বন্দুকের নলই আমেরিকায় ক্ষমতার উৎস
America and Weapon Industry: ২০২২ সালে বৈশ্বিক সামরিক বাজেটের পরিমাণ ছিল মোটামুটি ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বিগত আট বছরে এই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বেড়েছে। আর এই যে বিশাল বাজার, সেই বাজারের আসল 'বাঘ' কিন্তু আমেরিকা।
বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষের আদিমতম আবিষ্কার ছিল সম্ভবত অস্ত্র। কখনও পাথর তো কখনও গাছের ডালের মুখ ছুঁচালো করে আদিম মানুষ বানিয়ে নিয়েছিল হাতিয়ার। সভ্যতা এগিয়েছে। চার পা থেকে দু'পায়ে হাঁটতে শিখেছে মানুষ। ধাতুর ব্যবহার শেখার পর থেকে সেই অস্ত্রের ধরণ বদলেছে, আকার-আয়তন বদলেছে। ক্রমে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে নতুন নতুন আবিষ্কারে মজেছে মানবকূল। তৈরি করেছে আরও অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। পূরাণ থেকে ইতিহাস, মহাকাব্য থেকে লোকায়ত বীরগাথা, এই অস্ত্রের মায়াজাল থেকে বেরোতে পারেনি মানবসভ্যতা। সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই অস্ত্র মানে আসলে প্রতিরক্ষা। কিন্তু একের পর এক যুগ পেরিয়ে মানুষ যত যুথবদ্ধ হল, গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হল, ততই জন্ম নিতে লাগত গন্ডি, কাঁটাতার, সীমান্ত। যে সীমান্ত আসলে শেখায় অন্যকে শত্রু হিসেবে দেগে দিতে। শত্রু-ভাবনার হাত ধরেই এল প্রতিরক্ষার চিন্তা, যা ক্রমে কোনও একটি দেশ, কোনও একটি গোষ্ঠীকে ঠেলে দেয় অস্ত্র মজুতের দিকে। যুদ্ধ লাগলে যে দেশের কাছে যত অস্ত্র, সে ততই শক্তিশালী। এরই মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে বাধ্য এক মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণি। যারা আসলে খুঁজে নিল বাণিজ্যের এক অত্যাধুনিক পথ। জমে উঠল অস্ত্রব্যবসা।
এদিকে অস্ত্রের ততক্ষণই প্রয়োজন, যতক্ষণ যুদ্ধ। যুদ্ধ নামক ধারণার অবসান ঘটলে মাঠে মারা যাবে এই অস্ত্রব্যবসার বিপুল বাজার। ফলে যুদ্ধের জিগিরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় যত্নে, কৌশলে। আর এই বাজারের পাক্কা খিলারি যে আমেরিকা, তা বলতে দ্বিধা নেই। 'ভিস্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট' নামে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটের ২০২২ সালের পরিসংখ্যান কিন্তু তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। ২০২২ সালে বৈশ্বিক সামরিক বাজেটের পরিমাণ ছিল মোটামুটি ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বিগত আট বছরে এই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বেড়েছে। আর এই যে বিশাল বাজার, সেই বাজারের আসল 'বাঘ' কিন্তু আমেরিকা। অস্ত্র বিক্রির তালিকায় সবচেয়ে উপরে স্থান তার। বিশ্বের মোট অস্ত্র বিক্রির অন্তত ৪০ শতাংশই দখলে রেখেছে আমেরিকা। আর প্রতিবছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সেই অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ।
আরও পড়ুন: ইউক্রেনে ভয়াবহ রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার! রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ তুলল আমেরিকা
বিশ্ব জুড়ে আমেরিকার অস্ত্রের ব্যাপক নাম-ডাক। ন্যাটোর আওতায় থাকা অধিকাংশ দেশই আমেরিকার ক্রেতা, এবং অবাক হওয়ার মতো বিষয় এই অস্ত্র ব্যবসার সবচেয়ে বড় বাজার কিন্তু এই ভারত। বিশ্বের প্রায় ১১ শতাংশ অস্ত্রই কেনে তারা। এই ১২১ কোটির দেশই ধনে-সম্পদে-বাণিজ্যে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাখে আমেরিকাকে। কম যায় না অন্যরাও। গত কয়েক বছরে একাধিক বড় বড় যুদ্ধের সাক্ষী বিশ্ব। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত, এ সমস্ত যুদ্ধ থেকেই আসলে বাণিজ্যিক ভাবে লাভবান হয় আমেরিকা, রাশিয়া বা ফ্রান্সের মতো বড় বড় অস্ত্র রফতানিকারী দেশ। তবে আমেরিকার ক্ষেত্রে এই ব্যবসা শুধুমাত্র বৈশ্বিক স্তরে আবদ্ধ নয়। কথায় বলে— 'charity begins at home'। আর ঠিক সেই কাজটাই করে আমেরিকা। ঘর থেকেই সেই বাজারের শুরুটা করে দেয় তারা।
সম্প্রতি প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে বুলেট। রিপাবলিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী, যিনি কিনা প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে জানপ্রাণ লাগিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর কানের আগা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল আস্ত একটি বুলেট। মুখে রক্তের ছিটে নিয়ে মঞ্চে দেখা গেল প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে। উত্তাল দেশ। পুলিশের পাল্টা গুলি ততক্ষণে অবশ্য ফুঁড়ে দিয়েছে বছর কুড়ির বন্দুকবাজ ম্যাথু ক্রুকসের বুক। এদিকে আট রাউন্ড গুলির পরেও ফস্কেছে তার নিশানা। যদিও ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে, প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের মাথা লক্ষ্য করেই বন্দুকের নলের পয়েন্ট ঠিক করেছিল সে। কিন্তু মোক্ষম মুহূর্তে মাথা সরিয়ে নেন ট্রাম্প। কান গেলেও প্রাণ বাঁচে তাঁর। যদিও ততক্ষণে ম্যাথুর গুলি প্রাণ কেড়েছে দর্শকাসনে বসে থাকা শ্রোতা কোরি কমপিরেটরের। জখম হয়েছেন আরও দুই দর্শক। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় জল্পনা। নানা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সামনে আসতে থাকে এক এক করে। ট্রাম্প হত্যার পিছনে থাকতে পারে ইরানের হাত কিংবা বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র। কিংবা হয়তো গোটাটাই যাকে বলে কিনা 'পাবলিসিটি স্টান্ট'। বড় বড় দেশে কত কিছুই না ঘটে।
এত সব কিছুর মধ্যে যে প্রশ্ন বারবার ওঠে, এবং তারপর ফের ঝিমিয়ে পড়ে, তা হল আমেরিকার অস্ত্র আইন। আমেরিকায় বন্দুকবাজের হানা যেন খুব আম বাত। দু-একদিন হইচই হয়, নড়েচড়ে ওঠে সেনেট, তারপর আবার যে কে সে-ই। প্রশ্ন ওঠে, অস্ত্রের কারবারিরা কি তবে সেই 'চ্য়ারিটি'র শুরুটা করে ঘরের অন্দর থেকেই। যে অস্ত্রের বাণিজ্য থেকে ফুলেফেঁপে ওঠে মার্কিন অর্থনীতি, তাতে রয়েছে দেশবাসীরও বিন্দু বিন্দু অবদান। একদিন যে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বের সভ্যতার রূপরেখাটাই বদলে দিয়েছিল, যুদ্ধের ইতিহাসে মোটা কালো অক্ষরে লেখা হয়েছিল দু'টি নাম— হিরোসিমা ও নাগাসাকি। ভুললে চলবে না সেই অন্ধকারতম অধ্যায়ের নেপথ্যনায়কও কিন্তু ছিল আমেরিকা। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে দিয়েছিল বটে, তবে সেই শেষটা ছিল নিদারুণ লজ্জার, মানবতার পক্ষে চরম অপমানের। তবে আমেরিকা ততদিনে নিজের পথ চিনে নিয়েছে ঠিকই। ঘরে-বাইরে অস্ত্র ব্যবসার বাজার ছড়িয়ে দিয়েছে জালের মতো। যার থেকে আসলে মুক্তি চায় না আমেরিকা।
২০২২ সালের মে মাস নাগাদ টেক্সাসের একটি স্কুলে ঢুকে পড়ে বছর সালভাদর রামোস নামে আঠারোর এক বন্দুকবাজ। হাতের খেলনা মুহূর্তে কেড়ে নেয় ১৯টি পড়ুয়ার প্রাণ। মারা যান ২ শিক্ষক। পুলিশের গুলিতে মারা যায় বন্দুকবাজও। আঠারোতম জন্মদিনে নিজেই নিজেকে দু'টি বন্দুক উপহার দিয়েছিল রামোস। কারণ ফেডারেল আইনই তাকে অনুমতি দিয়েছিল ওই বন্দুক কেনার। চোরাবাজার থেকে নয়, সবার সামনে বুক ফুলিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকান থেকে ওই বন্দুকজোড়া কিনেছিল সে। এবং বুক ফুলিয়েই স্কুলে ঢুকে হত্যা করেছিল সহপাঠীদের। অবশ্য তার আগে সে হাত পাকিয়েছিল নিজের ঠাকুমাকে হত্যা করে। ২০২১ সালের নভেম্বর, মিশিগানের অক্সফোর্ড শহরের হাইস্কুলে বছর পনেরোর এক কিশোরের গুলিতে মারা যায় চার পড়ুয়া-সহ মোট সাত জন। ২০১৮ সালের হিউস্টন। সান্তা ফে হাই স্কুলে বন্দুক চালায় বছর সতেরোর দিমিত্রিওস পাগোর্টজিস। মৃত্যু হয় অন্তত দশ জনের। শটগান ও একটি পয়েন্ট ৩৮ রিভলভার নিয়ে স্কুলে চলে এসেছিল সে, যার মালিকানা আসলে তার বাবার। ওই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে গুলি চলে ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ডের একটি স্কুলে। ওই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র নিকোলাস ক্রুজ ছিল বন্দুকবাজের ভূমিকায়। ঘটনায় মৃত্যু হয় ১৪ জন পড়ুয়া ও তিন জন স্কুলকর্মীর। জখম হয় বেশ কয়েকজন। ২০১৫ সালে ওরেগনের রোজবার্গের একটি স্কুলে বন্দুকবাজের গুলিতে মৃত্যু হয় ৯ জনের। ক্রিস হার্পার মার্সার নামে বন্দুকবাজেরও মৃত্যু হয় পুলিশের পাল্টা গুলিতে। জানা যায়, যে ছটি বন্দুক নিয়ে স্কুলে এসেছিল সে, এবং বাড়ি থেকে বাকি যে সাতটি অস্ত্র উদ্ধার হয়, সেই সবকটিই কেনা হয়েছিল বৈধভাবে। ২০১২ সালে কানেকটিকাটের স্যান্ডি হুক স্কুলে বছর উনিশের এক বন্দুকবাজের গুলিতে প্রাণ যায় ২০টি শিশুর। মৃত্যু হয় ৬ জন শিক্ষকেরও। এই হত্যাকাণ্ড চালানোর আগে মাসির কান কামড়ানোর মতো করেই প্রথম গুলিটি চালিয়ে এসেছিল সে নিজের মায়ের উপর। যে মা-ই কিনা সাধ করে ইজমাশ সাইগা-১২ ১২ গেজ সেমি-অটোমেটিক শটগানটি কিনেছিলেন। ওই যুবকের কাছে অবশ্য আরও অস্ত্রশস্ত্র ছিল। আর এই হত্যালীলা চালানোর পর নিজেকেও শেষ করে দেয় সে।
আমেরিকার ইতিহাসে বিস্তর লম্বা এ হেন বন্দুকবাজদের কাহিনি। পকেটে লজেন্স রাখার বয়স থেকে পিস্তল-বন্দুক নিয়ে ঘুরতে শেখায় যে দেশ, তাদের অস্ত্র রাখার অধিকারের ইতিহাসটাও কম পুরনো নয়। ঔপনিবেশিক শক্তি আমেরিকার মাটিতে বসতি স্থাপনের সময় থেকেই নিজেদের রক্ষা করতে মার্কিনিরা পকেটে অস্ত্র রাখতে শিখেছে। প্রায় দু'শো বছরের বেশি সময় আগে ইংরেজ শাসনের শৃঙ্খল থেকে স্বাধীন হয়েছিল সে দেশ। আমেরিকার মানুষের কাছ থেকে বন্দুক রাখার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া মানে যেন তাঁদের এত বছরের ঐতিহ্যে হাত দেওয়া। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর 'পলিটিকস' বইতে লিখছেন, "প্রকৃত নাগরিকত্ব ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশগ্রহণের জন্য অস্ত্রের মালিকানা আবশ্যক।" এদিকে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো কিন্তু বলছেন ঠিক উল্টো কথাটাই তাঁর 'রিপাবলিক' বইতে। তিনি জানাচ্ছেন, তিনি এমন রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী যা জনগণকে স্বল্প সংখ্যক স্বাধীনতা দেয়। এবং সেক্ষেত্রে নিরস্ত্রীকরণকে অপরিহার্য মনে করছেন তিনি। আবার রোমান রাজনীতিবিদ মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো কথা বলছেন জনগণের অস্ত্র রাখার পক্ষে। আত্মরক্ষা ও শোষণের থেকে বাঁচতে তিনি বলছেন পকেটে বন্দুক রাখার কথা। এখন ভাবার যে রাষ্ট্র আসলে কী চায়? বিশেষত আমেরিকার মতো দেশ, যাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশই অস্ত্রব্যবসার উপরে নির্ভরশীল। ইংরেজ আমলে আমেরিকায় অস্ত্র রাখার বাড়বাড়ন্তে রাশ টানা গেলেও ইংরেজ আমল শেষ হতে না হতেই নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রাখার মহান দায়িত্বটি ফের নিজের কাঁধে তুলে নেন মার্কিনিরা। ফলে জনগণের পকেট যত ভারী হয় আগ্নেয়াস্ত্রে, রাষ্ট্রের পকেটও ততই ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে ধনসম্পদে।
আমেরিকার মাটিতে সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে আতঙ্কে থাকেন বাবা-মায়েরা। কাঁপতে থাকেন এই আশঙ্কায় যে এই বুঝি ব্যাগ থেকে বের করে বসল তাঁর ছেলে বা মেয়ের মতোই কোনও খুদে। কিছু বুঝে কিংবা না বুঝে টেনে দিল ঘোড়া। মুহূর্তে নিথর হয়ে গেল চনমনে কয়েকটা প্রাণ। সেই সব বাবা-মায়েরা বুঝি বা চান, দেশের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন জোরালো হোক। অথচ ভোট আসে ভোট যায়। রিপাবলিকান যায়, ডেমোক্র্যাটিক আসে। অস্ত্র আইন বদলায় না। কেনই বা বদলাবে? ওই যে বললাম, এখানে সব চেয়ে বড় ভাবনার জায়গা, রাষ্ট্র আসলে কী চায়? অস্ত্র বাণিজ্যে সংক্রান্ত বিষয়আশয় নিয়ে ২০১৩ সালে আর্মস ট্রেড ট্রিটি গ্রহণ করা হয়েছিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তা কার্যকরও হয়। ওই চুক্তির আওতায় থাকা দেশগুলির জন্য হালকা অস্ত্র, মিসাইল লঞ্চার ও যুদ্ধজাহাজ বিক্রি এবং হস্তান্তরের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন ঠিক করে দেওয়া হয় সেখানে। এখন পর্যন্ত ১০০টির বেশি দেশ ওই চুক্তিকে সমর্থন করেছে। এদিকে সেই চুক্তি থেকে কিছু কাল আগে বেরিয়ে আসার ভাবনাচিন্তা করেছিল আমেরিকা। কেন? কারণ এই চুক্তিতে থাকলে মার খেতে পারে অস্ত্র ব্যবসার সাজানো বাজার। ঠিক যেভাবে সেই চু্ক্তি থেকে বেরিয়ে আসে চিন। ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটি অবশ্য আমেরিকার চুক্তিতে থাকার পক্ষেই সায় দিয়েছে। সামনেই আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যে যার মতো করে ঘুঁটি সাজানো শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। এরই মধ্যে ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে আমেরিকার অস্ত্রের বাজার। যার ফলে মুখে যা-ই বলুন না কেন বাইডেন, কোনও ভাবেই বন্ধুদেশ ইজরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে পারছে না তারা। কারণ অস্বীকার করার জায়গা নেই, যুদ্ধ যত বেশি দিন চলবে, ততই লাভ আমেরিকার। আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও আমেরিকার মুখ চেয়ে রয়েছে অস্ত্রের জন্য। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া, ফ্রান্স বা চিনের মতো অন্য়ান্য অস্ত্রবিক্রয়কারী দেশ যাতে বাজি না মেরে যায়, সে দিকেও নজর রাখতে হচ্ছে রাষ্ট্রকেই।
আমেরিকায় বাড়ির ড্রয়ার থেকে শুরু গাড়ির ড্যাশবোর্ডে কিংবা আলমারির তাকে তাকে বন্দুক রাখার পিছনে যে ঐতিহ্য এবং নিরাপত্তাবোধের ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নাগরিকদের মাথায়, তাকে নিত্য জল-মাটি দিয়ে বড় করে তোলে বন্দুক প্রস্তুতকারক ও বিক্রয়কারী সংস্থাগুলি। হবে না-ই বা কেন! যেমন গুরু, তেমন চ্যালা। সত্যি কথা বলতে, আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসার ইতিহাসে রাষ্ট্র যদি হয় মাস্টার মাইন্ড, তার ডান হাত-বাঁ হাত হল এই সব আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোই। অস্ত্রবাণিজ্যের বাজারকে তরতাজা রাখতে রাষ্ট্র বাঁচিয়ে রাখতে চায় যুদ্ধের জিগির। আর এই সব বন্দুক বিপণনকারী সংস্থাগুলো নাগরিকের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষা নামক নরম জায়গায় সুড়সুড়ি দিয়ে চলে অবিরত। আর সেই কাজটা নৈপুণ্যের সঙ্গে করে দেয় বিজ্ঞাপন। ক্ষত্রিয়র হাতে অস্ত্রই শোভা পায়, এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা যেমন ছোটবেলা থেকে রূপকথা, উপকথারা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, সেভাবেই আমেরিকার সংস্কৃতি সকলের অজান্তেই প্রতিটি নাগরিকের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই ক্ষাত্রিয়ধর্মের বীজ। যা নারী-পুরুষে ভেদ করে না। শুধু মগজে ঢুকিয়ে দেয়— আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে ওর চেয়ে মোক্ষম বস্তু আর দ্বিতীয় নেই বিশ্বে। রাষ্ট্র যা লাইসেন্স-সহ হাতে ধরিয়েও দেয় নিজের স্বার্থেই।
অগত্যা উৎসবে-মোচ্ছবে নতুন জামার মতোই আইনি পথে অস্ত্র কেনেন আমেরিকাবাসী। যা সবার অলক্ষ্যে হাতে তুলে নেয় বাড়ির শিশু কিংবা কিশোরটি। কিংবা অভিভাবকদের চোখের সামনেই ঘটে যায় ঘটনাগুলি। অস্ত্র বিপণণকারী সংস্থা বিজ্ঞাপনের অক্ষরে সাজিয়ে রাখে চমকপ্রদ সব লাইন। কোথাও লেখা থাকে, "BUY YOUR KID A NEW BROWING SHOTGUN, GET CASH BACK!" কোথাও বা লেখা থাকে "FIREFIELD SALUTES YOU, JUNIOR SHOOTERS! সেখানে অবলীলায় ছাপা হয় বন্দুক হাতে খুদেদের ছবি। বাবার সঙ্গে কাটানো মনে রাখার মতো সময় মানে যে বন্দুক চালানোর শিক্ষা, তা কল্পনা করতে বসে বোধহয় শিউরেই উঠতে হয় খানিক। আসলে বিজ্ঞাপনের ভাষায় একে বলে 'হ্যালো এফেক্ট'। কী সেটা? কোনও ব্যক্তি, সংস্থা বা দেশ যখন তার পণ্যের লাভজনক বিক্রির আশায় ব্যক্তি বা জনমানসের অনুভূতিকে ইতিবাচক পথে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, তাকে বলা হয় হ্যালো এফেক্ট। যে পদ্ধতিই আসলে বছরের পর বছর ধরে প্রয়োগ করা হয় আমেরিকার আগ্নেয়াস্ত্রর বাজারে। অথচ সিগারেটের মতো তামাকজাত বস্তুর প্যাকেটের গায়ে ভয়ঙ্কর ছবি বা 'স্মোকিং কিলসে'র মতো সতর্কবাণী লিখে দিতে হয়। চলচ্চিত্রে মদ্যপানের দৃশ্যে লিখে দিতে হয়— 'মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর'। অথচ সকলেই জানেন, বন্দুক শেষপর্যন্ত হত্যাই করে। তার বিজ্ঞাপনে সেই সতর্কতা কোথায়, সেই প্রশ্ন তোলেন না কেউ।
আমেরিকার কিছু কিছু প্রদেশ অবশ্য অস্ত্র আইনে কড়াকড়ি আনার কথা চিন্তাভাবনা করেছে ইতিমধ্যেই। যে সব প্রদেশে প্রশাসনিক স্তরে বন্দুক-হিংসা রুখতে বিশেষ কোনও পদক্ষেপ করা হচ্ছে না, সেখানে তৃণমূল স্তরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং অসংখ্য মানুষ। মেরিল্যান্ড প্রদেশে আনা হচ্ছে বেশ কিছু আইন। আঠারো থেকে বাড়িয়ে আগ্নেয়াস্ত্র কেনার বয়স একুশ করা হয়েছে, অস্ত্র নিয়ে স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি, হাসপাতাল, ধর্মস্থান বা পার্কে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে। এমনকী বন্দুক-হিংসায় ক্ষতিগ্রস্তদের বন্দুক প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগও আনা হয়েছে নয়া আইনে। ২০২২ সালের মে মাসে মিশিগান শহরের একটি দোকানে বন্দুকবাজের গুলিতে মৃত্যু হয় দশ জনের। সেই সময় মিশিগানের ডেমোক্র্যাট গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁর প্রদেশে কড়া বন্দুক আইন আনতে চান তিনি। হুইটমার তাঁর দ্বিতীয় টার্মের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, বন্দুক আইন নিয়ে তাঁর সরকারের বিভিন্ন রকম পরিকল্পনা রয়েছে। তার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ— ইউনিভার্সাল ব্যাকগ্রউন্ড চেক, অর্থাৎ যিনি বন্দুক কিনছেন তাঁর অপরাধের কোনও রেকর্ড রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখে তার পরেই বন্দুক বিক্রি করা। তা ছাড়া, আগ্নেয়াস্ত্রজনিত দুর্ঘটনা এড়াতে আগ্নেয়াস্ত্র আর গুলি যাতে আলাদা রাখা হয়, সেই লক্ষ্যেও নতুন আইন আনতে চান বলে জানিয়েছিলেন গভর্নর হুইটমার।
আরও পড়ুন:জমি কেড়ে নেওয়া, পরের পর যুদ্ধ! পৃথিবী শাসন করা আমেরিকার ইতিহাস তাক লাগাবে
ওয়াশিংটন প্রদেশেও নতুন বন্দুক বিল আসার কথা শোনা গিয়েছিল। নতুন বিল অনুযায়ী, বন্দুক কেনার জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে অন্তত দশ দিন সময় নিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক এবং বাধ্যতামূলক সেফটি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরি ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা-সহ একাধিক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল। ভার্জিনিয়া, কানেটিকাট, কলোরাডো প্রদেশেও কড়া বন্দুক আইন চালু করতে আনা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিল। এ ছাড়া, বিভিন্ন প্রদেশে তৃণমূল স্তরে কাজ করছে ‘গ্র্যান্ডমাদার্স এগেনস্ট গান ভায়োলেন্স’, ‘মাদারস এগেনস্ট গান ভায়োলেন্স, ‘এভরিটাউন ফর গান সেফটি’- মতো সংস্থাগুলি। আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় স্তরে তারা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ সকলই সীমিত স্তরে কাজ। কেন্দ্রীয় স্তরে অস্ত্র আইন আনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই আমেরিকার। আসলে সেনেট এই বিল আনার বিষয়ে সম্পূর্ণ বিভক্ত। আর এই বিভাজন যে শুধু রিপাবলিকান বনাম ডেমোক্র্যাট দলের ক্ষেত্রে, তা নয়। দু’টি দলেই দুই মতাদর্শের মানুষ রয়েছেন। একদল চান অস্ত্রের বাড়বাড়ন্ত রুখে দিতে। অন্যদল নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পকেটে রাখতে চান বন্দুক নামক এক ঐতিহ্যকে। যা সঙ্গে থাকলে নিজেকে রাজার মতো দেখায়। আসলে একই ছবি আমেরিকার সর্বত্র। সব পরিসরের সমস্ত নাগরিকই যে দেশের অস্ত্র আইনের সংস্কার চান, এমনটা একেবারেই নয়। ক্যালিফর্নিয়ায় অস্ত্র আইন সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হওয়া সত্ত্বেও বন্দুকজনীত ঘটনা-দুর্ঘটনার শেষ নেই সেখানে। অনুমান করা হয়, অন্য প্রদেশ থেকে বন্দুক কিনেই দেদার চলছে বীরত্ব প্রদর্শন। আর এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্তরে আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা ছাড়া এই অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই আমেরিকার।
সামনেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেই ভোটে জিতে যিনি ক্ষমতায় আসবেন, তিনিও ফের মন দেবেন অস্ত্রের কারবারে। তেমনটাই হয়ে এসেছে। ফুলে-ফেঁপে বহরে বেড়ে উঠবে দেশের অর্থনীতি। বিশ্বের মিত্রদেশগুলির সঙ্গে মৈত্রী আরও বাড়বে আমেরিকার। আরও শক্তিশালী হবে আমেরিকা। বন্দুকের নলই যে শুধু ক্ষমতার উৎস নয়, সেই বন্দুক তথা অস্ত্রের কারবারই যে একটি দেশের লক্ষ্মী হয়ে উঠতে পারে বছরের পর বছর ধরে, সে কথাই বারবার মনে করিয়ে দেবে আমেরিকা। আর স্কুলে, দোকানে, বাজারে, ধর্মস্থানে বন্দুকের নলের মুখে নিথর হয়ে পড়ে থাকবে একের পর এক শরীর। এ ভাবেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে আমেরিকার রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি। রত্নাকরেরা বাল্মীকি হয়ে উঠতে পারেন, টনি স্টার্ক হয়ে উঠতে পারে 'আয়রন ম্যান'। তবে আমেরিকার প্রশাসনের দিব্যচক্ষু উন্মীলিত করার কাজটা বোধহয় তার চেয়েও বহুগুণে কঠিন। পরশুরামের কঠোর কুঠার একদিন গোটা বিশ্বকে নিক্ষত্রিয় করেছিল। অস্ত্রব্যবসার রাজধানী আমেরিকায় আদৌ তেমন কোনও পরশুরামের কল্পনা করা সম্ভব কখনও! সংশয় জাগে।