এক্সিট পোল ও শেয়ার বাজার: যে মহা কেলেঙ্কারি ঘটালেন মোদি-শাহ
Exit Poll Share Market Scam: ৩০ লক্ষ কোটি টাকার এই ধস ভারতের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় ইনিংস শুরু হল দুটো বড় মাপের দুর্নীতির ঘটনা দিয়ে। প্রথমটি হলো হবু চিকিৎসকদের পরীক্ষা NEET নিয়ে পর্বত প্রমাণ দুর্নীতি। বিষয়টি ইতিমধ্যেই আলোচিত ও আদালতের হস্তক্ষেপের পর সরকার বাধ্য হয়েছে আংশিক পদক্ষেপ করতে। কিন্তু দ্বিতীয় দুর্নীতির ঘটনাটি যাকে আমরা 'এক্সিট পোল- শেয়ার বাজার মহা ঘোটালা' বলে চিহ্নিত করছি, তাকে সচেতনভাবেই আড়াল করার চেষ্টা চলছে। এই আড়াল করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে কর্পোরেট মিডিয়া। তা শুধু নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি সহ বিজেপির প্রতি মিডিয়ার প্রশ্নহীন আনুগত্যের কারণে নয়, বড় কারণ হলো এই শেয়ার কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে কর্পোরেট মিডিয়া সমান অংশীদারের ভূমিকা পালন করেছে। মনে রাখতে হবে, শুধু ভোটবাক্স খুলতেই বাজার থেকে ৩০ লক্ষ কোটি টাকার উধাও হওয়ার গল্প এটা নয়, একই সঙ্গে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে দাবি করা একটা দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থার উপর কুৎসিত আক্রমণ এটি। মোদি জমানার প্রথম দু'টি পর্বে আমরা সরকার পরিকল্পিত একাধিক বড় দুর্নীতির ঘটনা দেখেছি। রাফাল কেলেঙ্কারি, নোটবাতিল থেকে শুরু করে ভারতের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারি ইলেক্টোরাল বন্ড। এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হয় ধারে-ভারে এই দুর্নীতির ঘটনাটিও কম নয়। প্রধান বিরোধীদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা রাহুল গান্ধি এই কেলেঙ্কারির তদন্তের জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবি জানিয়েছেন। বাস্তবিক এই দাবিটিকে সমর্থন না জানিয়ে কোনও উপায় নেই কারণ আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তের জন্য দেশে যে সমস্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা রয়েছে তারা বহু দিন ধরেই 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস'-এর ভূমিকা পালন করছে। এই শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো লোকসভা নির্বাচনের এক্সিট পোলের ফলাফল এই কেলেঙ্কারির ট্রিগার হিসাবে কাজ করেছে। তাই শেয়ার বাজারের ওঠানামা, এক্সিট পোল এবং সেই ফলাফল সম্প্রচারকারী চ্যানেলগুলোর ভূমিকা এবং রাজনৈতিক নেতাদের এই দীর্ঘ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কাজকর্মকে আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
শেয়ার কেলেঙ্কারির শুরুটা কিন্তু এক্সিট পোল প্রকাশের দিন থেকে শুরু হয়নি। প্রস্তুতি তার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করতে সক্রিয় হয়েছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। একটি টিভি চ্যানেলে (চ্যানেলটির মালিক আদানি গোষ্ঠী যাদের বিরুদ্ধে সেবি শেয়ার কারচুপির তদন্ত করছে) দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন ৪ তারিখে শেয়ার বাজার সব রেকর্ড ভেঙে দেবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোনও রাখঢাক না রেখে সোজাসাপ্টা বলেন, আপনারা প্রচুর শেয়ার কিনুন, ৪ তারিখে প্রচুর লাভ পাবেন।
আরও পড়ুন- দুর্ঘটনার আতুরঘর ট্রেন! শিউরে উঠবেন গত দু’বছরের রেল দুর্ঘটনার খতিয়ান জানলে
নির্বাচন চলাকালীন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিনিয়োগ পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করছেন। এই ঘটনা ভারতের ইতিহাসে শুধু অভূতপূর্ব নয়, একইসঙ্গে তা চূড়ান্ত অনৈতিক ও ষড়যন্ত্রমূলক। এখানে স্বাভাবিক প্রশ্নটি হলো ৪ তারিখে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসছে, এই কথাটি জনগণকে বিশ্বাস করানো এবং বিনিয়োগকারীদের নিশ্চিত করার খেলার পেছনে কারা কারা ছিলেন? টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত সাক্ষাৎকারগুলো আর শুধু নির্বাচনী প্রচার হিসাবে থাকল না, এর সঙ্গে বেআইনি আর্থিক লেনদেনের প্রশ্নটিও জড়িয়ে গেল।
শেয়ার মার্কেটের জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের প্রথম চোখ ফেরাতে হবে ৩১ মে (২০২৪) দিনটিতে। সেদিন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারের কেনাবেচার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। অনেকে বলছেন কোনও একটি বিশেষ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শেয়ার বাজার হঠাৎ করে তেজি হতে পারে বা তাতে ধস নামতে পারে। এর আগে বেচাকেনা দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার ইতিহাস পাচ্ছি ২০১৪ সালের ১৬ মে, যেদিন নরেন্দ্র মোদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এবারের ৩১ মে সব অর্থেই ছিল এক সাধারণ দিন। সেদিন কোনও নির্বাচন ছিল না (নির্বাচনের শেষ দিন ছিল ১ জুন), এমনকী এক্সিট পোলের ফলাফলও সেদিন প্রকাশিত হয়নি। তাহলে কারা সেদিন এত বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচা করলেন! নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া অসম্ভব হলেও এ কথা আমাদের সবার জানা যে, ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বিনিয়োগকারীদের শ্রেণিবিন্যাস প্রকাশ করে যেমন রিটেল ইনভেস্টর (আম জনতা), দেশিয় মিউচুয়াল ফান্ড না কি বিদেশি বিনিয়োগকারী। ৩১ মে-এর কেনাবেচার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ৫৮% শেয়ার কিনেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এটা আশ্চর্যের কারণ, তার আগের এক সপ্তাহ ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার খুব সামান্য পরিমাণ কিনছিলেন বরং বিক্রি করছিলেন বেশি। সেটাই স্বাভাবিক কারণ ভারতে দীর্ঘ নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে, ফলে ক্ষমতায় কারা আসবে তা অনিশ্চিত। তাহলে প্রশ্নটা হলো ৩১ মে কী এমন তথ্য এল যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রচুর পরিমাণ শেয়ার কিনতে শুরু করলেন? এক্সিট পোলের ফলাফল প্রকাশ হতে তখনও ৩০ ঘণ্টা দেরি। এই রহস্যের উন্মোচন হতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি।
খেলা শুরু হলো ১ জুন (শনিবার,সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে) যখন দেশের সমস্ত নিউজ চ্যানেল বিভিন্ন এজেন্সির এক্সিট পোলের ফলাফল প্রকাশ করতে লাগল। দেখা গেল, চ্যানেল বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও এবং এজেন্সি আলাদা হওয়ার পরেও সমস্ত এক্সিট পোলের ফলাফল একইরকম। প্রত্যেকের পূর্বাভাস, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় ফিরছে এবং বিরোধী ইন্ডিয়া জোট খুব খারাপ ফল করছে। এমনভাবে মিডিয়ায় গোটা আলোচনা উপস্থিত করা হয় যাতে যেকোনও সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে ফলাফল ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, ৪ জুন গণনা নেহাতই করতে হয় বলে করা। এই ফলের নমুনাটা দেখে নেওয়া যেতে পারে:
ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া (এনডিএ ৩৬১-৪০১),
টুডে'স চাণক্য (এনডিএ ৪০০),
নিউজ ১৮ মেগা এক্সিট পোল (এনডিএ ৩৭০),
রিপাবলিক টিভি-পি মার্ক (এনডিএ ৩৫৯)
একটু নজর করলেই বোঝা যাবে যে রাজ্যওয়াড়ি এনডিএ কত আসন পাবে সেটা নিয়ে তারতম্য থাকলেও চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে তা পূর্ব নির্ধারিত। এই চূড়ান্ত ফলে পৌঁছনোর লক্ষ্যে এবার বহু চ্যানেল একটি রাজ্যে যতগুলো আসন রয়েছে, তার থেকেও বেশি আসন দেখিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়, সন্ধেবেলায় একটি বাদে সমস্ত চ্যানেল বিজেপির আসন তৃণমূলের চেয়ে অনেক বেশি দেখায় কিন্তু পরের দিন সকালে দেখা যায়, একমাত্র যে চ্যানেলটি তৃণমূল কংগ্রেসকে এগিয়ে রেখেছিল, তারাও তাদের পূর্ববর্তী ফল সংশোধন করে বিজেপিকে এগিয়ে রেখেছে। স্যাম্পল সাইজ, প্রযুক্তি, মানুষের প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা প্রভৃতি কারণে এক্সিট পোলের ফল না মেলা কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এবার কর্পোরেট মিডিয়া ও এজেন্সিগুলো যা করেছে তা আসলে এক পরিকল্পিত ফলাফল যা শাসক দলের নির্দেশে তৈরি হয়েছিল। প্রথমে মোদি-শাহের আশ্বাসবাণী ও পরে এক্সিট পোলের ফলাফল দেখা গেল সোমবার (৩ জুন)। শেয়ার কেনাবেচার হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ইকুইটি কিনেছে ৬,৮৫১ কোটি টাকার এবং ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ইকুইটি কিনেছে ১,৯১৪ কোটি টাকার। শেয়ার বাজার তখন সব অর্থেই রেকর্ড করেছে।
আরও পড়ুন- চরম ব্যর্থ রাম মন্দিরের ম্যাজিক! কেন একে একে বন্ধ হচ্ছে অযোধ্যার বিমান?
গণনা প্রক্রিয়া শুরু হতেই (৪ জুন) খেলা উল্টোদিকে ঘুরে গেল। সমস্ত এক্সিট পোলের ফলাফলকে মিথ্যা প্রমাণ করে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারে কাছেও গেল না বরং স্পষ্ট হয়ে উঠল দিল্লিতে এক কোয়ালিশন সরকার তৈরি হতে চলেছে। শেয়ার বাজারে ধস নামল। ৩০ লক্ষ কোটি টাকার এই ধস ভারতের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ততক্ষণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে ফেলেছে এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো রিটেল ইনভেস্টর বা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর এই গোটা প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ লাভ করল ফাটকাবাজের দল, শেয়ার বাজারে যাকে আমরা 'derivatives investors' বলে জানি। সোজা কথাটি হলো, যদি এক্সিট পোল বিজেপির এই বিপুল জয়ের গল্প বাজারে না ছাড়ত তাহলে ৩ জুন সেনসেক্সের রকেটগতি উত্থান ও ৪ জুন সর্বোচ্চ পতন ঘটত না।
এই ঘটনাপর্ব অনেকগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে উপস্থিত করে যা ইতিমধ্যেই কংগ্রেস সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সামনে এনেছে।
১) ৩১ মে যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথম কোটি কোটি টাকার শেয়ার কিনতে শুরু করেন তাদের পরিচয় কী?
২) এক্সিট পোলের ফলাফল কি তাদের কাছে আগাম পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা প্রচুর মুনাফা করতে পারেন?
৩) এই গোটা বিষয়টাতে এক্সিট পোল যে এজেন্সিগুলো করেছিল এবং যেসব নিউজ চ্যানেল সেগুলো সম্প্রচার করেছিল তাদের ভূমিকা কী?
৪) বিনিয়োগকারীরা কাদের হয়ে বিনিয়োগ করতে নেমেছিলেন?
৫) এই শেয়ার বাজার ধসের ক্ষেত্রে কি কোনও আইনি ব্যবস্থা বা তদন্তের সুযোগ রয়েছে?
এতক্ষণ যে কেলেঙ্কারির কথা আমরা আলোচনা করলাম তা নিয়ে তদন্তের সুযোগ ভারতের আইনে স্পষ্ট। এক্ষেত্রে সেবি (prohibition of fraudulent and unfair trade practices relating to securities market) রেগুলেশন ২০০৩ এবং সেবি (prohibition of insider trading) রেগুলেশন ২০১৫-তে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করা, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ইকুইটি কেনা বেচা করা, ভুয়ো সংবাদ প্রচার করে মুনাফার চেষ্টা এবং ইনসাইডার ট্রেডিং করা শাস্তিযোগ্য অর্থনৈতিক অপরাধ। আবার জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী নির্বাচন প্রক্রিয়ায়কে অসাধু উপায়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা অপরাধ। কিন্তু সমস্যা হলো মোদি জমানায় এই বিতর্কে সেবি ও নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর তদানীন্তন অস্ট্রিয়ার তৎকালীন চ্যান্সেলর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি নির্বাচনের আগে ওপিনিয়ন পোলকে নিজের পক্ষে আনেন ও মিডিয়াকে জোরপূর্বক তা প্রচার করতে বাধ্য করেন। এই অপরাধ সেদেশের আদালতে প্রমাণিত হয়। সংসদের ভেতরে ও বাইরে এক্সিট পোল-শেয়ার মার্কেটে কেলেঙ্কারির সঠিক তদন্তের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে এখনই।