ক্ষুধার প্রশ্নে পাকিস্তান-বাংলাদেশের চেয়েও পিছনে, কেন সত্যিটা মানতে চাইছে না ভারত
Global Hunger Index: বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১টি দেশের তালিকায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের অবস্থান নেমেছে ১০৭-এ।
'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি!' দিন বদলেছে। সময় পরিবর্তিত হয়েছে ক্রমশ। আধুনিক হয়েছে বিশ্ব। আধুনিক হয়েছে মানুষ! কিন্তু ক্ষুধার রাজ্য কি বদলেছে আজও? ঝলসানো রুটিও জুটছে সবার? সদ্য পালিত হওয়া বিশ্ব খাদ্য দিবসে এই প্রশ্ন ওঠা বোধহয় স্বাভাবিক।
অনেকেই হয়তো বলবেন, বদলায়নি! এ-বছরও বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের রিপোর্ট দেখেছে এদেশও। সকলেই ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন ভারতের ক্ষুধা-অবস্থান। ১২১টি দেশের তালিকায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের অবস্থান নেমেছে ১০৭-এ। ২০২০ সালের চেয়েও যে স্থান পিছিয়েছে আরও। ১০১ থেকে নেমেছে ১০৭-এ। যেখানে এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা। তাদের স্থান যথাক্রমে ৯৯, ৬৪ এবং ৬৪ নম্বরে।
তাহলে, এই দশা কেন ভারতের? অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বড় বড় স্বপ্ন দেখিয়ে হিন্দু-মুসলমানের অশান্তির দাবদাহে আসলে বিজেপি সরকার পারেনি দেশের বদল করতে। যার ফলেই আজ এই পরিণতি। ১৬ অক্টোবর ছিল বিশ্ব খাদ্য দিবস। অক্টোবরের এই দিনটিকে প্রত্যেক বার বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করে প্রায় সব দেশ। যা ঘোষণা করেছিল রাষ্ট্রসংঘ। কিন্তু কেন?
আরও পড়ুন: আজও নরবলি! কেরলের বীভৎসতায় এক অন্ধকার জগতের খোঁজ
বিশ্ব খাদ্য দিবস
১৯৪৫ সাল। রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংক্রান্ত সংস্থা তৈরি হল। আর এই সৃষ্টির মধ্যেই বীজ বপিত হয়েছিল বিশ্ব খাদ্য দিবসের বা এই সংক্রান্ত সংস্থার। মূলত, ৮০ দশক থেকে থেকে বলা হয়, অক্টোবরের ১৬ তারিখ বিশ্বজুড়ে পালিত হলো খাদ্য দিবস। যা বহরে বাড়ে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক কৃষি অর্থভান্ডারের মতো সংগঠনের হাত ধরে। যেখানে দেখা যায়, খাদ্য নিয়ে কাজ করে ২০২০ সাল নাগাদ শান্তিতে নোবেল পায় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা।
১৯৭৯ সাল থেকে এই দিবস পালনের ইতিহাস জোরালো হয়। হাঙ্গেরির সচলতায় বিশ্ব খাদ্য দিবস সংক্রান্ত কমিটির উদ্যোগে এর বাড়বাড়ন্ত যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একাধিক দেশ, দারিদ্র্য, খাদ্যের সংকটের কথা মাথায় রেখে প্রায় ১৫০টি দেশেই পালন হতে থাকে এই দিনটি।
থিম ভাবনার প্রচলন
১৯৮১ সালে বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হয় নির্দিষ্ট থিমের উপর দাঁড়িয়ে। যে থিমের সঙ্গেই থাকে বিশেষ মুদ্রার বিষয়টি। যেখানে একাধিক দেশের তরফেও বিশেষ মুদ্রার মাধ্যমে সম্মান জানানো হয় এই দিবসকে। যেমন আফগানিস্তানের তরফে ১৯৮১ সালের প্রথম খাদ্য দিবসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় বিশেষ মুদ্রার মাধ্যমে।
১৯৮১ এবং ১৯৮২ সালে এর থিম ছিল; প্রথম আসবে খাদ্য। ফুডস কামস ফার্স্ট। এরপর ১৯৮৩ নাগাদ খাদ্য নিরাপত্তা। ১৯৮৪ সালে কৃষিতে মহিলা। ১৯৮৫ গ্রাম্য দারিদ্র্য। এরপর প্রায় প্রত্যেক বছরই পরিবর্তন হয়েছে থিম। ২০০৭ এ এসে খাদ্যের অধিকার। ২০১৯ সালে; আমাদের পদক্ষেপ আমাদের ভবিষ্যত, শূন্য ক্ষুধার্ত পৃথিবীর জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার। আর ২০২২ এর থিম: প্রত্যাখান নয় কাউকে! এখানেও আসলে খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত বা প্রত্যাখ্যানের কথা বলা হয়েছে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত
বিশ্ব খাদ্য দিবস এবং ক্ষুধার সূচকের সম্পর্কে খানিকটা তফাৎ থাকলেও সামগ্রিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অনেকেই বলেন, খাদ্যের অভাব অথবা খাদ্য-জোগান নেই বলেই তো ক্ষুধা! যেখানে ভারতের তুলনায় খানিকটা এগিয়ে পাকিস্তান। আরও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি সদ্য নানা অর্থনৈতিক সংকটের পরেও ভারতের চেয়ে এগিয়ে শ্রীলঙ্কা! সেখানে দাঁড়িয়ে এই দশা ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতের!
শুক্রবার প্রকাশিত হয় গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-এর রিপোর্ট। প্রায় দু'বছর পর প্রকাশিত ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, সামগ্রিক দিক বিচার করে ভারতের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স স্কোর বা নম্বর জুটেছে ২৯.১। যা ২০০০ সালে ছিল ৩৮.৮ এবং ২০১৪ সালে ছিল ২৮.২। এই নম্বরের ক্ষেত্রেও ক্রমশ অবনমন হয়েছে দেশের। রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ৮ বছরে নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে ক্ষুধার ক্ষেত্রে আরও খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি। যা করোনা-কালের পরিস্থিতিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে ফের। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬.৩ শতাংশ মানুষ এই ক্ষুধার অভাবে ভুগছেন, বলছে ওই রিপোর্ট। যা ২০১৪ সালেও ছিল ১৪ শতাংশের কাছে।
অভুক্ত ভারত
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ২ শতাংশ মানুষের ক্ষুধার কষ্ট বেড়েছে। বলা হচ্ছে, দেশের প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১৯.৪০ কোটির আশেপাশে মানুষ না খেয়ে থাকেন। অথবা অর্ধ-অভুক্ত থাকেন রোজ। সার্বিকভাবে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে এই সময়কালে, বলছে ওই রিপোর্ট।
শিশুদের অবস্থান
এখনও প্রায় ১০ কোটির বেশি শিশু সঠিক পুষ্টি পায় না এদেশে। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কয়েক কোটি শৈশব। শুধু জন্ম নেওয়া অপুষ্ট শিশু নয়, দেখা যাচ্ছে, দেশে মাতৃগর্ভেই অপুষ্ট শিশুর পরিসংখ্যানও চিন্তা বাড়িয়েছে। এই প্রসঙ্গে দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বলেন, 'দেশের প্রায় ১৯.৩ শতাংশ শিশু অভুক্ত। ৩৫.৫ শতাংশ শিশু সঠিক খাবার বা পুষ্টি পাচ্ছে না। আর সরকার হিন্দুত্বের কথা বলছে।'
এই প্রসঙ্গেই চিদাম্বরম এই রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, দেশের ১৬.৩ শতাংশ জনগণ খাদ্যের সমস্যায় ভুগছেন। যা ২০১৪ সালেও ছিল ১৪ শতাংশের কাছে। মোদীর সময়ে বেড়েছে। এমনকি খাদ্যের নিরাপত্তাও কমেছে সর্বাধিক।
খাদ্য-অভাবে জনতার অবস্থান
এ দেশেরই অর্থাৎ কেন্দ্রীয় খাদ্য ও গণবন্টন বিভাগের একটি তথ্য বলছে, ভারতের একজন মানুষ গড়ে প্রতি দিন ১৩৭ গ্রাম খাবার নষ্ট করেন। ওই তথ্যেই আরও বলা হচ্ছে, ভারতের মোট খাদ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ খাবার নষ্ট নয় গড়ে। যার এক বছরের পরিমাণের অর্থমূল্য ধরলে হিসেব দাঁড়ায় ৯২ হাজার কোটি টাকার আশেপাশে। আবার বিশ্বের এক হিসেবও বলছে ভয়াবহ তথ্য। জানা যায়, পৃথিবীর মোট খাদ্যের তিন ভাগের এক ভাগ নষ্ট হয় প্রতি বছর! যা থাকলে আন্দাজ করা যায়, প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের খাবারের জোগান দিতে পারত।
ক্ষুধা সংকটে ভয়াবহ অবস্থানে কারা
ইয়েমেন; বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে সর্বপ্রথম এই দেশ। ২০১৪ এর যুদ্ধের পর যে দেশের অবস্থান আরও খারাপ হয়েছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী এই দেশের প্রাপ্ত নম্বর ৪৫.১। যা দেশটির সার্বিক খাদ্যের যোগান, খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংকটের। ইয়েমেনের পরিস্থিতি বিশ্বে অত্যন্ত খারাপ। আর দারিদ্র্যে এগিয়ে সোমালিয়া!
এর পরেই রয়েছে মধ্য আফ্রিকান রিপাবলিক। তারপর মাদাগাস্কার। ডেমোক্রেটিক কঙ্গো, চাদ, হাইতির মতো দেশ রয়েছে পরপর। যা রাষ্ট্রসংঘের কাছে চিন্তার। এই সমস্ত দেশে ক্ষুধার বিপদ এতটাই বেশি যে চড়া দামে কিনতে হয় খাদ্য সামগ্রী। সামান্য পানীয় জলের অভাবেই মৃত্যু হয় বহু মানুষের। অপুষ্ট শিশুর অবস্থা, মৃত্যু তো লেগেই রয়েছে। যা যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরিতে বাড়ছে ক্রমশ। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে একাধিক দেশের জরুরি অবস্থাও বাড়িয়েছে সংকট।
খাদ্যসংকট বিশ্বজুড়ে আসন্ন?
বলা হচ্ছে, ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে প্রায় ৮২টি দেশের ৩৪৫ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের সংকটে ভুগছেন বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তরফেই এই আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। আবার বলা হয়, এই মুহূর্তে ভারত শুধু নয় বিশ্বের প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষের অবস্থা, তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা নেই। আর্থিক অবস্থাও বেশ করুন। করোনা-পরবর্তীকালে এই অবস্থার হার বৃদ্ধি হয়েছে। আরও দরিদ্র হয়েছে মানুষ।
দারিদ্রে ভারত
করোনাকালের পর আবার দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে এমন দাবি উঠলেও। খাদ্যের অভাবে, খিদে নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার সংখ্যা কমেনি। বরং কমার বদলে বেড়েছে উত্তরোত্তর। কারণ, পরিসংখ্যানে এর হার কমলেও আদতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনীতির বিকাশ, শিক্ষা, উন্নয়নের প্রেক্ষিতে কমেছে সবটা। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা ভয়াবহ। এখানে কোটি কোটি মানুষের মাথাপিছু দৈনিক আয় এখনও মাত্র ২.১৫ ডলারের কম। ১৮২ মিলিয়ন মানুষ কাজ করেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাঁদের দৈনিক আয় ৩.৬৫ ডলারের আশেপাশে। বলা হচ্ছে, ৭০ মিলিয়নের বেশি মানুষ সর্বাধিক দারিদ্যের সমস্ত চিন্তা নিয়ে এখনও ঘুমোতে যান রোজ।
দারিদ্রে কোনও কালেই খারাপ করেনি ভারত। ২০০৩ সালের একটি তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার ৫৩৪ মিলিয়ন মানুষের দৈনিক আয় ১ ডলার। আর তাদের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন শুধু ভারতেরই। সুরেশ তেন্ডুলকর কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ওই সময় প্রায় ৩৭.২ শতাংশের বেশি মানুষ কঠিন দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করেন এই দেশে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্যের হার কমেছে দেশে। সম্প্রতি ৬ শতাংশ, প্রায় ৮৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা দরিদ্র, একথা বলা হয়েছে একটি রিপোর্টে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার উদ্যোগ
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে থাকা ৩৪৫ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ১৫২ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছেছে বলে দাবি করেছে। ২২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সাহায্য করা হয়েছে ওই সংস্থার তরফে।
ভারতের উদ্যোগ
কেন্দ্রের তরফে খাদ্য বন্টন এবং অপচয়ের ক্ষেত্রে নানান উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি এখনও। দাবি, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে বর্তমানে ফুড ব্যাঙ্কের যে কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে তা বরঞ্চ কার্যকরি।
রেশন ব্যবস্থায় গলদ
দাবি করা হয়, সমগ্র দেশে বিশেষত এই রাজ্যেও যে রেশন ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে তাও গলদের। যেখানে বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী পান বহু মানুষ। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই ধরনের ক্ষেত্রে আসলে যাদের প্রাপ্য এই খাদ্যসামগ্রী, সেক্ষেত্রেও রয়েছে নানা সমস্যা। ভুয়ো কার্ড, সরকারি নজরদারির অভাব এবং সর্ষের মধ্যে ভূতের আবহে এই সামগ্রীর বন্টনে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ যারা পাওয়ার যোগ্য তারা পাচ্ছে না, উপরন্তু চলছে কালোবাজারি।
মমতার মা ক্যান্টিন
তামিলনাড়ুর আম্মা ক্যান্টিনের আদলে এই রাজ্যেও চালু হয় মা ক্যান্টিন। ৫ টাকায় ডিম-ভাতের এই মমতা-উদ্যোগ সাড়া ফেলে। দাবি করা হয়, এই দুর্গাপুজোর সময়ও রাজ্যের একাধিক জেলায় এই ক্যান্টিনে হাজার হাজার মানুষ খাবার পেয়েছেন। যদিও এই ক্যান্টিন নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। খাবারের মান এবং বন্টন, জায়গা নির্বাচনে রয়েছে প্রশ্ন। যদিও মা ক্যান্টিনের মতো উদ্যোগে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা একথা বলেন অনেকেই।