বানজারাদের প্রান্তিক স্বরকেই কণ্ঠ দিতে চান সাহিত্য আকাদেমি-জয়ী রমেশ
Sahitya Akademi Yuva Puraskar for Telugu: তেলঙ্গানার নিজামাবাদের বাসিন্দা রমেশ কার্তিক নায়ক জিতে নিয়েছেন ২০২৪ সালের সাহিত্য আকাদেমি যুব পুরস্কার। রমেশ নিজের সাহিত্যভুবন রচনা করেন তেলগু ভাষায়।
"আমাদের এই গ্রাম পাখির বাসা, আমাদের কুঁড়েঘরগুলি ভাঙা ডিম আর আমাদের এই জীবন যেন ভেসে থাকা পালক।"— বানজারাদের জীবন আসলে যেন তাই। জীবনকে সে ভাবেই দেখেছেন তিনি। আর যা দেখেছেন, তাকেই শব্দবায়ু জুগিয়ে গিয়েছেন অবিরত। সেই চেষ্টাই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে একের পর এক বই। তার মধ্যে ধাভলো (সং অব ল্যামেন্ট) নামে একটি ছোটগল্পের সংকলন সম্প্রতি তাঁকে এনে দিয়েছে অনন্য সম্মান। তেলঙ্গানার নিজামাবাদের বাসিন্দা রমেশ কার্তিক নায়ক জিতে নিয়েছেন ২০২৪ সালের সাহিত্য আকাদেমি যুব পুরস্কার। রমেশ নিজের সাহিত্যভুবন রচনা করেন তেলুগুভাষায়। তিনিই প্রথম আদিবাসী লেখক, যিনি এই সম্মান জিতে নিলেন। একই সঙ্গে তেলুগুভাষার সাহিত্যিকদের মধ্যেও তিনি কনিষ্ঠতম, যিনি এই পুরস্কার পেলেন।
নিজামপুরের ছোট্ট গ্রাম জাকরানপল্লী থান্ডা। ঘন বন আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াতে হয় যেখানে, সেখানেই জন্ম রমেশের। আসল নাম নুন্নাভথ কার্তিক নায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ। বাবা নুনাভথ সেবান্তাবাই চাষবাস করেন। সেই কাজে হাত লাগান মা মোজিরামও। বাবা-মা ভোর হতেই ক্ষেতের কাজে বেরিয়ে যেতেন। ছোট্ট রমেশের সময় কাটত কবিতা আর সাহিত্যের সহচার্যে। সেই বোধহয় শুরু। গ্রোগ্রাসে বই পড়তেন রমেশ। রমেশরা স্থানীয় লাম্বাদি বা বানজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। জীবনের প্রতিপদে পদে যে সংগ্রাম, লড়াই তাঁদের ললাট লিখন, তা বোধহয় জন্ম থেকেই জানতেন রমেশরা। অল্প বড় হতে না হতেই বোধন শহরের একটি আবাসিক স্কুলে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন মা-বাবা। ফলে থান্ডা থেকে দূরেই কেটে গেল বেশিরভাগ ছোটবেলাটা। তার মধ্যেই তাঁর জীবনে একটা বড় জায়গা করে নিল সাহিত্য।
আরও পড়ুন: অপরের জন্য লিখে সাহিত্যে নোবেল, কে এই জন ফসে?
বহু দিন ধরেই আদিবাসী জীবন, বিশেষত বানজারদের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে তাঁর আগ্রহ। তিনি বরাবর এমন কিছু লিখতে চেয়েছেন, যা নিয়ে আগে কখনও লেখা হয়নি। রমেশ বিশ্বাস করেন, ঐতিহাসিক নন-ফিকশন লেখা আসলে কোনও কাজে আসে না। তা শুধু অন্যরা যা বলেন, সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে যায়। তাই তিনি জীবন লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লাম্বাদিদের কথা, যা আজ অবধি অলিখিত, অনাবিষ্কৃত।
২০১৮ সালে প্রকাশ পায় তাঁর কবিতার বই 'বলদাইর বান্দি'। ২০২১ সালে ছোট গল্পের সংগ্রহ 'ধাভলো (সং অব ল্যামেন্ট)' প্রকাশিত হয়। ২০২২ সালে আরও একটি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশ পায় তাঁর 'কেসুলা' নামে। অধ্যাপক সূর্য ধনঞ্জয় বইটিতে সহ-সম্পাদনা করেছেন। তাঁর সাম্প্রতিকতম বইটি ইংরেজিতে তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন, যার নাম 'চাকমাক'। তাঁর দ্বিতীয় বই 'ধভলো'-র জন্যই তিনি ২০২৪ সালের সাহিত্য আকাদেমি যুব পুরস্কারটি জিতে নিয়েছেন রমেশ। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় প্রকাশনাগুলিতে বেশ কয়েকটি পুরষ্কার জিতে নিয়েছে তাঁর বইগুলি। এখানেই শেষ নয়, এর মধ্যেই তেলঙ্গানা এবং অন্ধ্র প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে জায়গা করে নিয়েছে তাঁর সাহিত্য। যে সাহিত্যের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে যাযাবর জাতি বানজারদের জীবন বাস্তবতা। যাঁরা লাম্বাদি নামেও পরিচিত। মূলত রাজস্থান এদের জন্মভূমি হলেও ক্রমে গোটা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছেন বানজাররা।
আরও পড়ুন: বারবার নিজের স্মৃতির ময়নাতদন্ত, নোবেল জয়ী অ্যানি এরনোঁর সাহিত্য যে কারণে জনপ্রিয়
আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারে বড় হয়ে সাহিত্যচর্চার নেশাকে রসদ জুগিয়ে চলার কাজ সহজ নয়। দশম শ্রেণি পাশ করার পর কী না করেছেন রমেশ। কখনও ক্যাটারিংয়ের দলে ভিড়ে অনুষ্ঠান বাড়িতে খাবার পরিবেশন করেছেন, কখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসি মেরামতির কাজ করেছেন। কখনও আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে বই বিক্রি করেছেন। তবে তা কখনও সাহিত্যচর্চার পথে বাধা হয়নি। প্রথম বই 'বলদাইর বন্দি' প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই বদলায় জীবন। পাঠকমহলে দারুণ ভাবে আদৃত হয় তাঁর সেই বই। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এবার মিলল সাহিত্য আকাদেমি যুব পুরস্কারের মতো স্বীকৃতি। তা-ও মাত্র ২৬ বছর বয়সে। বানজারাদের জীবনে সংকট, তাঁদের খণ্ড হয়ে ঘুরে ঘুরে বেঁচে থাকার ছবি, বাস্তুচ্যুত হওয়ার প্রতিমুহূর্তের যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখায় পরতে পরতে। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর এই স্বীকৃতি তাঁর লেখার পাশাপাশি বানজারা সম্প্রদায়ের এই ছিন্নমূল মানুষগুলোর জীবনধারার প্রতিও মানুষকে আকৃষ্ট করবে। সেখান থেকেও যে মূল ধারায়, মূল সমাজে কিছু মানুষ উঠে আসতে পারেন নিজেদের যোগ্যতায়, সেই ভাবনায় সিলমোহরটুকু লাগিয়ে দেবে। তাহলেই সার্থক তাঁর এই নিরলস সাহিত্যচর্চা।