আড়িয়াদহে মা-ছেলেকে পিটুনি! মদন মিত্রের ছায়ায় যেভাবে বেড়ে উঠল গুন্ডা জয়ন্ত সিং
Ariadaha Lynching Incident: যার হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ জয়ন্তর সেই মদন মিত্র স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘কে, কার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, তা বোঝা সম্ভব নয়।"
আড়িয়াদহে ঝামেলা হচ্ছিল দুই যুবকের মধ্যে। তাঁদের ব্যক্তিগত ঝামেলার মধ্যে ঢুকে পড়ে স্থানীয় দুষ্কৃতী জয়ন্ত সিং। বাকিটা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অভিযোগ, সায়নদীপ পাঁজা আর তাঁর মা বুবুন পাঁজাকে রাস্তায় ফেলে হকি স্টিক, লাঠি, ইট দিয়ে মারে জয়ন্ত সিংয়ের দলবল। গণপিটুনির ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে রাজ্যজুড়ে। চোপড়ায় দুই যুবক-যুবতীকে রাস্তায় ফেলে মারের নেপথ্যে জেসিবি নামের চরিত্রটির উঠে আসা, আর তার মাথায় শাসকদলের হাত বুঝিয়ে দিয়েছিল কোনও ঘটনার বাড়বাড়ন্তই শাসক তৃণমূলের নজরের বাইরে নয়। আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংয়ের ঘটনাও কি এর বাইরে? নয়। আড়িয়াদহে মা ও ছেলেকে পেটানোর ঘটনায় জয়ন্ত সিং গ্রেফতার হয়েছে ঠিকই, তবে স্পষ্ট হয়ে গেছে একটি বিষয়। জয়ন্ত সিংয়ের বাড়বাড়ন্তও শাসকের ছত্রছায়াতেই। কে এই জয়ন্ত?
জয়ন্ত সিং পেশায় একজন গোয়ালা। বছর সাত-আট আগে স্থানীয় বিধায়ক মদন মিত্রের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেয় জয়ন্ত সিং। তৃণমূলের হাত মাথায় থাকায় এলাকায় কয়েক মাসের মধ্যেই জয়ন্ত সিং হয়ে যায় ‘জায়ান্ট সিং’। শাসকের আশ্রয়ে থাকা জয়ন্ত এলাকায় রীতিমতো তাণ্ডব চালাতে থাকে। বোমাবাজির ঘটনায় জেলও খেটেছে। অভিযোগ, প্রথমে জয়ন্ত ইমারতি দ্রব্যের সিন্ডিকেট তৈরি করে। কামারহাটি জুড়ে অসংখ্য জুয়া-সাট্টার ঠেকের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে সে। পরে কম দামে জমি হাতিয়ে প্রোমোটারির সিন্ডিকেটও শুরু করে জয়ন্ত সিং ওরফে জায়ান্ট সিং।
আরও পড়ুন- যোগীরাজ্যের গণপিটুনি-সংস্কৃতি বাংলাতেও! একের পর এক ঘটনায় প্রশ্ন
ধীরে ধীরে রাজনৈতিক মিছিলে প্রভাবশালী নেতাদের পাশে জয়ন্তকে দেখা যেতে থাকে। বিধায়ক মদন মিত্রর সঙ্গে দেখা যায় তাকে, ছবি তোলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। এলাকায় একজন দুষ্কৃতীর বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে, রাস্তায় ফেলে সাধারণ মানুষকে পেটানোর ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে সে, রাজনৈতিক কোনও মদত ছাড়াই? কীভাবে সম্ভব?
এলাকায় সক্রিয় তৃণমূল কর্মী বলেই পরিচিতি জয়ন্ত সিংয়ের। একের পর এক কুকীর্তি সামনে এসেছে জয়ন্তর, তবু শাসকের হাত সরেনি। আড়িয়াদহর ঘটনা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সায়নদীপ ও তাঁর মাকে মারধরের ঘটনায় আড়িয়াদহের দুষ্কৃতী জয়ন্ত সিং-সহ ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সায়নদীপের পিসতুতো বোন এখনও রীতিমতো আতঙ্কে। বরাহনগর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কলেজের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আতঙ্কে কলেজ-টিউশন যাওয়াও ছেড়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের চ্যাটের স্ক্রিনশট নিয়ে তিনি দক্ষিণেশ্বর থানায় জয়ন্তর দলের সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। ওই চ্যাটে সায়নদীপের বোনকে ধর্ষণ ও খুনের কথাও বলা হয়েছে বলে অভিযোগ। সায়নদীপ ও তাঁর মা এখনও হাসপাতালে ভর্তি। সায়নদীপের বাবা বিমল পাঁজার অভিযোগ, রবিবার রাতে প্রীতম কাহার, সুমন এবং মনোতোষ নামে তিন যুবক প্রথমে সায়নদীপকে মেরেছিল। এরপরেই দলবল চড়াও হয়।
যদিও যার হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ জয়ন্তর সেই মদন মিত্র স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘কে, কার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, তা বোঝা সম্ভব নয়। কোনও প্রোমোটারের থেকে এক টাকাও খাই না। বেলঘরিয়ায় দুষ্কৃতী-রাজ চলবে না।’’ তাহলে জয়ন্তকে তিনি চেনেন না বলতে চান? ছবি তো সে কথা বলে না। জয়ন্ত সিংয়ের যা যা কীর্তির ভিডিও ফাঁস হচ্ছে তা দেখে শিউরে উঠছে রাজ্যের মানুষ। আড়িয়াদহের মানুষের আতঙ্ক তাই সহজেই অনুমেয়। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এক কিশোরকে নগ্ন করে তার যৌনাঙ্গ সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরে টানা হচ্ছে। যে এমনটা করছে সেই লাল্টু জয়ন্তেরই ঘনিষ্ঠবৃত্তের। ২০২১ সালের অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একজনকে চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে রেখেছে চারজন আর লাঠিপেটা করে চলেছে আরও কিছুজন। আড়িয়াদহের ক্লাবে তোলা ওই ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে সেই শিবম, রাজদীপ, লালু, গঙ্গা, লাল, দীপু, সুমনরা জয়ন্ত সিংয়েরই দলের।
আরও পড়ুন- অপহরণ থেকে শুরু করে সিপিএম নেতা খুন! পুলিশের খাতায় ‘অপরাধে’র লম্বা তালিকা চোপড়ার জেসিবি-র
আড়িয়াদহের তালতলা ক্লাবটিই ছিল এই সমস্ত কুকীর্তির কেন্দ্র। জয়ন্তের এক ভাই কলকাতা ফুটবলের নামী খেলোয়াড়, খেলেছেন ইস্টবেঙ্গল এবং মহমেডান স্পোর্টিংয়েও খেলেছেন। মদন মিত্র বলছেন, তিনি যখন ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন, তখন জয়ন্তের ভাইয়ের কথায় একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে ছবি উঠেছিল। এর বেশি তিনি জয়ন্তকে চেনেনই না। অথচ মদন মিত্রের পুত্রবধূ মেঘনা মিত্র কামারহাটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সেই বৃত্তেও জয়ন্তের অবাধ যাতায়াত ছিল। ব্যারাকপুর থেকে ডানলপ পর্যন্ত বিটি রোডের ধারের সমস্ত পানশালায় ছিল জয়ন্তের নামে ‘রিজ়ার্ভ’ চেয়ার। এই বিভিন্ন পানশালায় একাধিক গণ্ডগোলে জড়িয়ে আছে জয়ন্ত।
রাজ্য সরকার বিভিন্ন জেলায় গণপিটুনির অস্বস্তি ঢাকতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেছে। গণপিটুনি শব্দটি এড়িয়ে গিয়ে সরকার বলেছে, 'সাম্প্রতিক কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা'। অর্থনৈতিক সহায়তার লক্ষ্যে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারপিছু একজনকে হোম গার্ডের চাকরি দেওয়া হবে আর পরিবারপিছু দু'লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেছে রাজ্যসরকার। অপ্রীতিকর ঘটনাগুলির নেপথ্যে থাকা শাসকদলেরই নেতাদের বরাভয় আর মদতের বিহিত হবে কীভাবে?