বাবার মন ও কয়েকটি প্রশ্ন

মেয়ের বাবা হলেও আমি তো পুরুষই। তাই নারী হিসেবে সে কী ভাববে তা নিয়ে মত প্রকাশের অধিকার ও যোগ্যতা আমার নেই

বাড়িতে মা-বোন নেই?’ পথে-ঘাটে উত্ত্যক্ত অনেক মহিলার মুখে শোনা যায় রিফ্লেক্স-জাত এই বচন। চড়-থাপ্পড় না কষিয়ে এক স্বতঃস্ফূর্ত ও ক্রুদ্ধ উচ্চারণেই বেশিরভাগ সময় ভরসা রাখেন তাঁরা। ভিড় বাসে, ভরা ট্রেনে পুনঃপুন ঘুরে-ফিরে আসে ওই একই প্রশ্নবোধক বাক্য—‘বাড়িতে মা-বোন নেই?’ ঘটনা বদলায়, পরিস্থিতি বদলায় না। উদ্দিষ্ট পুরুষ বদলায়, প্রশ্ন বদলায় না। শুনে মনে হয়, ব্যাপার খানিক এমন যে বাড়িতে মা-বোন থাকলে যেন উক্ত পুরুষটির ওই কৃতকর্ম করার কথা নয়। এইখানে এসে প্রশ্নবোধক বাক্যটি সমাজের মনে মনে কোমল বিস্ময়বোধকে পরিণত হয়—আহা গো, ওঁর ঘরে মা-বোন নেই নিশ্চয়, থাকলে কি আর এমন অশালীন কীর্তিকলাপ করে বেড়াতেন তিনি! বস্তুত এই চিরচেনা বাক্যবন্ধ বিন্দুমাত্র বিস্ময়ের উদ্রেক না করেও প্রমাণ করে দিয়ে যায়, বাড়িতে মা-বোন থাকার উপরে একটি বৃহৎ অংশের পুরুষের কোনো কাজ আদতে নির্ভর করে না।

এরকমই আরেক ধরনের উক্তিতে সমাজ টেনে আনে কন্যাসন্তানকে। কেউ তর্জনী সামনে তাক করে বলেন—‘আপনারও তো মেয়ে আছে, তার কথাটা একবার ভাবুন, তার সঙ্গেও যদি কখনো এমন হয়…।’ কেউ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেন তর্জনী—‘মেয়ের বাবা হিসেবে আমি আতঙ্কিত, লজ্জিত।’ আপাতবিচারে এই ভাবনা অস্বাভাবিক নয়। কখনো অপরকে, কখনো-বা নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার এই প্রক্রিয়া যে আসলে সচেতন করারই প্রয়াস, তা বুঝতে সমস্যা হয় না। কিন্তু এর মধ্যে কি থেকে যায় না স্বার্থপরতার আদিম বীজ? আমরাই কি অজান্তে নিজেদের অন্তরে রোপন করতে চাই না সুবিধাবাদের চারা?

আমার ঘরে যদি মেয়ে না থাকত, যদি আমি কন্যাসন্তানের পিতা না হয়ে পুত্রসন্তানের পিতা হতাম, তাহলে কি দু-এক পরত কম আতঙ্কিত বা কম লজ্জিত হওয়াও জায়েজ হত? না কি এসব নিয়ে না ভাবলেও চলত? কেউ মেয়ের বাবা হয়েছে বলেই এই ভাবনা আর এই আতঙ্ক তার একক বাধ্যবাধকতা হতে পারে না। অথচ আমাদের প্রতিবাদী ভাষ্যেও সেই ইঙ্গিত পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। সযত্ন লালিত এসব সামাজিক নির্মাণ তাই আজও পক্ষপাতদুষ্ট রয়ে গিয়েছে বলেই বোধ হয়। দিনান্তে আমরা যতই আয়নার সামনে দাঁড়াই, সব প্রতিবিম্ব সমান স্পষ্ট দেখি না।

একদা আমাদের চালু লব্জ ছিল—‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা’। এখনও বোধ হয় তীব্র অপমানজনক এই কথাটি ‘বাজার’ থেকে উবে যায়নি। এই যে মেয়ের বাবার মন পড়তে চাওয়া, তার গভীরেও কি কতকটা সমগোত্রীয় ভাবনাই কাজ করছে না? যে অদৃশ্য ও দৃশ্যমান দুশ্চিন্তা নিয়ে আমরা ভাবিত, তা যদি সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে হয়, তাহলে তার শুরুয়াত মূল থেকেই হওয়া উচিত; যা অনেকাংশে ঘাপটি মেরে রয়েছে আমাদের ভাবনাচিন্তার রেফারেন্সগুলির মধ্যে। তাকে নড়ানো না গেলে কি সমূল উৎপাটন আদৌ সম্ভব?

মুখে যতই আমরা সমানাধিকারের কথা বলি, ‘অর্ধেক আকাশ’ বলে কাব্য আওড়াই; প্রতি পদক্ষেপে আজও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতা বলতে চায়—নারীর পরিত্রাতা পুরুষই। একজন পিতা যদি তার পুত্রের জন্য দুশ্চিন্তা না করেন, তাহলে কন্যার জন্য দুশ্চিন্তা করার ‘মাথার দিব্যি’ তাঁকে সমাজ দেবে কেন? কেন আমরা আগাম এই স্বতঃসিদ্ধে পৌঁছে যাব যে একটি মেয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হবে না? বয়ফ্রেন্ড বা স্বামী তো বটেই, তাঁর বাবাই-বা কেন খামোখা সুপারম্যানের পোশাকে গা গলানোর জন্য প্রস্তুত হবেন? এই সমাজে ঘৃণ্য শ্বাপদের অভাব নেই ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে জুঝে ওঠার মনোবল কোনো একক মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তোলার পরিস্থিতি আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি না, তা-ও ভেবে দেখা জরুরি বলেই মনে করি।

এক দশক আগে, একটি লেখার প্রয়োজনে রাত কাটিয়েছিলাম ক্যানিং স্টেশনে। খুব ভোরের যে দু-তিনটি ট্রেনে দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ অংশের গৃহ-সহায়িকারা কাজে আসেন, তেমনই একটি ট্রেন ধরি। বাবু-বিবিদের ভাষায় এই ট্রেনগুলির ডাকনাম ‘ঝি লোকাল’। তথাকথিত ভদ্রবিত্তের পরিমণ্ডলে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে যে নানাবিধ তাত্ত্বিক বুকনি ঘুরপাক খায়, তার সর্বোচ্চ প্রায়োগিক ছবিটি আমার চোখে সেইদিন ধরা পড়ে। সে-ট্রেনের প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ যাত্রীই ছিলেন মহিলা। তাঁদের চাউনি, কথাবার্তা, বডি-ল্যাঙ্গুয়েজে ঝরে পড়া কনফিডেন্স সেই ভোরে হয়ে উঠেছিল এক অভূতপূর্ব শিক্ষা। আমি শুধু চাই, এই আত্মবিশ্বাস আমার মেয়ের মধ্যেও জন্ম নিক।

ভুল বললাম, মার্জনা করবেন। মেয়ের বাবা হলেও আমি তো পুরুষই। কাজেই এক নারী হিসেবে সে কী ভাববে, কীভাবে গড়ে তুলতে চাইবে নিজেকে, তা নিয়ে মত প্রকাশের অধিকার ও যোগ্যতা আমার নেই। তার সিদ্ধান্ত, সে নিক। দূর থেকে আমার মন বড়োজোর এটুকু চাইতে পারে, এই সমাজে পুরুষের সচেতনতার জন্য নারীর অনুষঙ্গ নিয়ে আসার প্রবণতা বন্ধ হোক। বন্ধ হোক নারীর সুরক্ষার জন্য পুরুষের মুখাপেক্ষী হওয়া।

 

 

More Articles