বোমাবাজি থেকে কালীপুজো! রূপোলি পর্দার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় বাস্তবের 'ফাটাকেষ্ট'

Fatakeshto Kalipuja: উত্তমকুমারও মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্ত একটানা এসেছেন এই ফাটাকেষ্টর পুজোয়। যখন নেমন্তন্ন করতে যাওয়া হত, বলতেন, "শুটিং না পড়লে পুজোর সময়ে যাব, নইলে আগেভাগেই যাব।"

বাবার পানের দোকান কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে। দোকানের দেখাশোনা করতেন তিনি। কালীভক্ত এই মানুষটি ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনে আরতির সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন আর ভাবতেন বেশ জাঁকজমকের পুজো করার কথা। ১৯৫৫ সালে প্রথমবার শুরু করেন কালীপুজো। সেই পুজো অবশ্য এখনকার মতো বিরাট করে হত না। শুরুর ঠিকানা ছিল উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট লাগোয়া গুরুপ্রসাদ চৌধুরি লেন। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মনোমালিন্য। ফলে পুজো তুলে আনেন কাছেই সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের একটি ঘরে। বছর দুই পরে পুলিশ-পুরসভার অনুমতি নিয়ে যা নেমে এল রাস্তায়।

কিন্তু এই পরিচয়ে ছবির ট্রেলারটুকুও শেষ করা গেল না। শরীরচর্চার রেওয়াজ ছিল তাঁর। ডাম্বেলও ভাঁজতেন মাঝেসাঝে। পেটাই চেহারা। গালে বসন্তের দাগ। ১৯৫০-এর দশকের শেষদিক তখন। মনোহর আইচের আখড়ায় ঘুরে পাঁউরুটি আর পাঁঠার গুরদা কিনে ফিরতেন। আমহার্স্ট স্ট্রিটের নীলকণ্ঠ কেবিনে তা সেদ্ধ করে পেট ভরাতেন। আবার কখনও পাড়ায় ডাম্বেল ভেঁজে দুধে কাঁচা ডিম গুলে নিয়ে চুমুক দিতেন। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট লাগোয়া নরসিংহ লেনে তাঁর বাড়ির কাছেই বরাহনগরের আরেক মস্তান নীলুকে নিয়ে চড়াও হয়েছিল পাড়াতুতো দুশমন নকুল। ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েও সদ্য-যুবা কেষ্টা যথাসাধ্য লড়েন। মেডিক্যাল কলেজে যমে-মানুষে টানাটানি শেষে বেরনোর পর থেকেই তিনি ‘ফাটাকেষ্ট’। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নিলামের কারবার সামলানো, নকশাল-দমন, মুকুটে পর পর সাফল্যের পালক। নকশাল আমলে ওই তল্লাটেই মির্জাপুর স্ট্রিটের ছেলে জনৈক ‘গণ্ডার’ ফাটাকেষ্টকে বোমা মেরেছিলেন। ফাটেনি। ফাটা সেই বোমা হাতে তুলে নিয়ে পালটা ছুড়ে মারেন। সিনেমার ফাটাকেষ্টর থেকে অনেক বেশি থ্রিলার মেশানো স্টোরিলাইন আসল ফাটাকেষ্টর জীবনে। ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তর-আশি-নব্বই, ফাটাকেষ্ট আর তাঁর কালীপুজো মিথ হয়ে উঠেছিল কলকাতা ছাড়িয়ে রাজ্যের নানা প্রান্তে।

পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। আজীবন কষ্ট করে চেকে বাংলায় সই করতেন। কিন্তু সেসব বাধাবিপত্তি সামলেই উপর মহলের মানুষজনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন ফাটাকেষ্ট ওরফে কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। পুজো মণ্ডপের অদূরেই তাঁর ক্লাব নবযুবক সংঘের ঘর। উত্তম-সুচিত্রা, লেভ ইয়াসিন, অমিতাভ, রাজেশ খান্না, বিনোদ খান্না, জিতেন্দ্র, মালা সিন্‌হা, আর ডি-আশা... কে না এসেছেন সেখানে। মণ্ডপের অনেক পিছনে হ্যারিসন রোডের গলি দিয়ে কোনও ফিল্মস্টার বা নেতা ঢুকলেও শেষ মুহূর্ত অবধি গোটা বিষয়টি গোপন রাখা হত। সত্তরের দশকে তো আর মোবাইল নেই। তাই ক্লাবঘর থেকে ল্যান্ডলাইনের ফোনে খবর যেত মণ্ডপ লাগোয়া কেশব সেন স্ট্রিটের অফিসে। তারপরই জনতাকে চমকে মাইকে ঘোষণা! ক্লাইম্যাক্সটা এতটাই ভাল বুঝতেন ফাটাকেষ্ট। কাশী থেকে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর আসার সময়ে তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন নিজে। 

আরও পড়ুন- সনিয়ার কন্যাদান করেন হরিবংশ রাই বচ্চন! কীভাবে নষ্ট হল অমিতাভ-রাজীব গান্ধীর বন্ধুত্ব?

তাঁর উত্থান মূলত সত্তরের দশকের নকশাল আমলে। কংগ্রেস-বিরোধী ও নকশালরা দিনে দিনে তাঁর উপর হয়ে উঠেছিল খাপ্পা। গুলি-বোমার লড়াইয়ে সমানে টক্কর দিত কেষ্টদার টিম। নকশাল আমলের সাফল্যের পুঁজি ফাটাকেষ্টকে জীবনভর চড়া সুদ দিয়েছে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে সরকারি ডেয়ারির রিজার্ভ ড্রাইভারের চাকরি পেয়েছিলেন। অফিস না গিয়ে বসে বসে মাইনে নিতেন। বাম আমলেও তা বহাল ছিল। একসময় নিজের অ্যাকশন পার্টিকে নিয়ে অকশনের দখলদারি নিজের হাতেই রেখেছিলেন। পরে সমঝোতা হয় অন্য বাহুবলীদের সঙ্গে। বাড়ি বসেই নাকি নিলামের বখরার তিন পার্সেন্ট তাঁর কাছে চলে আসত। ফাটাকেষ্টর পুজোর মধ্যগগনে ওঠাও নকশাল আমলের পরেই।

১৯৭৩ সাল। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘নমকহারাম’ ছবিটি তখন সিনেমা হলগুলোয় চলছে রমরমিয়ে। রাজেশ খান্না-অমিতাভ-রেখা। সুপারহিট! অমিতাভ-রাজেশ খান্না ডুয়েলে দর্শক কার ফ্যান হিসাবে পরিচয় দেবেন তা ভাবতে ভাবতেই জেরবার। উপরের তথ্যটি প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু ‘নমকহারাম’-এর ডায়লগ অমিতাভ কেবলমাত্র সিনেমাতেই দেননি, দিয়েছিলেন এই কলকাতার একটি কালীপুজোর মঞ্চে। ‘নমকহারাম’ সিনেমার বছরখানেক পরেই। মানুষের স্মৃতি তখনও টাটকা। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটার কাছাকাছি। এক হাত পকেটে দিয়ে, মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে বাঁদিক থেকে ডানদিকে, বচ্চন ভঙ্গিমায়, সেই পরিচিত ব্যারিটোন কণ্ঠে: "কওন হ্যায় ওহ মাই কা লাল…"

তখনও বচ্চন ‘বিগ-বি’ হয়ে ওঠেননি। কলকাতায় এসেছিলেন ‘দো আনজানে’ ছবির শুটিংয়ে। পরিচালক দুলাল গুহ। অভিনয়ে অমিতাভ-রেখা-প্রেম চোপড়া। দুলাল গুহর কলেজ স্ট্রিটের একটি পুজো কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, "গ্র্যান্ড হোটেলে দেখা কর অমিতাভের সঙ্গে। তোমাদের পুজোতে আসতে বলো ওঁকে।"

কথামতো কাজ। হোটেলে যাওয়ার পর দুলাল গুহ ফাটাকেষ্টর পরিচয় দিতেই অমিতাভ জড়িয়ে ধরলেন। কালো রঙের হাতকাটা গেঞ্জি পরা অমিতাভকে পুজোয় আসার কথা বলতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। রাত সাড়ে ন’টায় আনতে যাওয়া হল তাঁকে। ১২টা থেকে ‘দো আনজানে’-র শুটিং আগে থেকেই স্থির, তবু এলেন, দেখলেন, ডায়লগ বললেন আর যথারীতি জয় করলেন। কালীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। পরবর্তীকালে হিরে বসানো সোনার একটি নাকছাবিও পাঠিয়েছিলেন অমিতাভ। যদিও পরে চুরি হয়ে সেটি। চোর ধরাও পড়ে। যে দোকানে বেচে দিয়েছিল, দেখা গেল, তা গলানোও হয়ে গিয়েছে। ফলে নতুন করে গড়া হল আবার।

আরও পড়ুন- সাজতেন অনুব্রতর ৫৭০ ভরি সোনায়, কেষ্টর গরু পাচারের দুর্নাম ঘোচাবেন কালীই!

’৮২ সালের কলকাতা। কলেজ স্ট্রিটে, বাটার মোড় থেকে একটা রহস্যজনক গাড়ি বাঁক নিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে। রহস্যজনক এই কারণেই যে পুজোমণ্ডপ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মাইকে ঘোষণা হয়েছিল: আমাদের মধ্যে এসে পড়েছেন মুম্বইয়ের বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। ঘোষণামাত্র পাড়া তোলপাড়! বেপাড়া থেকেও লোকজন ছুটে আসছে। পুলিশ মোতায়েন হয়েছে। আশা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন পঞ্চমকে, আর. ডি বর্মন! ভারতীয় সংগীত ইতিহাসের দুই কিংবদন্তি কিনা পাড়ার মণ্ডপে বাঁধা একটি মাচায় গান গেয়েছিলেন। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের রাস্তাটা তখন লোকে লোকারণ্য। সকলে বিস্ময়াভিভূত! আবিষ্ট।

উত্তমকুমারও মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্ত একটানা এসেছেন এই ফাটাকেষ্টর পুজোয়। যখন নেমন্তন্ন করতে যাওয়া হত, বলতেন, "শুটিং না পড়লে পুজোর সময়ে যাব, নইলে আগেভাগেই যাব।" প্রণাম সেরে প্রতিবারই মঞ্চে কিছু না কিছু বলে যেতেন উত্তমকুমার। কোনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেজ নেই, খোলা রাস্তায় মঞ্চ বাঁধা, সেখানেই অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন তনুশ্রীশংকর-আনন্দশংকর। শুধু বলেছিলেন, একটা দিক ঘিরে দিতে, তাহলেই হবে। মানি, মাসল আর ম্যাজিক সারপ্রাইজের মিশেলে ফাটাকেষ্টই বোধহয় কলকাতার শেষ মিথ হয়ে ওঠা মাস্তান, যাকে একডাকে চিনত টালা থেকে টালিগঞ্জ।

 

তথ্যসূত্র

  • খবরের কাগজ -০৪.১০.২০    
  • আনন্দবাজার পত্রিকা -১৫.১০.১৭     
  • সংবাদ প্রতিদিন - ০৫.১১.১৮

More Articles