুষকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। মিউনিখে দলটির সদর দফতরের সামনে প্রায় সাত হাজার মানুষ বিক্ষোভ দেখান। এছাড়া কিয়ল শহরে প্রায় ২ হাজার মানুষ, মাইঞ্জ শহরে ৪ হাজার, ডুসেলডর্ফে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ ও ফ্রাইবুর্গ শহরে ১০ হাজার মানুষ বিক্ষোভ দেখান।
আরও পড়ুন- এক চিঠিতে দেশ ধ্বংসের পরিকল্পনা! যেভাবে হিটলারের হাত থেকে জার্মানিকে বাঁচালেন তাঁর মন্ত্রী
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই জার্মানির আসন্ন নির্বাচনেও অন্যতম প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে অভিবাসী সমস্যা। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। মূলত, চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের নেতৃত্বাধীন তিন-দলীয় জোট সরকারের ভাঙনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জোটের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বাজেট ও অর্থনৈতিক নীতিমালা নিয়ে মতবিরোধের কারণে এই ভাঙন ঘটে। ফলে, চ্যান্সেলর শোলৎজ ৬ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টির (এফডিপি) সভাপতি ও অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনারকে বরখাস্ত করেন, যা জোটের পতন ত্বরান্বিত করে।অভিবাসন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং চরম দক্ষিণপন্থী প্রভাবের মতো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের সময়ে এই নির্বাচন সমাগত। এই নির্বাচনের ফলাফল জার্মানির রাজনৈতিক পটভূমিকে নতুন আকার দিতে পারে এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। আসন্ন নির্বাচন শুধু নতুন সরকার নির্বাচনের জন্য নয়; এটি জার্মানির ভবিষ্যত দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত।
দেশ কি অন্তর্ভুক্তি এবং প্রগতিশীল নীতির ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ বজায় রাখবে, না কি এটি আরও সীমাবদ্ধ এবং রক্ষণশীল পদ্ধতির দিকে সরে যাবে? ফলাফলগুলি ইউরোপিয় ইউনিয়নের জন্যও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে কারণ, জার্মানি অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক শাসনের মতো বিষয়গুলিতে ইউরোপিয় ইউনিয়নের নীতিগুলি গঠনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কঠোর অভিবাসন নীতি কার্যকর করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন, আগামী দিনে জার্মানিও কি সেই একই পথে হাঁটবে? ২৩ ফেব্রুয়ারি জার্মানির নির্বাচন দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে উঠতে চলেছে। গভীরভাবে মেরুকৃত বিতর্কের পাশাপাশি ফলাফল শুধুমাত্র জার্মান রাজনীতির ভবিষ্যতই নয়, বৈশ্বিক মঞ্চে এর ভূমিকাও নির্ধারণ করবে। মূল প্রশ্ন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চরম দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতা দখলের মতোই কি জার্মানি চলে যাবে দক্ষিণপন্থী ও চরম দক্ষিণপন্থী 'নব্য নাৎসি' দের হাতে? প্রবণতা অনেকটাই সেইরকম। যা প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক সমাজের সামনে এক অশনি সংকেত। সম্প্রতি, ১৯৫০-এর দশকে হিটলারের অভিজাত আধা-সামরিক বাহিনী এসএস-এর ব্রিগেডফুহরার এবং নাৎসি রাইখস্ট্যাগের সদস্য অ্যান্টন রেইনথালার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত চরম দক্ষিণপন্থী ফ্রিডম পার্টি (এফপিও) অস্ট্রিয়ায় ক্ষমতা দখল করেছে।