খোলা জানলা, চারদিক খোলা ঘর! 'কোনার্ক' যেন ঠিক রবির মনের আয়নাটি
Konark, A House Of Tagore: কোনার্ক বাড়ির বিশেষ আকর্ষণ ছিল বেশ নিচু ছাদ আর সমতলের থেকে কিছুটা উঁচুতে থাকা বসার ঘর। আটটা ঘর নিয়ে তৈরি এই বাড়ির ছাদ ছিল বাকি সবক'টি বাড়ির থেকে অনেকটাই নিচু।
শান্তিনিকেতন, বোলপুরে রবিঠাকুরের স্মৃতিধন্য 'উত্তরায়ণ'। এখন যাকে উত্তরায়ণ কমপ্লেক্স বলা হয়। কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদয়ন এবং উদিচী— এই পাঁচটি বাড়ি মিলিয়েই উত্তরায়ণ। প্রথমে কিন্তু এই উত্তরায়ণ একটিই বাড়ির নাম রাখা হয়েছিল। ১৯২৯ সালে সেটা। শিলং থেকে শান্তিনিকেতনে এসে বসবাস করতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও মনে করা হয়, উত্তরায়ণ চত্বরের প্রথম নির্মিত বাড়ি কোনার্কের ভিত্তিপ্রস্থ স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল ১৯১৮ সালের দিকেই। তখনও অবশ্য কোনার্ক নামটি রাখেননি রবীন্দ্রনাথ। পরে যখন গুরুদেব মনস্থ করলেন যে শান্তিনিকেতনে ‘উত্তরায়ণ’ কোনো একটা বাড়ি হবে না, অনেকগুলো বাড়ি নিয়ে হবে তখন এই বাড়ির নাম রাখা হলো কোনার্ক। প্রথম দিকে সম্পূর্ণ বাড়ি বলতে যা বোঝায় তা আদপেই ছিল না এই কোনার্ক। গুরুদেব আসলে চেয়েছিলেন চার দিক খোলা একটি ঘর, যেখান থেকে বসে তিনি শান্তিনিকেতন দিগন্ত ছোঁয়া মাঠ, খোলা প্রকৃতির পরশ পেতে পারেন। ফলে শান্তিনিকেতনের বাকি বাড়িগুলির চেয়ে এই কোনার্ক ছিল আলাদা। প্রায় সারাবছরই রবীন্দ্রনাথের পরশ লেগে থাকতো এই বাড়ির উঠোনে।
রবীন্দ্রনাথের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল একটা খোলা বারান্দা। যেখানে তিনি তার কবিতা আর নাটক পাঠ করতে পারবেন, তার নৃত্যনাট্যগুলো মঞ্চস্থ হবে একদম প্রকৃতির মাঝে। সেই পরিকল্পনারই ফসল আসলে এই কোনার্ক ভবন। সূর্যোদয়ের আগেই ভোররাতে রবীন্দ্রনাথ এসে বসতেন এই বাড়িটির বিশাল বারান্দায়। ১৯১৯ সালে শুরু হয়ে ১৯২২ সালে শেষ হওয়া তিনদিক খোলা পুবের লাল বারান্দা ছিল কোনার্ক মাটির বাড়ির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। যদিও প্রথমে এই বাড়ির মেঝে ছিল মাটি, কাঁকর আর পাথর পিটিয়ে তৈরি আর মাথার উপরে ছিল খড়ের চাল।
আরও পড়ুন: আজও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বহন করে কুয়াশামাখা এই পাহাড়ি বাংলো
কোনার্ক বাড়ির বিশেষ আকর্ষণ ছিল বেশ নিচু ছাদ আর সমতলের থেকে কিছুটা উঁচুতে থাকা বসার ঘর। আটটা ঘর নিয়ে তৈরি এই বাড়ির ছাদ ছিল বাকি সবক'টি বাড়ির থেকে অনেকটাই নিচু। সবদিক থেকে কোনার্কের গঠনশৈলী চোখে পড়ার মতোই। ঘর আর মেঝের উচ্চতার তারতম্য ইচ্ছে করেই তৈরি করা হয়েছিল যাতে এই বাড়ির এক আলাদা রকমের বিশেষত্ব তৈরি করা যায়। পরবর্তীতে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ নিজের হাতে উদয়ন বানাবার সময়ে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলেন, প্রথম দিকের কোনার্ক ছিল অনেকটাই সেইরকম।
ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রনাথ খোলা জানলা চেয়েছিলেন এই বাড়িতে, তাই কোনও গরাদ ছিল না এখানে। ঠিক তেমনই, কোনার্কের ঘরে কংক্রিটের আসবাবপত্র তৈরি করা হয়েছিল। যদিও পরে সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়। শান্তিনিকেতনে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষানিরিক্ষা সম্ভবত করা হয়েছে এই বাড়িটির উপরেই। কখনও বাড়ির উঁচু বারান্দাটা কাচ দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হল। যাতে চারপাশের সবকিছু ভালোভাবে দেখা যায়। আবার কখনো ঘরের সব আসবাব পাল্টে গেল রাতারাতি।
রবীন্দ্রনাথ থাকতেন উঁচু বসার বারান্দার বাঁদিকে একটি সরু মতন ঘরে আর বারান্দায় ইজিচেয়ারে অথবা সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ে শোনাতেন মিলটন, বায়রন এর মতো কবিদের কবিতা। মন ও স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আশ্রমিকরা শুনতে পেতেন জাপানি বা জার্মানি কবিতার বাংলা অনুবাদ। 'নটীর পূজা' নাটকটি প্রথম উপস্থাপিত হয় এখানেই। এই বাড়িতেই থেকে গেছেন জওহরলাল নেহরু, কমলা নেহরু, উইলিয়াম পিয়ারসন, চার্লস অ্যান্ড্রুজের মতো দিক্পালরা।
আরও পড়ুন:জমিদার রবীন্দ্রনাথ || হিন্দু আর মুসলমান প্রজাদের সেদিন এক আসনে বসিয়েছিলেন কবিগুরু
কোনার্ক বাড়ির সামনে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে একটি শিমুল গাছ পুঁতেছিলেন, নিজের হাতে পরিচর্যাও করতেন সেই গাছে নিয়মিত। পরে তার সঙ্গে যোগ হল একটি মাধবীলতা। আজও দু'টো গাছ হাত ধরাধরি করে উঠে চলেছে ওপরের দিকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তার পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এই বাড়িতে দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন। শান্তিনিকেতনে গেলে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য এই উত্তরায়ণ চত্বরে পা দেন না এমন পর্যটক বোধহয় পাওয়া কঠিন। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শান্তিনিকেতন যাপনের চিহ্ন বুকে নিয়ে আজও ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই উত্তরায়ণ।