প্রতিবছর ২ লক্ষ ষাঁড়ের হত্যা! ঐতিহ্যের নামে যে বীভৎস ঘটনা ঘটে বুল ফাইটিংয়ে

Brutal Bull Fighting: স্পেনের নাগরিকদের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশই বুলফাইটিংকে সমর্থন করেন।

ঐতিহ্যের নামে, প্রথার নামে পশুবলি বা পশুর মৃত্যু সারা বিশ্বে নতুন ঘটনা নয়। কেবল এই মৃত্যুর পরিসংখ্যান হঠাৎ চোখে পড়লে অবাক হয়ে যেতে হয়! প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে স্রেফ ষাঁড়ের লড়াইয়েই প্রায় ১৮০,০০০ ষাঁড় মারা যায়। ঐতিহ্যের নামে চলা এই বুল ফিয়েস্টাগুলিতে বহু মানুষেরও প্রাণ যায়, আহত হন অজস্র। বুলফাইটিংয়ের রিংয়ে ঢুকে বুলফাইটার বা মাতাদোর ষাঁড়টিকে ব্যান্ডেরিলাস বা কাঠের হাতলওয়ালা তরোয়াল দিয়ে আঘাত করে। তার উদ্দেশ্য হলো ষাঁড়টির কাঁধের মধ্যে তরোয়াল চালিয়ে দিয়ে হত্যা করা। তবে বাস্তবে বেশিরভাগ মাতাদোর লক্ষ্যপূরণ করতে পারে না। ষাঁড়ের ফুসফুস ভেদ করে যায় তরোয়াল। যার ফলে রক্ত বইতে থাকে ষাড়ের নাক-মুখ দিয়ে।

এই ভয়াবহ খেলা ঐতিহ্যের নামে চলে আসছে যুগের পর যুগ। তবে আর্জেন্টিনা, কানাডা, কলম্বিয়া, কিউবা, ডেনমার্ক, ইতালি এবং যুক্তরাজ্য সহ অনেক দেশেই বুলফাইটিং নিষিদ্ধ। তবে বিশ্বজুড়ে কয়েকটি দেশ এখনও রয়েছে যেখানে এই বীভৎস খেলা চলে: স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, মেক্সিকো, ভেনিজুয়েলা, পেরু এবং ইকুয়েডর। স্পেনে আইনি হলেও স্পেনের কিছু শহর যেমন ক্যালোঞ্জ, টোসা ডি মার, ভিলামাকোলাম এবং লা বাজল, বুলফাইটিং নিষিদ্ধ করেছে। স্পেনের বালিয়েরিক দ্বীপপুঞ্জ বুলফাইটিং নিষিদ্ধ করার জন্য বেশ কিছু প্রচেষ্টা চালালেও স্পেনের আদালত তা খারিজ করে দেয়।

আরও পড়ুন- মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের কি পিরিয়ডস হয়?

তেমনই, মেক্সিকোয়, সিনালোয়া, সোনোরা, গেরেরো, কোহুইলা এবং কুইন্টানা রু (তবে ২৭টি মেক্সিকান রাজ্যে ষাঁড়ের লড়াই আইনি) এই পাঁচটি রাজ্যে বুলফাইটিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মেক্সিকোর সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে, বুলফাইটিং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নয়। ২০২২ সালের জুনে মেক্সিকো সিটির প্লাজায়, বিশ্বের বৃহত্তম বুলরিংয়ে, বুলফাইটে অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি করে।

পাম্পলোনায় যেমন ষাঁড়ের দৌড় হয়। ষাঁড়টি সরু রাস্তা দিয়ে দৌড়য়, তার পিছু পিছু বহু লোক ধাওয়া করে এবং ষাঁড়টি বুলরিংয়ে ঢোকে। সেখানে মাতাদোর লড়াই করে ষাঁড়ের সঙ্গে। এল টোরো জুবিলোতে আবার ষাঁড়ের লেজ ধরে টানে দর্শকরা, ষাঁড়ের চারপাশে শব্দবাজি ফাটায়। টোরো দে লা ভেগাতে আবার ষাঁড়টিকে শহর থেকে ধাওয়া করে নিয়ে যায় অংশগ্রহণকারীরা। ষাঁড়টিকে নানাভাবে যন্ত্রণা দেওয়া হয়, ছুরি মারা হয়।

টোরো দে লা ভেগা ফিয়েস্তার এই ভয়াবহ রীতির বিরোধিতা করে PACMA এবং HCI বহু বছর ধরে প্রচার করার পরে এখন বার্ষিক এই অনুষ্ঠানে নানা বিধিনিষেধ স্থাপন করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা কমানো হয়েছে। অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে ষাঁড়টিকে হত্যা করা যাবে না সেই বিধিও আরোপ করা হয়েছে। এতে ষাঁড়ের প্রাণ বেঁচেছে বা ভোগান্তি কমেছে এমন না, তবুও এই ধরনের নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটাতে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এটি।

ভারতেও জল্লিকট্টু নামে এক এমনই বীভৎস রীতি প্রচলিত আছে। দক্ষিণ ভারতের এই বিখ্যাত উৎসবে পুরুষরা ভিড় করে ষাঁড়কে তাড়া করে, তাদের লেজ ধরে অত্যাচার করে, যথেচ্ছ মারে এবং পেরেক বসানো লাঠি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে। চোখে লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে দেওয়া হয়। জোর করে মদ খাইয়ে দেওয়া হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ষাঁড়গুলি বুলরিংয়ে একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে। একে অন্যের তীক্ষ্ণ শিং অন্যের শরীরে লেগে গুরুতর আহত হয় ষাঁড়।

আরও পড়ুন- রাত ৯ টায় রহস্যময় গর্জন! হাজারে হাজারে মানুষ পশুকে খুন করেছিল বিশ্বের বীভৎসতম এই হ্রদ

স্পেনে, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রকের তথ্য বলছে, সেখানে বার্ষিক বুলফাইটিংয়ের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৯ সালে মোট ২,৬৮৪টি ষাঁড়ের লড়াই হয়েছিল। সেই তুলনায় ২০১৯ সালে ১,৪২৫ টি ষাঁড়ের লড়াই হয়। অর্থাৎ এক দশকে প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বুলফাইটিং। বুলফাইট দেখতে আসা মানুষের সংখ্যাও কমছে। ২০১৮-১৯ সালে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ বুলফাইট দেখতে যান।

স্পেনের আমজনতাও এই নিষ্ঠুর রীতির বিরোধিতা করছে। ২০১৩ সালের একটি তথ্য বলছে, স্পেনের নাগরিকদের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশই বুলফাইটিংকে সমর্থন করেন। ৭৬ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, বুল ফাইটিংয়ের জনসাধারণের টাকা ব্যবহারের বিরোধিতা করেন তারা। স্পেনের জনগণের ৭৪ শতাংশ মানুষ টোরো দে লা ভেগার বুল ফিয়েস্টার বিরোধিতা করেন।

বুলফাইটিং এবং বুল ফিয়েস্টাগুলি পর্যটকদের কাছ থেকে আসার অর্থের উপরই নির্ভর করে। অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্রিটিশ ট্র্যাভেল এজেন্টসের প্রাণী কল্যাণ নির্দেশিকাগুলিতে এই অনুষ্ঠানগুলোকে 'অগ্রহণযোগ্য' হিসাবে তালিকাভুক্ত করে। কোভিড-১৯ মহামারীকালে অনেক বুলফাইট এবং বুল ফিয়েস্টা বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রাণী সুরক্ষার ক্রমাগত বাড়তে থাকা চাপের মুখে পড়ে এই নির্মম রীতিগুলির সফর শেষের মুখেই।

More Articles